কঠিন বিলা পাবলিক
একদা নিজের সম্পর্কে এই বিশেষণই ব্যবহার করতেন। ঈষৎ মুর্শিদাবাদি টানে। সঙ্গে হো-হো হাসি। ‘কঠিন’ সম্ভবত তাঁর সবচেয়ে বেশি আয়াসের বিবরণ। অমুকে ‘কঠিন’ লোক। তমুকে ‘কঠিন’ জিনিস! তিনি নিজেও ‘কঠিন’ লোক বইকি! ‘বিলা’ তাঁর আদরের সম্বোধন। ‘বিলা পাবলিক’ মানে এর সঙ্গে মিলবে।
মুর্শিদাবাদের রবিনহুড
সার্থক নাম। রাজনীতিতে আসার পর থেকে তাঁর দর্শন, তাঁর শাসন— দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন। তাঁর শাসন। বহরমপুর টাউন ক্লাবে প্রতি রাতে বসত তাঁর দরবার। সেখানেই অভিযোগ। সেখানেই বিচার। সেখানেই হাতেনাতে শাস্তি। শুধু হাতে তির-ধনুকের বদলে অদৃশ্য ন্যায়দণ্ড!
সুধীর-অধীর
দেখতে অনেকটা প্রাক্তন ফুটবলার সুধীর কর্মকারের মতো। রথের মেলায় ছোটবেলায় বিচ্ছিন্ন যমজ ভাই বলেও চালিয়ে দেওয়া যায়। তবে নিজে ফুটবল খেলেছেন বলে শোনা যায় না। স্কুলে পড়ার সময় থেকেই সক্রিয় রাজনীতিতে। পরে আরএসপি, একটু সিপিএম এবং অনেকখানি কংগ্রেস হলেও তখন নকশালপন্থী। বোনের বিয়েতে যোগ দিতে বাড়ি এসেছিলেন। তখনই তাঁকে ধরে পুলিশ। সেই প্রথম তাঁর জেলযাত্রা।
অধীর-অধীর
তিনি প্রতিবাদে সর্বদা অধীর। এ হল তাঁর নামের নিজস্ব ব্যাখ্যা। কিন্তু এই লোকসভা ভোটের আগে তাঁকে ‘অধীর’ নয়, ‘অস্থির’ লাগছে। একটু বেশি উচাটন। একটু বেশি ছটফটে। অহরহ মেজাজ হারাচ্ছেন। ‘গো ব্যাক’ স্লোগান শুনে রেগে যাচ্ছেন। চড় তুলছেন। পুরনো হুল্লোড়ে, ফুর্তিবাজ, আমুদে লোকটা গেল কোথায়!
ঠোঙা-ভরা বাদামভাজা
হেরে গেলে কী করবেন? বাদাম বেচবেন! আনন্দবাজার অনলাইনকে একান্ত সাক্ষাৎকারে বলেছেন তিনি। পর পর পাঁচ বার সাংসদ হয়েছেন। কিন্তু এ বার নাকি তাঁর লড়াই শক্ত (রসিকতা করে বলা ‘কঠিন’ নয়, সিরিয়াসলি বলা ‘শক্ত’)। যে মুসলিম ভোটে তাঁর অধিকার, সেই তহবিল ভাঙাতে তৃণমূল গুজরাত থেকে এনে দাঁড় করিয়েছে প্রাক্তন ক্রিকেটার ইউসুফ পাঠানকে। বহরমপুরে এই প্রথম অধীরের বিরুদ্ধে এক সংখ্যালঘু মুসলিম প্রার্থী। কাশিমবাজারের বাড়িতে বাদাম কি ভাজা শুরু হয়েছে?
নইলে কিচ্ছু মিলছে না
২০১৪ সালে তিনি জিতেছিলেন সারা রাজ্যের মধ্যে রেকর্ড ভোটে (সাড়ে তিন লক্ষ)। পাঁচ বছর পর ২০১৯ সালে সেই ব্যবধান নেমে এসেছিল ৮০ হাজারে! আরও পাঁচ বছর কেটে গিয়েছে। মুর্শিদাবাদের বিবিধ এলাকায় ঘাসফুল ফুটেছে। তাঁর বহরমপুর লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে বহরমপুর বিধানসভা ছিনিয়ে নিয়েছে বিজেপি। রোদে রাঙা ইটের পাঁজার উপর বসে সিপিএমের সঙ্গে জোট গড়েছেন। ‘রাজা বলে (ভোটের) বৃষ্টি নামা, নইলে কিচ্ছু মিলছে না’!
বড় শূন্য শূন্য দিন
তাঁর নেতৃত্বাধীন রাজ্য কংগ্রেস স্বাধীনতার পরে প্রথম শূন্যে এসে ঠেকেছে। বিধানসভায় এই প্রথম তাদের কোনও প্রতিনিধি নেই। এর আগে ক্ষয়িষ্ণু হতে হতেও কংগ্রেস কিছু আসন পেয়েছিল। কিন্তু ২০২১ সালে পরিষদীয় রাজনীতি থেকে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে তারা। মাঝে কয়েক মাস মুর্শিদাবাদের সাগরদিঘিতে ছিলেন কংগ্রেসের টিকিটে-জেতা বাইরন বিশ্বাস। কিন্তু তিনিও চলে গিয়েছেন তৃণমূলে। অধীর নিজে টিকে রয়েছেন মুর্শিদাবাদের বহরমপুরে। আর কংগ্রেসের অস্তিত্ব রয়েছে মালদহের একটি আসনে। লোকসভা আসনে।
সুবহ্ হো গয়ি মামু
তাঁর আমলে কংগ্রেস কি ‘মামু’ পার্টিতে পর্যবসিত হয়েছে? মামু। অর্থাৎ, মা-মু। অর্থাৎ, মালদহ-মুর্শিদাবাদ। এই দু’টি জেলার বেশি আর কোথাও বিস্তার হয়নি পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেসের। যে দু’টি লোকসভা আসন তারা জিতেছে, তা-ও এই ‘মামু’তেই। যে দু’টি লোকসভা আসন তারা জেতার আশা করছে, সে দু’টিও এই ‘মামু’তেই। মালদহ-দক্ষিণ এবং বহরমপুর। এখনও সেই ‘সুবহ্’, অর্থাৎ ভোরের আশা কি দেখেন অধীর? মনে মনে ভাবেন, ‘ওহ্ সুবহ্ কভি তো আয়েগি!’
ইংলিশ চ্যানেল
১৯৯৯ সালে প্রথম বার সাংসদ হয়েছিলেন। শুরুর দিকে বেশ কয়েক বছর ইংরেজি চ্যানেলে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন না। হ্যা-হ্যা করে হেসে বলতেন, ‘‘বহরমপুর থেকে আগে এমপি হতেন ত্রিদিব চৌধুরী। আর এখন অধীর চৌধুরী! কী অধঃপতন!’’ তবে সেই অধীর এখন ইংলিশ চ্যানেল পেরোন অনায়াসে। হোঁচট না-খেয়ে হিন্দিও বলেন। রাজধানীর রাজনীতিতে থাকতে থাকতে লোকসভায় কংগ্রেসের দলনেতা হয়েছেন। ভাষা শিখেছেন। ইংলিশ চ্যানেলে ভাসাও শিখেছেন।
বুলেটরাজা-ব্যালটরাজা
টিভি শোয়ে নিজেই বলেছেন, গুলি খেয়েছি। প্রয়োজনে গুলি চালিয়েওছি। ফলে বুলেটের রাজা তিনি বরাবর। তবে তাঁর অন্য বুলেটের উপরেও নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। গত শীতে বহরমপুর বাইপাসে দু’হাত ছেড়ে বুলেট মোটরসাইকেল চালিয়েছিলেন ৬৮ বছরের মোহনায় দাঁড়ানো অধীর। বুলেটের সেই ‘স্টান্ট’ ব্যালটে দেখাতে পারবেন তিনি? বুলেটরাজা কি ব্যালটরাজা হবেন এ বারেও?
হয় ছয়, নয় ছুটি
পর পর পাঁচ বার লোকসভায় জিতেছেন। এ বার জিতলে ছয় হবে। হবে কি? অধীর বলছেন, হবেই! না হলে? তিনি ছুটি নিয়ে নেবেন রাজনীতি থেকে।
বেশিরেড
সিপিএমের বিরুদ্ধে রাজনীতি করেই অধীরের রাজনৈতিক উত্থান। এখন সেই সিপিএমেরই বন্ধু তিনি। একদা অভিযোগ করেছিলেন, অনিল বিশ্বাসের সুইস ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট রয়েছে। এখন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমের তাঁর ভাল বন্ধু। সেই বন্ধুর মনোনয়নে গলায় কাস্তে-হাতুড়ি-তারা আঁকা উত্তরীয় জড়িয়ে নিয়েছিলেন। সেলিম কি অধীরকে ‘বেশিরেড’ বলেন?
কঠিন। বিলা। পাবলিক?
তিনি এখনও কঠিন। এখনও বিলা। এখনও একমাত্র তাঁরই অঙ্গুলিহেলনে চলে (বা চলে না) বহরমপুরে কংগ্রেসের দফতরের তিন তলার বাতানুকূল যন্ত্র। এখনও তাঁর ইশারাতেই খোলে সেই দফতরের জানালা-কপাট। কিন্তু সুনসান দফতরে ভোটের ভরা মরসুমেও পাবলিক দেখা যায় না।
রেখাচিত্র: সুমন চৌধুরী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy