কাঞ্চন ও কামিনী
গ্রামের দিকের মহিলারা আপত্তি করেছিলেন। তাই সতীর্থ বিধায়ক কাঞ্চন মল্লিককে তাঁর প্রচার গাড়ি থেকে সটান নামিয়ে দিয়েছেন কল্যাণ। কেন নামিয়েছেন, তা-ও বলেছেন। একাধিক বার বিবাহিত অভিনেতা কাঞ্চনকে দেখলেই নাকি মহিলা ভোটাররা এ দিক-ও দিক তাকাচ্ছেন। প্রথম দিন কাঞ্চন তাঁর প্রচার গাড়িতে ওঠার পরেই কল্যাণ বলে দিয়েছিলেন, ‘‘কাল আর এসো না! মহিলারা ভাল চোখে দেখছেন না।’’ পরদিন কাঞ্চন আবার হাজির। গাড়িতে দাঁড়িয়েই কল্যাণ বলেন, ‘‘কাল তোমায় বললাম না, এসো না! আবার চলে এসেছ? প্লিজ় চলে যাও।’’ কাঞ্চন কথা বাড়াননি। দ্রুত এক দলীয় কর্মীর মোটরবাইকের পিছনে চড়ে এলাকা ছাড়েন।
কল্যাণকামী
শ্রীরামপুর লোকসভা থেকে টানা তিন বার সাংসদ হয়েছেন। ২০২৪ সালে জিতলে নতুন রেকর্ড তৈরি করবেন। কারণ, শ্রীরামপুরে টানা চার বার কেউ সাংসদ হননি। অতীতে সিপিএমের দীনেন ভট্টাচার্য সব মিলিয়ে চার বার জিতেছিলেন শ্রীরামপুর থেকে। কিন্তু টানা নয়। প্রথম বারের পরে জয়ে ছেদ পড়েছিল দীনেনের। তার পরে পর পর তিন বার জিতেছিলেন। এ বার জিতলেই কল্যাণ তাঁকে টপকে যাবেন।
বাপ্পি বাড়ি যা!
২০১৪ সালে শ্রীরামপুর থেকে দ্বিতীয় বার সাংসদ হন কল্যাণ। সে বার বিজেপি শ্রীরামপুরের মঞ্চে নামিয়েছিল সুরকার এবং গায়ক বাপ্পি লাহিড়িকে। তাঁর রোড-শো বিপুল ভিড় টানছিল। যা দেখে তৃণমূল খানিক চকিতই হয়েছিল। ঈষৎ উদ্বেগে ছিলেন কল্যাণ নিজেও। জেতা হবে তো? যদিও ভোটের পর দেখা গিয়েছিল বাপ্পি তিন নম্বরে। ভোটের পর তৃণমূল স্লোগান দিয়েছিল ‘বাপ্পি বাড়ি যা’। ২০১৪ সালের মতোই ২০১৯ সালেও কল্যাণের বিরুদ্ধে সিপিএম আবার প্রার্থী করেছিল তীর্থঙ্কর রায়কে। বিজেপি টিকিট দিয়েছিল রাজ্য যুব মোর্চার নেতা দেবজিৎ সরকারকে। বিজেপির ভোট বাড়লেও কল্যাণ জেতেন এক লক্ষের কাছাকাছি ভোটে। বাকিদের বাড়ি পাঠিয়ে।
আইনেই তো আছি দাদা
জন্ম আসানসোলে। বয়স সাতষট্টি। স্কুলের পঠনপাঠন শেষের পরে বাঁকুড়া সম্মিলনী কলেজ থেকে বিকম পাশ করে বাঁকুড়া এবং রাঁচীর আইন কলেজ থেকে স্নাতক। আশির দশকের গোড়া থেকে কলকাতা হাই কোর্টে প্র্যাকটিস শুরু। বলিয়ে-কইয়ে আইনজীবী হিসেবে নাম রয়েছে। বাম জমানায় একাধিক মামলায় সরকারকে বেকায়দায় ফেলেছিলেন। তার মধ্যে ‘মাইলফলক’ ভিখারি পাসোয়ান মামলা, রিজওয়ানুর রহমান হত্যা মামলা, ছোট আঙাড়িয়া মামলা এবং সিঙ্গুর মামলা।
লাইনেই তো আছি দিদি
বাড়ি হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাড়ায়। তাই ফ্ল্যাট কিনেছেন দিদির বাড়ির একেবারে কাছে। দিদির পড়শি তিনি। তৃণমূলে তিনি দিদি-অন্তঃপ্রাণ। মাঝেমধ্যে মান-অভিমান হলেও দিদি-ভাইয়ের সম্পর্ক অটুট। মমতা যখন যুব কংগ্রেসের রাজ্য সভানেত্রী, তখন তাঁর কালীঘাটের বাড়িতে প্রতি রবিবার বসত আইনি দরবার। আইনজীবীরা সেখানে সাধারণ মানুষকে সহযোগিতা করতেন। পরামর্শ দিতেন। তখন দিদির বাড়িতে যেতেন তরুণ কল্যাণ। সেই থেকেই তিনি মমতা-অনুগামী।
ঘর ঘর কি কহানি
কল্যাণের বিরুদ্ধে এ বার বিজেপির প্রার্থী তাঁর প্রাক্তন জামাতা কবীরশঙ্কর বসু। কল্যাণ-তনয়া প্রমিতির সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল কবীরের। কয়েক বছর আগে বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছে। কবীর পেশায় সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী। যদিও প্রাক্তন শ্বশুর কোথাও কোথাও প্রচারে বলছেন, ‘‘কী এমন আইনজীবী? একটাও মামলার কথা বলতে পারবেন?’’ কন্যা প্রমিতি ছাড়া কল্যাণের বাকি পরিবার বলতে স্ত্রী ছবি এবং পুত্র শীর্ষাহ্ন। পুত্রও পেশায় আইনজীবী। বাবার সঙ্গে প্রচারেও যাচ্ছেন। তাঁর ধীরস্থির বক্তৃতা অনেক তৃণমূল কর্মীর মন কাড়ছে। বাড়ছে গুঞ্জন— কল্যাণ কি ২০২৬ সালের বিধানসভায় মহড়ায় নামিয়েছেন আত্মজকে?
‘ধর’ তক্তা, মার পেরেক!
প্রচারের প্রথম থেকেই জোর ঠোকাঠুকি। সিপিএমের প্রার্থী তরুণী দীপ্সিতা ধর তাঁর প্রচারে কল্যাণকে ‘মিস্টার ইন্ডিয়া’ আখ্যা দিয়েছেন। কারণ, শেখর কপূর পরিচালিত সেই ছবির নায়কের মতোই নাকি সাংসদ কল্যাণকে (এলাকায়) দেখা যায় না। জেএনইউয়ের প্রাক্তনীকে কল্যাণই বা ছেড়ে কথা বলবেন কেন! কালক্ষেপ না-করে তিনি পাল্টা দিয়েছেন, ‘‘উনি তো সোফিয়া লোরেন!’’
ও গঙ্গা তুমি
শ্রীরামপুরে ধোবিঘাটের পাশে গঙ্গার ধারে একটি আবাসনে কল্যাণের ফ্ল্যাট। বছরের অনেকটা সময় সেখানে থাকেন তিনি। সপ্তাহান্তে তো বটেই। কেন্দ্রের কাজকর্ম দেখতে যেতে হয় তখন। সেটিই তখন তাঁর আস্তানা। আবাসনের নাম ‘গঙ্গাদর্শন’। কল্যাণের ঘরের পর্দা সরালেই ‘ও গঙ্গা তুমি’। যদিও পরের লাইনগুলো (‘অসংখ্য মানুষের হাহাকার শুনেও নিঃশব্দে-নীরবে, ও গঙ্গা তুমি, ও গঙ্গা বইছ কেন’ ইত্যাদি) বাদ!
উল্টে দেখুন পাল্টে গেছে!
কোভিডের সময় অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ডায়মন্ড হারবার মডেল’-এর কড়া সমালোচনা করেছিলেন কল্যাণ। অভিষেকের নেতৃত্বে বাংলার বাইরে গোয়া, ত্রিপুরায় পাড়ি জমানোর চেষ্টা করছিল তৃণমূল। ‘ডায়মন্ড হারবার মডেল’-এর সমালোচনার সূত্রে কল্যাণ বলেছিলেন, ‘‘আমার নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আর কাউকে নেতা বলে মানি না! আগে ত্রিপুরা-গোয়া জিতে দেখান! তার পরে নেতা মানব।’’ কল্যাণ অবশ্য কারও নাম করেননি। কিন্তু দক্ষিণ কলকাতায় কল্যাণের কুশপুতুল পোড়ে। পোস্টার পড়ে, ‘...তোমায় জানতে হবে, আগামীকে মানতে হবে।’ মমতার ভাইপো আকাশ বন্দ্যোপাধ্যায় ফেসবুকে পোস্ট করেন, ‘শ্রীরামপুর নতুন সাংসদ চায়’। তবে বছরখানেক বাদে কল্যাণই বলেন, ‘‘অভিষেক অনেক পরিণত রাজনীতিক।’’
রা-জীবে প্রেম!
রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে তীব্র কোন্দল ছিল কল্যাণের। রাজীব ছিলেন ডোমজুড়ের বিধায়ক। ঘটনাচক্রে, যে ডোমজুড় কল্যাণের লোকসভা কেন্দ্র শ্রীরামপুরের মধ্যে। রাজীব বিজেপিতে যাওয়ার পর কল্যাণ আনন্দিতই হয়েছিলেন। তিনি তৃণমূলে ফেরার পর কল্যাণ খুব দুঃখ পেয়েছেন, এমনটা জানা যায়নি। তবে এখনও সুযোগ পেলেই রাজীবকে কটাক্ষ করেন তিনি।
তোমারি পদ-পানে চাহি
লোকসভার শীতকালীন অধিবেশনে রাজ্যসভা থেকে বিরোধী সাংসদদের গণবহিষ্কার করেছিলেন চেয়ারম্যান জগদীপ ধনখড়। সংসদের সিঁড়িতে ধনখড়কে হুবহু নকল করেছিলেন কল্যাণ। মোহিত রাহুল গান্ধী তাঁর মোবাইলে সেই দৃশ্য রেকর্ড করেছিলেন। বাংলার প্রাক্তন রাজ্যপাল অবশ্য বলেছিলেন, উপরাষ্ট্রপতি পদের অমর্যাদা করেছেন কল্যাণ। যদিও তৃণমূলের আইনজীবী-সাংসদ অবলীলায় বলেন, ‘মিমিক্রি’ বা ‘নকলনবিশি’ হল ‘ফ্রিডম অফ এক্সপ্রেশন’। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা।
গান ভালবেসে গান
সুর-তাল যে সব সময় ঠিকঠাক থাকে, তা নয়। তবে সে ভয়ে গায়ক কল্যাণের হৃদয় কম্পিত নয়। কখনও গেয়েছেন ‘নদিয়া সে দরিয়া, দরিয়া সে সাগর’, কখনও ‘দম মারো দম’। কোথাও আবার গানের সঙ্গে কোমরও দুলিয়েছেন। গত বছর অক্টোবরে রাজভবনের উত্তর গেটের সামনে অভিষেকের ধর্নামঞ্চে বক্তৃতা দিতে দিতে হঠাৎই কল্যাণ গাইতে শুরু করেন, ‘বিস্তীর্ণ দু’পারের, অসংখ্য মানুষের হাহাকার শুনেও, নিঃশব্দে-নীরবে, ও গঙ্গা তুমি, ও গঙ্গা বইছ কেন’! থামানো যাচ্ছিল না। অগত্যা অভিষেক মঞ্চে উঠে কল্যাণের ঠিক পিছনে গিয়ে দাঁড়ান। কল্যাণ ব্রেক কষেন। তবে গাড়ি ওল্টায়নি। যাবতীয় জল্পনা অসার প্রমাণ করে ‘প্রবীণ’ কল্যাণ লোকসভা ভোটে টিকিট পেয়েছেন।
রেখাচিত্র: সুমন চৌধুরী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy