ঝুমে যো পাঠান
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তিনি খ্যাত ‘পিঞ্চহিটার’ হিসেবে। লম্বা-লম্বা ছক্কা মারতেন অবলীলায়। তাঁর ‘হিটিং আর্ক’-এর মধ্যে বল পড়লে দুনিয়ার কোনও স্পিনারের রেহাই ছিল না। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয়েছিল টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটেই। ২০০৭ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ফাইনালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। অতঃপর তিনি ভারতের হয়ে খেলেছেন একদিনের ক্রিকেটেও। আইপিএলের প্রথম সিজ়নে রাজস্থান রয়্যালসের হয়ে ২১ বলে ৫০ রান করে রেকর্ড গড়েছিলেন। তিনটি ফ্র্যাঞ্চাইজ়ির হয়ে ক্রোড়পতি লিগে খেলেছেন— রাজস্থান রয়্যালস, কেকেআর এবং সানরাইজ়ার্স হায়দরাবাদ। তবে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে কলকাতারই ছিলেন। পাঠানের আন্তর্জাতিক কেরিয়ার খুব বড় নয়। কিন্তু যত দিন খেলেছেন, মাতিয়ে দিয়েছেন ক্রিকেটামোদীদের।
বিশ্বকাপ এবং বিশ্বকাপ
ইউসুফ হলেন রাজনীতিতে আগত সেই বিরল ক্রিকেটার, যাঁর ট্রফি ক্যাবিনেটে দু’টি বিশ্বকাপ রয়েছে। ২০ ওভার এবং ৫০ ওভার— দুই ফরম্যাটেই বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলেছেন। দু’টিই জিতেছেন। ২০১১ সালে ওয়াংখেড়েতে বিশ্বকাপ জয়ের পরে জাতীয় পতাকা বহনকারী সচিন তেন্ডুলকরকে কাঁধে করে ইউসুফের গোটা স্টেডিয়াম প্রদক্ষিণ করার ছবি দেশের বিশ্বজয়ের লোকগাথায় পাকাপাকি ঢুকে পড়েছে।
চুপকথা
খেলছিলেন শ্রীলঙ্কার ক্রিকেট লিগ। সেখান থেকে সটান কলকাতায়। বহরমপুরে কে তৃণমূলের প্রার্থী হচ্ছেন, তা গোপন রাখতে চূড়ান্ত সতর্কতা নেওয়া হয়েছিল। কলকাতার যে হোটেলে তাঁকে এনে তোলা হয়েছিল, সেখানেও নাকি তাঁর ঘর ‘বুক’ করা হয়েছিল অন্য নামে। ঠিক ছিল, ইউসুফকে চরম গোপনীয়তার সঙ্গে ব্রিগেড সমাবেশে নিয়ে আসা হবে। বাস্তবেও তার অন্যথা হয়নি। সমাবেশ চলাকালীন মঞ্চের পিছনে তাঁবুতে দলের ৪১ জন প্রার্থীর সঙ্গে বৈঠক করেন অভিষেক। সেখানে শুধু এক জন প্রার্থী ছিলেন না। ইউসুফ পাঠান। অন্য প্রার্থীদের সঙ্গে অভিষেকের বৈঠকের একেবারে শেষ পর্যায়ে কালো কাচ তোলা গাড়িতে ব্রিগেডের মাঠে আনা হয় ইউসুফকে। তত ক্ষণে বাকি প্রার্থীরা মঞ্চে উঠে গিয়েছেন।
প্রথম সব কিছু
বহরমপুরে ইউসুফকে দাঁড় করানোর গোপন অপারেশনের পিছনের মস্তিষ্ক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের। কিন্তু তাঁর সঙ্গে ইউসুফের প্রথম দেখা ব্রিগেডের মঞ্চের পিছনে একটি টেম্পো ট্র্যাভেলারে। প্রথম রাজনীতি। প্রথম ভোট। প্রথম অভিষেক। ধর্মতলার হোটেল থেকে একটি কালো এসইউভি-তে ইউসুফকে নিয়ে আসা হয়েছিল ব্রিগেডে। ট্র্যাভেলারের সমান্তরালে দাঁড় করানো সেই গাড়ির পিছনের সিট থেকে পাশের গাড়িতে উঠে যান ইউসুফ। কিছু ক্ষণের মধ্যেই সেই ট্র্যাভেলারে পৌঁছন অভিষেক। মিনিট পনেরোর একান্ত বৈঠক। তারও ঘণ্টাখানেক পরে মঞ্চে আবির্ভূত হন ইউসুফ। সেখান থেকে অন্য প্রার্থীদের সঙ্গে র্যাম্পে।
দশ ফুট বাই দশ ফুট
বাবা বরোদার জামা মসজিদের মোয়াজ্জেম। মসজিদ চত্বরের একটি কোনায় তাঁদের ঘর ছিল। একই ঘরে থাকতেন বাবা, মা, দুই ভাই এবং বোন। বাবা-মা এবং সন্তানদের মধ্যে দড়িতে ঝোলানো একটি পর্দার আব্রু। যে ঘরে শয়ন, সে ঘরেই রান্নাবান্না, খাওয়াদাওয়া। সঙ্গে একচিলতে শৌচাগার। সেই দশ ফুট বাই দশ ফুটের ঘর থেকে দেশের ক্রিকেট মহাকাশে দুই ভাইয়ের উড়ান। জীবন বদলে গেলেও শিকড়ের কথা ভোলেনি পাঠান পরিবার। বৃদ্ধ পিতা এখনও প্রতিদিন নিয়ম করে ওই মসজিদে যান। বলেন, ‘‘প্রতিদিন দেখি, কোথায় ছিলাম। কী ভাবে ছিলাম। আর এখন উপরওয়ালার দৌলতে কোথায় এসেছি!’’ সময়-সুযোগ পেলে যান ইউসুফও। কারণ, বাবা তাঁকে শিখিয়েছেন, শিকড়কে ভুললে চলবে না।
ভাইজান
দু’বছরের ছোট ভাই ইরফান তাঁর চার বছর আগে ভারতীয় দলে খেলা শুরু করেন। পরে দু’ভাই একসঙ্গে খেলেছেন দেশের হয়ে। ইউসুফ এখন ৪১। ইরফান ৩৯। দু’ভাইয়ের ক্রিকেট অনুশীলন নিয়ে অতীতে পরিবারকে অনেক অভিযোগ শুনতে হয়েছে। মসজিদের গলিতে দড়িতে বল ঝুলিয়ে ‘নক’ করতেন দুই ভাই। মসজিদে যাঁরা নমাজ পড়তে আসতেন, তাঁদের অনেকে ব্যাট-বলের ঠক-ঠক আওয়াজ নিয়ে ঘোর অসন্তুষ্ট হতেন। একটা সময়ে ইউসুফদের বাবাকে মসজিদ থেকে উঠে যেতেও বলেছিলেন তাঁরা। কিন্তু মাথা গোঁজার আর ঠাঁই কোথায়! এখন বৃদ্ধ পাঠান বলেন, ‘‘সেই মানুষগুলোই পরে দুই ভাইয়ের খেলা দেখার জন্য আমার কাছে টিকিটের আবদার করতেন।’’
বাউন্সার!
শর্ট বলের বিরুদ্ধে ক্রিজ়ে কখনও-সখনও একটু নড়বড়ে দেখিয়েছে ইউসুফকে। বাউন্সার ‘হুক’ করার চেয়ে ‘ডাক’ করেছেন বেশি। জীবনেও এক বার বাউন্সার এসেছিল। ভাই ইরফান মহিলামহলে দাদা ইউসুফের চেয়ে বরাবর বেশি জনপ্রিয়। ইরফান প্রেমপত্র পেতে শুরু করেন বয়স পনেরো পেরোনোর আগে থেকেই। সেটা জানত পাঠান পরিবারও। তার মধ্যেই আচমকা শর্ট বল! মা পরিবারের সকলকে এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে একটা কাগজ বার করে বলেছিলেন, ‘‘এখন আমার বড় ছেলেও প্রেমপত্র পাচ্ছে!’’ তখন ইউসুফের বয়স কুড়ি। সে বাউন্সারও অবশ্য ‘ডাক’ করেছিলেন ইউসুফ।
স্বাস্থ্য থেকে জীবনসম্পদ!
চোট-আঘাতে ২০১১ সালে ‘আনফিট’ হয়ে পড়েন ইউসুফ। যে কোনও পেশাদার ক্রীড়াবিদের মতোই গিয়েছিলেন ফিজ়িয়োথেরাপিস্টের কাছে। মুম্বইয়ের তরুণী আফরিন ‘ফিট’ করে তোলেন ইউসুফকে। স্বাস্থ্যের চিকিৎসার পাশাপাশি মনেরও আদানপ্রদান চলছিল। ২০১৩ সালের এপ্রিলে আফরিন বেগম হন ইউসুফের। প্রথম বিবাহবার্ষিকীর দিন জন্ম তাঁদের প্রথম পুত্র আয়ানের। ২০১৯ সালে দ্বিতীয় পুত্র রিয়ানের জন্ম।
তোতাকাহিনি
ছোটবেলায় চড়াই পাখির বাচ্চাকে পড়ে থাকতে দেখলে দানা খাইয়ে শুশ্রূষা করতেন ইউসুফ। পায়রা জখম হলে ক্ষতস্থানে মলম লাগিয়ে পরিচর্যা করতেন। সেই থেকেই তাঁর পাখির নেশা। এখন ইউসুফের খামারবাড়িতে একশোরও বেশি পাখি রয়েছে। আছে গরু, ছাগল, ঘোড়া। অনেকে রসিকতা করে যে খামারবাড়িকে ‘চিড়িয়াখানা’ বলেন। আর ইউসুফ যে খামারের মাটিতে খালি পায়ে হাঁটেন। বলেন, ‘‘মাটিতে হাঁটতে ভাল লাগে। মাটি থেকে জন্ম আমাদের। মাটিতেই তো মিশে যেতে হবে একদিন!’’
কেম ছো?
তিনি গুজরাতের মানুষ। সহ-গুজরাতি হিসেবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে নিয়ে তিনি গর্বিত। বাঁধা গতের রাজনৈতিক বিরোধিতার পথে না-হেঁটে ইউসুফ বলেন, মোদী একসময় গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। এখন তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী। ইউসুফ বলেন, যিনিই দেশের নাম উজ্জ্বল করুন, তিনি গুজরাতি, মরাঠি হোন বা বাঙালি, দেশবাসীর তাঁকে নিয়ে গর্বিত হওয়া উচিত।
রেখাচিত্র: সুমন চৌধুরী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy