খামোশ!
কোন ছবিতে প্রথম বলেছিলেন, সেটা তাঁর নিজেরও মনে নেই। কিন্তু শত্রুঘ্ন সিন্হা আর ‘খামোশ’ সমার্থক। নাভিমূল থেকে উঠে-আসা সেই একাক্ষরী গর্জন শুনলে পিলে চমকে ওঠে। মন বলে পালাই-পালাই! সাধে কি আসানসোলে শত্রুঘ্নের হয়ে রোড-শো করার পরে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘এক্স’ হ্যান্ডলে পোস্ট করেছেন, এই হল আসানসোলের জনশক্তি। খামোশ!
পটনার সাহিব
জন্ম বিহারের পটনায়। অভিনয়ে খলনায়ক, নায়ক, পার্শ্বচরিত্রে দেখা দিয়েছেন বটে। কিন্তু তাঁর মধ্যে একটা নেতাসুলভ হাবভাব ছিল। অতএব, রাজনীতিই তাঁর অন্তিম গন্তব্য হতে পারত। হয়েও গেল। সংসদীয় রাজনীতি শুরু ১৯৯৬ সাল থেকে। বিজেপি দিয়েই। তখন থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত রাজ্যসভার সাংসদ। সেই পর্বেই বাজপেয়ী মন্ত্রিসভার সদস্য। ২০০৯ সালে পটনার সাহিব ফিরে আসেন পটনা সাহিব লোকসভা কেন্দ্রে। বিজেপির টিকিটে লড়েন সহ-অভিনেতা শেখর সুমনের বিরুদ্ধে। জেতেন। ২০১৪ সালেও জিতেছিলেন তিনি। কিন্তু কেন্দ্রে মন্ত্রিত্বের শিকে ছেঁড়েনি। ঝপ করে কংগ্রেসে। ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে কংগ্রেসের টিকিটে দাঁড়িয়ে বিজেপির রবিশঙ্কর প্রসাদের কাছে শোচনীয় ভাবে হারেন শত্রুঘ্ন। পটনার সাহিব ‘খামোশ’ হয়ে যান।
নব রামায়ণ!
শত্রুঘ্নেরা চার ভাই। তিনি কনিষ্ঠতম। সেই জন্যই শত্রুঘ্ন। মোটেই আশ্চর্য নয় যে, বাকি তিন ভাইয়ের নাম রাম, লক্ষ্মণ, ভরত। এ-ও কি আশ্চর্য যে, পটনায় তাঁদের বাড়ির নাম ‘রামায়ণ’? দেশে রাম-রাম হাওয়া বুঝে নিতে দেরি করেননি অভিজ্ঞ শত্রুঘ্ন। আগে এক বার কংগ্রেসের হয়ে দাঁড়ালেও পরে রামভক্তদের দলেই নাম লিখিয়েছিলেন। তবে সেই ভক্তি চটে যায় মোদী মন্ত্রিসভায় ঠাঁই না-পেয়ে। দ্রুত ঝাঁপ কংগ্রেসে। ভোটে হেরে কালীঘাটের শরণে। আসানসোলে জয়। আশ্চর্য নয় যে, এখন তিনি মোদী-শাহকে লক্ষ্য করে বলেন, ‘‘আমরা চার ভাই রাম-লক্ষ্মণ-ভরত-শত্রুঘ্ন। আমাদের বাড়ির নাম রামায়ণ। ওদের কাছে আমাদের রামভক্তি শিখতে হবে!’’
হে রাম!
রামায়ণকে নিজের পরের প্রজন্মেও ইলাস্টিকের মতো টেনে নিয়ে গিয়েছেন। দুই যমজ পুত্রের নাম রেখেছেন লব-কুশ। তাঁরাও সিনেমার জগতেই রয়েছেন। লব ২০১০ সালে প্রথম অভিনয় করেন রাজ কানওয়ার পরিচালিত ‘সাদিয়াঁ’ ছবিতে। সুপারডুপার ফ্লপ! হতাশ লব আট বছরের জন্য বিশ্রামে চলে যান। তাঁর দ্বিতীয় ছবি ২০১৮ সালে, জেপি দত্ত পরিচালিত ‘পল্টন’ ছবিতে। সেটিও খুব একটা দাগ কাটতে পারেনি বক্স অফিসে। পাঁচ বছরের ব্যবধানে তৃতীয় ছবিতে সাফল্য পেয়েছেন লব। গত বছর অনিল শর্মা পরিচালিত ‘গদর-২’ ছবিতে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেন লব। যে ছবি বক্স অফিসে সাড়ে ৬০০ কোটি টাকার ব্যবসা করেছিল। আর এক পুত্র কুশ পরিচালনার কাজ করছেন।
কড়ি ও কোমল
১৯৭১ সালে গুলজ়ারের ‘মেরে অপনে’ ছবিতে অন্যতম মুখ্যচরিত্রে অভিনয় করেন শত্রুঘ্ন। সেই ছবিতেই অভিনয় করেছিলেন কোমল। ছবির টাইটেল কার্ডে তাঁর নাম অবশ্য ছিল পুনম সিন্হা। ছবির সেটেই প্রেম শুরু। পরে পরিণয়। অভিনয়ে আসার আগে ‘মিস ইন্ডিয়া’ হয়েছিলেন কোমল। বিবাহের পরে অভিনয় করেছেন বলে অবশ্য শোনা যায়নি।
চলো রিনা, ক্যাসোরিনা
তাঁকে নিয়ে খুব একটা গসিপ নেই বলিউডে। কিন্তু অভিনেত্রী রিনা রায়ের সঙ্গে একটা লটরপটর ছিল বলে একদা রটেছিল। যদিও সে সব হালে খুব একটা পানি পায়নি। তবে শত্রুঘ্ন-তনয়া সোনাক্ষী ছবির জগতে আসার পরে দুষ্টু লোকেরা তাঁর সঙ্গে রিনা রায়ের মুখের মিল নিয়ে একটা রসালো গল্প ফাঁদতে বসেছিল। শত্রুঘ্ন তাঁদের সটান ‘খামোশ’ করে দেন।
দোস্তানা
ভোটে প্রথম লড়েন ১৯৯২ সালে। সেই লড়াই তাঁর সঙ্গে রাজেশ খন্নার বন্ধুত্বে চিরবিচ্ছেদ ঘটিয়েছিল। ১৯৯১ সালের ভোটে গান্ধীনগর এবং দিল্লি কেন্দ্র থেকে লড়েছিলেন লালকৃষ্ণ আডবাণী। দু’টিতেই জেতেন। দিল্লিতে রাজেশকে হারান সামান্য ভোটে। আডবাণী ছেড়ে দেন দিল্লি আসন। পুনর্নির্বাচনে বিজেপি রাজেশের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়েছিল শত্রুঘ্নকে। রাজেশের কাছে হেরে যান শত্রুঘ্ন। কিন্তু ‘বন্ধু’ শত্রুঘ্নের তাঁর বিরুদ্ধে লড়াই মানতে পারেননি রাজেশ। শত্রুঘ্নের সঙ্গে বাক্যালাপ বন্ধ করে দেন তিনি। সেই প্রতিজ্ঞা রাজেশ ধরে রেখেছিলেন আমৃত্যু। চেষ্টা করেও দরজা খুলতে পারেননি শত্রুঘ্ন। চেষ্টা করেছিলেন বোঝানোর। পারেননি। সেই দুঃখ তিনি বহন করেন এখনও।
কয়লা হলেও ময়লা নয়
নায়কের চরিত্রে একের পর এক ছবি ফ্লপ হচ্ছিল শত্রুঘ্নের। প্রশ্নের মুখে পড়ে যায় তাঁর কেরিয়ার। তাঁকে ফিরে আসতে সাহায্য করেছিল কয়লা। ১৯৮৩ সালে কয়লাশ্রমিকদের জীবন নিয়ে তৈরি নিজের প্রযোজিত ছবি ‘কালকা’য় মুখ্যচরিত্রে অভিনয় করেন শত্রুঘ্ন। সেই ছবিই অভিনেতা হিসেবে তাঁকে পুনর্জীবন দিয়েছিল। কয়লাখনির পটভূমিকায় যশ চোপড়ার ‘কালাপাত্থর’ ছবিতে শত্রুঘ্নের অভিনয়ও স্মরণীয়। অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে সমানে-সমানে পাল্লা টেনেছিলেন ছবির ‘মঙ্গল’। এ এক সমাপতনই হবে যে, আসানসোলের বিস্তীর্ণ এলাকায় কয়লাখনির শ্রমিকেরা রয়েছেন। আর সেই শহরই তাঁর রাজনৈতিক জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। ২০২২ সালে আসানসোল উপনির্বাচনে শত্রুঘ্ন জিতেছিলেন বিপুল ভোটে। ২০২৪ সালে তাঁকে আবার মনোনয়ন দিতে দু’বার ভাবেননি মমতা।
আড়ালে নেই কালীচরণ
সুভাষ ঘাইয়ের পরিচালিত ‘কালীচরণ’ ছবিতে উচ্চ প্রশংসিত হয়েছিল শত্রুঘ্নের অভিনয়। সমালোচকেরা অভিভূত হয়েছিলেন। তৃণমূলশ্রুতি: এই লোকসভা ভোটে নিজের পরিবর্তে কন্যা সোনাক্ষীকে আসানসোলে মনোনয়ন দিতে বলেছিলেন অধুনা ৭৭ বছরের কালীচরণ। সোনাক্ষী বলিউডের পরিচিত মুখ। কেরিয়ার শুরু করেছিলেন পোশাকশিল্পী হিসেবে। তার পরে নায়িকা হিসেবে আবির্ভূত হন তিনি। প্রথম ছবি ২০১০ সালে সলমন খানের সঙ্গে ‘দবং’। মেগাহিট! তৃণমূলের সিলেবাসের পক্ষে এক্কেবারে মানানসই। কিন্তু শত্রুঘ্নের প্রস্তাব নাকি পত্রপাঠ নাকচ করে দিয়েছিলেন দিদি। তিনি চাননি ‘কালীচরণ’ আড়ালে যান।
আসান-সোল?
এমনিতে আসানসোল জয় শত্রুঘ্নের কাছে ‘আসান’ই হওয়ার কথা। একে উপনির্বাচনের সাফল্য পকেটে নিয়ে ঘুরছেন। উপরন্তু, যে বাবুল সুপ্রিয়ের চষা জমিতে সোনা ফলিয়েছিলেন, সেই বাবুলও তাঁর হয়ে প্রচারে নেমেছেন। যদিও চল্লিশোর্ধ্ব সেলসিয়াসের গরম সাতাত্তরের প্রবীণকে একটু কাহিল করে দিয়েছিল। তবে একটা ফ্যাকড়া আছে। শত্রুঘ্নের বিরুদ্ধে শেষ মুহূর্তে ময়দানে আবির্ভূত আসানসোলের ভূমিপুত্র সুরেন্দ্র সিংহ অহলুওয়ালিয়ার নাকি শরীর জুড়ে কপাল! যেখানে দাঁড়ান, সেখানেই টকাটক জিতে যান! সে দার্জিলিং হোক আর বর্ধমান-দুর্গাপুর। আসন পাল্টালেও অহলুওয়ালিয়ার হাত ছাড়েন না ভাগ্যদেবী। শত্রুঘ্নের ‘খামোশ’-এ কি তিনি ভয় পাবেন?
রেখাচিত্র: সুমন চৌধুরী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy