কু-দীপ
তৃণমূলে তাপসের পয়লা নম্বর ‘শত্রু’ ছিলেন সু-দীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। মূলত তাঁর বিরোধিতা করেই তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন তাপস। অতঃপর তাঁকেই সু-দীপের বিরুদ্ধে উত্তর কলকাতায় প্রার্থী করেছে পদ্মশিবির। তাপসের সুদীপ-বিরোধিতা প্রাচীন। অনেকটা অরণ্যের প্রাচীন প্রবাদের মতো। তৃণমূলে থাকতেই সু-দীপকে প্রকাশ্যে ‘নন প্রোডাক্টিভ সাদা হাতি’ বলতেন তাপস। অনেক সময়েই প্রকাশ্যে ছাপার অযোগ্য ভাষায় গালমন্দ করেছেন। আশপাশে কে বা কারা আছেন, তার তোয়াক্কাও করেননি। তবে সে বিষয়ে দলের কেউ কখনও তাঁকে ভর্ৎসনা করেছিলেন বলেও শোনা যায়নি। তাপস বলে গিয়েছেন। সু-দীপ শুনে গিয়েছেন। চুপ করে থেকেছেন। শেষমেশ তাপসকে তৃণমূল ছাড়তে হয়েছে। সু-দীপ আবার উত্তর কলকাতায় প্রার্থী হয়েছেন।
সু-ণাল
সুদীপের বিরুদ্ধে তোপধ্বনিতে আগাগোড়া তাপসের পাশে থেকেছেন কু-ণাল ঘোষ। মধ্য কলকাতার রাজনীতিতে তাঁর সঙ্গে সুদীপের সম্পর্ক ‘মধুর’। যে মাধুর্য সুদীপ-জায়া নয়নার হাতের নারকেল নাড়ুতে মাখামাখি। দলের অন্দরে সুদীপ-বিরোধিতার লাইনে কু-ণাল বরাবর তাপসের পাশেই ছিলেন। তফাত একটাই— তিনি সুদীপের বাড়িতে গিয়ে নারকেল নাড়ু খেয়ে এসেছেন। কিন্তু তাপস ঘাড় গোঁজ করে বসে থেকেছেন। কুণাল তৃণমূলে রয়েছেন। তাপস তৃণমূলে থাকতে পারেননি।
ওঁ মণি‘পদ্মে’ হুম
জানুয়ারির গোড়ায় তাপসের বৌবাজারের বাড়িতে হানা দিয়েছিল ইডি। তাপস ইঙ্গিত করেন, সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ই কলকাঠি নেড়ে তাঁর বাড়িতে ইডি পাঠিয়েছেন। কিন্তু তৃণমূলের সুদীপ কী করে ইডি পাঠাবেন? তাপস-উবাচ: সুদীপ আসলে বিজেপির লোক! তার পর থেকেই তাপস আরও ফুঁসতে থাকেন। দলের বিরুদ্ধে খোলাখুলি অভিযোগ করতে শুরু করেন যে, ইডির হানার পর দল তাঁর পাশে দাঁড়ায়নি। অথচ মুখ্যমন্ত্রী বিধানসভায় সন্দেশখালির শেখ শাহজাহানের ‘পক্ষ’ নিয়েছেন। অতঃপর বরাহনগরের বিধায়ক পদে থেকে ইস্তফা দেন তাপস। এবং অতঃপর সটান চলে যান পদ্মে।
য পলায়তি স জীবতি?
তাপস কেন বিজেপিতে? তৃণমূল বলছে, পালিয়েছেন! নিশ্চয়ই কিছু গুবলু ছিল। নইলে বিজেপিতে যাবেন কেন? সুদীপ, মদন মিত্রেরাও তো জেলে ছিলেন। পালাননি তো! তাপস পাল্টা তোপ দেগেছেন এই বলে যে, সুদীপের রাজনৈতিক কেরিয়ারটাই দুর্নীতিতে মোড়া। ১৯৭৩ সালে ভুষি কেলেঙ্কারি করেছিলেন। ২০১৪ সালে রোজ় ভ্যালি মামলায় জেলে গিয়েছিলেন। মমতাকে ‘প্রতিষ্ঠিত অসত্যবাদী’ আখ্যা দিয়েছেন তাপস।
সেম বোট ব্রাদার?
লোকসভা ভোটে আগে-আগে তাপসের বিজেপিতে গিয়ে প্রার্থী হওয়া ২০১৯ সালের ব্যারাকপুরকে মনে করিয়ে দিয়েছে। পাঁচ বছর আগে ব্যারাকপুরে তাঁর বদলে দীনেশ ত্রিবেদীকে টিকিট দেওয়ায় অর্জুন সিংহ তৃণমূল থেকে ঝাঁপ দিয়েছিলেন বিজেপিতে। তখন ভোটের বাকি ২৯ দিন। তার মধ্যেই অর্জুন জিতেছিলেন দীনেশকে হারিয়ে। এ বারেও তার অ্যাকশন রিপ্লে হয়েছে। তাঁর বদলে পার্থ ভৌমিককে টিকিট দেওয়ায় আবার অর্জুন তৃণমূল থেকে ঝাঁপ মেরেছেন বিজেপিতে। যেমন তাপসও ঝাঁপিয়েছেন। তবে তাঁর দলবদলের সঙ্গে লোকসভার টিকিট না-পাওয়ার কোনও সম্পর্ক নেই। অর্জুনের আগে টিকিট না-পাওয়া। পরে দলবদল। তাপসের আগে দলবদল। পরে টিকিট। সুদীপ উত্তর কলকাতার প্রার্থী না-হলে তাপসকে বিজেপি ওই আসনে টিকিট দিত কি? সারা রাজ্য এখন তাকিয়ে আছে, অর্জুনের মতো তাপসও কি তাঁর প্রাক্তন দলকে হারিয়ে দিতে পারবেন?
মিত্র মহাশয়
উত্তর কলকাতায় সোমেন মিত্রের ‘অনুগামী’ হিসেবেই কংগ্রেসি রাজনীতি শুরু তাপসের। মোটামুটি মমতার সমসাময়িক। পড়াশোনা সেন্ট পল্স কলেজে। তখনই ছাত্র রাজনীতিতে হাতেখড়ি। কালক্রমে ছাত্র পরিষদের রাজ্য সভাপতি। কংগ্রেসি রাজনীতিতে একদা তাপস ছিলেন ‘অন্ধ সোমেন অনুগামী’। আবার পাশাপাশি অজিত পাঁজারও ‘স্নেহধন্য’। একদা তাপসকেই রাজ্য যুব কংগ্রেসের সভাপতি করতে চেয়েছিলেন সোমেন। কিন্তু দিল্লি থেকে রাজীব গান্ধী বেছে নিয়েছিলেন মমতাকে। মিত্র মহাশয় রাজীব নামক ‘দেবতা’র গ্রাস থেকে শিষ্য তাপসকে বাঁচাতে পারেননি।
ভূয়োদর্শী
১৯৯৭ সালের ডিসেম্বরে মমতা ঘোষণা করেন, সিপিএমের প্রকৃত বিরোধিতা করতে তিনি কংগ্রেস ছেড়ে নতুন দল গড়বেন। প্রদেশ কংগ্রেসের সম্পাদকমণ্ডলী মমতাকে দল থেকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেয়। সোমেন, প্রদীপ ভট্টাচার্য, সুব্রত মুখোপাধ্যায়-সহ সকলেই মমতাকে বহিষ্কারের পক্ষে ছিলেন। বিরোধিতা করেছিলেন শুধু তাপস। তাঁর যুক্তি ছিল, মমতা দল ছাড়লেন আর মমতাকে দল তাড়াল— দুটোর মধ্যে বিস্তর ফারাক। দ্বিতীয়টা হলে মমতাই ‘রাজনৈতিক সুবিধা’ পাবেন। কংগ্রেসিদের আবেগ তাঁর পক্ষে যাবে। কিন্তু পাত্তা পাননি। সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত মেনে মমতাকে বহিষ্কারই করেছিল কংগ্রেস। বাকিটা ইতিহাস!
পঞ্চাত্বপ্রাপ্তি
তাপস প্রথম কলকাতা পুরসভার কাউন্সিলর হন ১৯৮৫ সালে। ৪৮ নম্বর ওয়ার্ড থেকে জিতেছিলেন কংগ্রেসের হয়ে। কিন্তু ১৯৯০ সালের ভোটে হেরে যান। সেই ভোটে তাপসের ওয়ার্ড দখলে সিপিএম নামিয়েছিল জনৈক ‘পঞ্চা’কে। পিস্তল-হাতে পঞ্চার ছবি ছাপা হয়েছিল বিভিন্ন কাগজে। তবে ১৯৯৫ সালের পুরভোটে আবার জিতে কাউন্সিলর হয়েছিলেন তাপস। তত দিনে তিনি যাবতীয় ‘পঞ্চা’দের সামলাতে শিখে গিয়েছেন।
আমহার্স্ট স্ট্রিট থেকে কালীঘাট
১৯৯৬ সালে তৎকালীন বিদ্যাসাগর কেন্দ্র থেকে কংগ্রেসের টিকিটে বিধায়ক হন তাপস। কিন্তু মমতাকে কংগ্রেস তাড়ানোর পর থেকে সোমেন মিত্রের সঙ্গে দূরত্ব বাড়তে থাকে তাপসের। শেষ পর্যন্ত অজিত পাঁজার মধ্যস্থতায় তৃণমূলে শামিল হন তিনি। ২০০১ সালের ভোটে বড়বাজার কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের টিকিটে বিধায়ক হন তাপস। তার পর থেকে তিনি তৃণমূলেই। এই সে দিন বরাহনগরের বিধায়কের পদ থেকে ইস্তফা দেওয়ার আগে পর্যন্ত।
পুলিশ তুমি যতই পারো
বিধানসভায় পুলিশ বাজেটে তাপসের বক্তৃতা সব সময়ে সুপারহিট থেকেছে। অন্য বিষয়ে কিছু বলুন বা না-বলুন, পুলিশ বাজেট নিয়ে বিতর্কে তাপস বলতেনই। পুলিশের বিভিন্ন মহলেও তাঁর যোগাযোগ ছিল। অনেকে বলতেন, বাইরে থাকাদের ভিতরে পাঠানো বা ভিতরে থাকাদের বাইরে আনার ক্ষেত্রে তাপস নাকি ‘ম্যাজিক’ জানতেন।
ধরি ধরি মনে করি...
ধরতে গিয়ে আর পেলেম না। কী পেলেন না? রাজ্যের মন্ত্রিত্ব। মমতার দ্বিতীয় সরকারের শেষ দিকে কিছু দিনের জন্য প্রতিমন্ত্রী হয়েছিলেন বটে। কিন্তু ওই পর্যন্তই। তৃতীয় মেয়াদে তিনি বাদ পড়েন মন্ত্রিসভা থেকে। গত বছরেও এক বার শোনা গিয়েছিল, তাপস মন্ত্রী হতে চলেছেন। কিন্তু সে বারেও শেষ মুহূর্তে তাঁর নাম কাটা পড়ে! দুষ্টু লোকেরা বলে, সুদীপের ‘হস্তক্ষেপেই’ নাকি সে বার মন্ত্রিত্বের শিকে ছেঁড়েনি তাপসের। তাঁকে বিধানসভায় তৃণমূলের উপ মুখ্যসচেতক হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে। অপ্রাপ্তির কাহিনি আরও আছে। মাঝে এক বার মমতা সুদীপকে সরিয়ে তাপসকে উত্তর কলকাতার সাংগঠনিক জেলা সভাপতির দায়িত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু সে দায়িত্বও তাপসের থেকে আবার সুদীপে বর্তায়। সুদীপ যে পদটি ফেরত চেয়েছিলেন, তা প্রকাশ্য মঞ্চ থেকেই বলেছিলেন মমতা। পরে তাপসকে দমদম-ব্যারাকপুর সাংগঠনিক জেলার সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয়। ওইটুকুই।
চশমাখোর
তাপসের পরিবার বলতে স্ত্রী, ছেলে এবং মেয়ে। ছেলে বিদেশে থাকেন। মেয়ে শিক্ষয়িত্রী। একটা সময়ে চকচকে কামানো গাল ছিল তাপসের। তার পরে দাড়ি রাখতে শুরু করেন। সঙ্গে একটি মোটা কালো ফ্রেমের চশমা। বলতে নেই, মানিয়েছিলও ভাল। পুত্রগর্বে গর্বিত পিতা বলেছিলেন, ফ্যাশনদার চশমাটি তাঁর প্রবাসী পুত্রের দেওয়া।
রেখাচিত্র: সুমন চৌধুরী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy