Advertisement
১৯ জানুয়ারি ২০২৫
RG Kar Case Verdict

পোশাক বাজেয়াপ্তে দেরি কেন, প্রমাণ লোপাটের চেষ্টা সন্দীপদের? শাস্তির পরেও অধরা যে সব উত্তর

আরজি করের ঘটনায় তথ্যপ্রমাণ লোপাটের অভিযোগ তুলেছিলেন অনেকেই। সিবিআইও সেই অভিযোগ উড়িয়ে দেয়নি। বরং সেই অভিযোগেই গ্রেফতার হন সন্দীপ ঘোষ এবং অভিজিৎ মণ্ডল।

আরজি কর মামলায় ধৃত সন্দীপ ঘোষ ও অভিজিৎ মণ্ডলের বিরুদ্ধে প্রমাণ লোপাটের চেষ্টার অভিযোগ তুলেছিল সিবিআই।

আরজি কর মামলায় ধৃত সন্দীপ ঘোষ ও অভিজিৎ মণ্ডলের বিরুদ্ধে প্রমাণ লোপাটের চেষ্টার অভিযোগ তুলেছিল সিবিআই। গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।

আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ১৯ জানুয়ারি ২০২৫ ১১:০২
Share: Save:

আরজি করে মহিলা ডাক্তারের ধর্ষণ-খুনের ঘটনায় মূল অভিযুক্ত সঞ্জয় রায়কে দোষী সাব্যস্ত করেছে আদালত। কিন্তু সেই রায় সমস্ত বিতর্কে পূর্ণচ্ছেদ টানতে পারেনি। কিছু প্রশ্নের উত্তর এখনও অধরা। ৯ অগস্টের ঘটনার পরে তথ্যপ্রমাণ লোপাটের অভিযোগ তুলেছিলেন অনেকেই। খোদ সিবিআইও সেই অভিযোগ উড়িয়ে দেয়নি। বরং ওই অভিযোগেই তারা গ্রেফতার করেছিল আরজি করের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ এবং টালা থানার প্রাক্তন ওসি অভিজিৎ মণ্ডলকে। পরে সিবিআই চার্জশিট দিতে না-পারায় ওই মামলায় তাঁরা দু’জনেই জামিন পেয়ে গিয়েছেন (আর্থিক তছরুপের মামলায় সন্দীপ অবশ্য এখনও জেলে)।

আরজি করে নিহত চিকিৎসকের দেহ উদ্ধারের পরদিনই মূল অভিযুক্ত সঞ্জয়কে গ্রেফতার করেছিল কলকাতা পুলিশ। ১০ অগস্ট থেকে পুলিশের একাধিক আচরণ, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এবং রাজ্য সরকারের কিছু পদক্ষেপে বিতর্ক বাড়ে। সঞ্জয়ের সাজা ঘোষণার পরেও সেই প্রশ্নগুলি রয়েই গিয়েছে।

সিবিআইয়ের ভূমিকা

ধর্ষণ-খুনের ঘটনায় সন্দীপ এবং অভিজিতের বিরুদ্ধে রিপোর্টে সিবিআই দাবি করে, তাঁরা তদন্তের মোড় ঘোরাতে চেয়েছিলেন। সঞ্জয়ের গ্রেফতারির পরেও তাঁর পোশাক এবং অন্যান্য জিনিসপত্র বাজেয়াপ্ত করতে দু’দিন অতিরিক্ত সময় নিয়েছিল পুলিশ, দাবি করেছিল সিবিআই। এখনও সেই সংক্রান্ত চার্জশিট দেয়নি তদন্তকারী সংস্থা। কেন বেশি সময় লাগল, সেই প্রশ্ন থেকেই গিয়েছে।

বিনীতের ‘ব্লান্ডার’

সঞ্জয়কে গ্রেফতারের পর কলকাতার তৎকালীন পুলিশ কমিশনার বিনীত গোয়েল সাংবাদিকদের জানান, তিনিই মূল অভিযুক্ত। কিন্তু ধৃতের পরিচয় জানতে চাইলে প্রশ্ন এড়িয়ে যান বিনীত। যদিও তত ক্ষণে চাউর হয়ে গিয়েছিল, ধৃত অভিযুক্ত কলকাতা পুলিশে কর্মরত সিভিক ভলান্টিয়ার! বিতর্ক জোরালো হয় সে দিন থেকেই। কেন সঞ্জয়ের পরিচয় আড়াল করতে চাইলেন বিনীত? আমজনতার নজরেও সেই থেকে ‘ভিলেন’ হিসাবে চিহ্নিত হয়ে গিয়েছিল বিনীতের পুলিশ। সেই সঙ্গে আরজি কর কর্তৃপক্ষ, বিশেষত সন্দীপের বিরুদ্ধে জনরোষ বাড়তে থাকে।

‘মনে হয় আত্মহত্যা’

নির্যাতিতার বাবার সঙ্গে আরজি কর কর্তৃপক্ষের কথোপকথনের অডিয়ো রেকর্ডিং প্রকাশ্যে এসেছিল। দেহ উদ্ধারের পর হাসপাতাল থেকে তাঁর বাড়িতে ফোন করা হয়। ভাইরাল অডিয়োয় শোনা গিয়েছিল এক মহিলাকণ্ঠ। তিনি নির্যাতিতার বাবাকে দ্রুত হাসপাতালে পৌঁছতে বলেছিলেন। কিন্তু তাঁর কন্যার কী হয়েছে, স্পষ্ট করে জানাননি। কখনও ওই মহিলাকে বলতে শোনা গিয়েছে, ‘‘আপনার মেয়ে খুব অসুস্থ, তাড়াতাড়ি চলে আসুন।’’ কখনও বলেছেন, ‘‘মনে হয় উনি সুইসাইড করেছেন।’’ ফোনে তাঁর কথায় এই ধরনের ‘অসঙ্গতি’ বিতর্ক আরও বাড়িয়ে দেয়। অভিযোগ, আসল ঘটনা ধামাচাপা দিতেই ফোনে সঠিক তথ্য দেওয়া হয়নি।

দেওয়াল ভাঙল কে!

১৩ অগস্ট জানা যায়, আরজি করের চার তলার সেমিনার হলের (যেখান থেকে দেহ উদ্ধার) পাশে একটি ঘরের দেওয়ালের একাংশ ভেঙে ফেলা হয়েছে। ধর্ষণ-খুনের অভিযোগের পরেও কেন ঘটনাস্থলকে ‘পর্যাপ্ত নিরাপত্তা’ দেওয়া হল না, কী ভাবে তার পাশের একটি দেওয়াল রাতারাতি ভেঙে ফেলা হল, সেই প্রশ্ন ওঠে। অনেকেই বলেন, তথ্যপ্রমাণ লোপাটের উদ্দেশ্যেই ওই ‘তৎপরতা’। কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া দেওয়াল ভাঙা সম্ভব নয়। এই সময়ে আরও একটি তত্ত্ব উঠে এসেছিল। অনেকে বলছিলেন, আদৌ ঘটনাস্থল সেমিনার হল নয়। পুরোটাই সাজানো। অন্য কোথাও ঘটনাটি ঘটিয়ে মহিলার দেহ এনে রাখা হয়েছে সেমিনার হলে।

জানতেন পড়ুয়ারাও

তবে ওই দেওয়াল ভাঙার কথা শুধু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষই নন, জানতেন পড়ুয়ারাও। হাসপাতালের ফুসফুস ও বক্ষরোগ বিভাগের তৎকালীন প্রধান অরুণাভ দত্ত চৌধুরী বলেছিলেন, ‘‘সেমিনার হলের কাছে একটি ঘর সংস্কারের কথা হয়েছিল। কী সংস্কার দরকার, আলোচনা করতে ছাত্রদের ডেকেছিলাম। তাঁদের সামনেই আলোচনা হয়েছে।’’ পূর্ত দফতরের আধিকারিকের সঙ্গে ডাক্তারি এবং নার্সিং পড়ুয়াদের উপস্থিতিতে ওই বৈঠক হয়। বৈঠকের নথিতে ডাক্তারদের স্বাক্ষরও ছিল। হাসপাতালের নথিতেই দেখা গিয়েছে, পরে ওই বৈঠকের বিষয়ে থানায় জানানো হয়। প্রশ্ন ওঠে, দেওয়ালের এতটা অংশ ভাঙার সুযোগ দেওয়া হল কেন? হাসপাতালের কর্মচারী, আধিকারিক এবং পড়ুয়ারাও অনেকে চার তলায় ছিলেন। দেওয়াল ভাঙা শুরু হওয়ার পরে কি শব্দ পাননি কেউ? কেন বাধা দেওয়া হল না?

রাতদখল এবং ভাঙচুর

তথ্যপ্রমাণ লোপাটের চেষ্টা নিয়ে সন্দেহ আরও জোরালো হয় ১৪ অগস্ট রাতে। আরজি করের ঘটনার প্রতিবাদে সে দিন রাস্তায় নেমেছিলেন কাতারে কাতারে মানুষ। সেই ‘নাগরিক মিছিল’ থেকেই হাসপাতালের একাংশে হামলা হয়। দুষ্কৃতীরা জরুরি বিভাগে ঢুকে ভাঙচুর করে। ভাইরাল অডিয়োয় ‘সেমিনার হলে চল’ রবও শোনা যায়। যদিও পুলিশ পরে জানায়, ঘটনাস্থল সুরক্ষিত রয়েছে। কিন্তু নাগরিক মিছিলের সুযোগ কাজে লাগিয়ে কারা, কেন আরজি করে তথ্যপ্রমাণ লোপাটের চেষ্টা করল, সেই প্রশ্ন থেকেই যায়।

সন্দীপের ইস্তফা ও সরকারের ভূমিকা

আরজি কর আন্দোলনের প্রথম পর্বেই চাপের মুখে ইস্তফা দিতে বাধ্য হন তৎকালীন অধ্যক্ষ সন্দীপ। কিন্তু সরকার তাঁকে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে অন্য হাসপাতালের দায়িত্বে পাঠায়। স্বাস্থ্য দফতরের এই সিদ্ধান্ত তীব্র সমালোচিত হয়। সন্দীপের বিরুদ্ধে উঠে আসে ‘প্রভাবশালী’ তত্ত্বও। অনেকেই বলতে শুরু করেন, আরজি করের ঘটনাস্থল থেকে তথ্যপ্রমাণ লোপাটে সন্দীপের মতো প্রভাবশালীর হাত থাকা অস্বাভাবিক নয়।

ময়নাতদন্তে দেরি কেন

প্রথম থেকেই আলোচনার কেন্দ্রে ছিল নির্যাতিতার দেহের সুরতহাল এবং ময়নাতদন্ত। ময়নাতদন্ত হয় ৯ অগস্ট সন্ধ্যায়। দেহ সৎকারের পর রাত পৌনে ১২টায় এফআইআর দায়ের করে পুলিশ। আদালতেও তাদের ভূমিকা সমালোচিত হয়। সেই সংক্রান্ত নথিতে দেখা গিয়েছে, ময়নাতদন্তের সময়ে জুনিয়র ডাক্তারদের প্রতিনিধিরাও উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের স্বাক্ষরও রয়েছে নথিতে। কেন এত বেশি সময় লাগল, এখনও তা রহস্য।

(ধর্ষণ বা শ্লীলতাহানির ঘটনায় যত ক্ষণ না অভিযুক্তকে ‘দোষী’ সাব্যস্ত করা হচ্ছে, তত ক্ষণ তাঁর নাম, পরিচয় প্রকাশে আইনি বাধা থাকে। আনন্দবাজার অনলাইন সেই নিয়ম মেনেই আরজি কর পর্বের প্রথম দিন থেকে অভিযুক্ত সঞ্জয় রায়ের নাম বা ছবি প্রকাশ করেনি। শনিবার আদালত তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করায় আমরা তাঁর নাম এবং ছবি প্রকাশ করা শুরু করছি।)

অন্য বিষয়গুলি:

Verdict RG Kar Rape and Murder Case RG Kar Medical College and Hospital Incident CBI Sealdah Court
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy