Advertisement
১৯ জানুয়ারি ২০২৫
RG Kar Case

বীর্য নয়, তা হলে ওই ১৫১ গ্রাম তরল নমুনায় কী আছে? রিপোর্ট পাওয়ার আগেই হয়ে গেল বিচার!

আরজি কর আন্দোলনের অন্যতম ‘মুখ’ চিকিৎসক সুবর্ণ গোস্বামী বলেছিলেন, ‘‘সতীচ্ছদা (হাইমেন)-র ভিতর থেকে ১৫০ গ্রামের বেশি লিকুইড স্যাম্পল পাওয়া গিয়েছে। এটা হয়তো রক্তমাখা বীর্য।’’

গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।

আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ১৯ জানুয়ারি ২০২৫ ০৯:৫৮
Share: Save:

আরজি করের নির্যাতিতার যোনি থেকে ১ গ্রামও বীর্য মেলেনি বলেই জানানো হয়েছে ফরেন্সিক রিপোর্টে। কিন্তু ময়নাতদন্তের রিপোর্টে ‘সাদা ঘন চটচটে তরল পদার্থ’ (হোয়াইট থিক ভিসিড ফ্লুইড)-সহ যে ১৫১ গ্রাম লিকুইড স্যাম্পল (তরল নমুনা) সংগ্রহের কথা জানানো হয়েছিল, তা আসলে কী, সেটি নির্দিষ্ট করে জানা গেল না মামলার রায় ঘোষণার দিনেও!

গত ৯ অগস্ট সকালে আরজি কর মেডিক্যাল কলেজের জরুরি বিভাগের চারতলার সেমিনার হল থেকে নির্যাতিতা চিকিৎসক পড়ুয়ার দেহ উদ্ধার হয়। সে দিন রাতেই হয় দেহের ময়নাতদন্ত। তার রিপোর্ট প্রকাশ্যে আসার পর আরজি কর আন্দোলনের অন্যতম ‘মুখ’ চিকিৎসক সুবর্ণ গোস্বামী বলেছিলেন, ‘‘সতীচ্ছদা (হাইমেন)-র ভিতর থেকে ১৫০ গ্রামের বেশি লিকুইড স্যাম্পল (তরল নমুনা) পাওয়া গিয়েছে। এটা হয়তো রক্তমাখা বীর্য।’’ শেষ পর্যন্ত যা হয়নি।

সুবর্ণের ওই মন্তব্য শোরগোল ফেলেছিল। এক জন চিকিৎসক হয়ে কী ভাবে তিনি ওই কথা বলতে পারেন, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছিল। কারণ, সাধারণ ভাবে একটি পুরুষ শরীর থেকে প্রতি বার বীর্যপাতে ১.৫-৫ মিলিলিটার বীর্য নিঃসরণ হতে পারে। অর্থাৎ, ঘটনাস্থলে ১৫০ মিলিলিটার বীর্য পেতে ধর্ষকের সংখ্যা অন্তত ৩০ জন হওয়া প্রয়োজন। শাসকদলের ঘনিষ্ঠেরা সমাজমাধ্যমে সুবর্ণকে ‘বিচিত্রবীর্য’ বলে কটাক্ষ করতে শুরু করেছিলেন।

পরবর্তী সময়ে ‘কেন্দ্রীয় ফরেন্সিক সায়েন্স ল্যাবরেটরি’ (সিএফএসএল) সংগৃহীত নমুনা পরীক্ষা করে রিপোর্ট জমা দিয়েছিল। সেই রিপোর্ট খতিয়ে দেখেছিল দিল্লির এমস-এর ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞ আদর্শ কুমারের নেতৃত্বাধীন ১১ সদস্যের বিশেষজ্ঞ দল ‘মাল্টি ইনস্টিটিউশনাল মেডিক্যাল বোর্ড’ (এমআইএমবি)। পাশাপাশি আরজি করে নির্যাতিতার ময়নাতদন্তের রিপোর্ট, ময়নাতদন্তের ভিডিয়োগ্রাফি, সুরতহালের রিপোর্টও দেখা হয়।

যোনিতে কেন মেলেনি বীর্য

আরজি কর-কাণ্ডের তদন্তকারী সংস্থা সিবিআইয়ের তরফে এমআইএমবি-কে রিপোর্ট সম্পর্কে মোট ৯টি প্রশ্ন করেছিল। তারই মধ্যে অন্যতম ছিল নির্যাতিতার যোনিতে বীর্যের চিহ্ন না মেলার বিষয়টি। বিশেষজ্ঞেরা যার তিনটি ‘সম্ভাব্য কারণ’ চিহ্নিত করেছিলেন। প্রথম, অপরাধী কন্ডোম পরে ধর্ষণ করেছিল। দ্বিতীয়, পুরুষাঙ্গের বদলে শরীরের অন্য কোনও অংশ (হতে পারে হাতের আঙুল) নির্যাতিতার যোনিপথে প্রবেশ করিয়েছিল। তৃতীয়, কোনও শক্ত, ভোঁতা অস্ত্রজাতীয় বস্তু যোনিতে জোর করে প্রবেশ করানো হয়েছিল।

‘বিচিত্রবীর্য’ সুবর্ণের প্রশ্ন

সরকারি চিকিৎসক সুবর্ণ অবশ্য গোড়াতেই কন্ডোম পরে ধর্ষণ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। আনন্দবাজার অনলাইনকে তিনি বলেছেন, ‘‘তা হলে হয় বলতে হয়, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করে এমনটা করা হয়েছে।’’ তাঁর অভিজ্ঞতা বলে, কন্ডোম পরে এমন নৃশংস অত্যাচার চালানোর ঘটনা নজিরবিহীন। এর পরেই তাঁর প্রশ্ন, ‘‘‘সাদা ঘন চটচটে তরল পদার্থ’-সহ যে ১৫১ গ্রাম লিকুইড স্যাম্পল সংগ্রহ করা হয়েছিল তা কী ভাবে এল? সেই পদার্থের পরিচয়ই বা কী?’’

রিপোর্ট বলছে যোনিতে বীর্য মেলেনি

সুবর্ণের বক্তব্য, সিএফএসএল তো এখনও ওই পদার্থের ‘রাসায়নিক বিশ্লেষণ’ (কেমিক্যাল অ্যানালিসিস) রিপোর্ট জমা দেয়নি। সেই রিপোর্ট প্রকাশ্যে এলে বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা দেওয়া যেতে পারে। সেই সঙ্গে তাঁর মন্তব্য, ‘‘আমি ১৫০ গ্রাম বীর্যের কথা কখনও বলিনি। আমি বলেছিলাম, ১৫০ গ্রামের, মোস্ট স্পেসিফিক্যালি (নির্দিষ্ট ভাবে) ১৫১ গ্রামের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। যার মধ্যে ‘সাদা ঘন চটচটে তরল পদার্থ’ পাওয়া গিয়েছে। মানে ময়নাতদন্তে যেমন লেখা হয়েছে— ‘হোয়াইট থিক ভিসিড ফ্লুইড’। আমি ওটাই বলেছিলাম যে, ওই তরল পদার্থের যদি ডিএনএ পরীক্ষা করা হয়, তা হলে তা বীর্য হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। আর যদি বীর্য হয়, ডিএনএ ম্যাচিং করলে বোঝা যাবে, দলবদ্ধ ধর্ষণ হয়েছে কি না।’’

আনন্দবাজার অনলাইনের হাতে ময়নাতদন্তের যে রিপোর্ট এসেছিল, তাতে কোথাও ‘সিমেন’ শব্দের উল্লেখ ছিল না। লেখা ছিল, নির্যাতিতার ‘এন্ডোসার্ভিক্যাল ক্যানাল’ থেকে ‘সাদা ঘন চটচটে তরল পদার্থ’ সংগ্রহ করা হয়েছে। তবে সেই তরল কী, তার উল্লেখ ছিল না রিপোর্টে। ‘এক্সটার্নাল অ্যান্ড ইন্টারনাল জেনিটালিয়া’ কলামে লেখা ছিল ওজন ‘১৫১ গ্রাম’। নিয়ম হল, ময়নাতদন্তের রিপোর্টে মৃতদেহের বিভিন্ন অংশের ওজন উল্লেখ করা হয়। এ ক্ষেত্রেও তা-ই করা হয়েছিল।

কিন্তু নির্যাতিতার যোনিতে ওই পদার্থ কোথা থেকে এল, সেই প্রশ্ন তুলেছেন সুবর্ণ। তিনি বলেন, ‘‘তবে কি শক্ত, ভোঁতা অস্ত্রজাতীয় কোনও বস্তু দিয়ে ওই ঘন তরল পদার্থ নির্যাতিতার যোনিতে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল?’’ পাশাপাশিই তাঁর মন্তব্য, ‘‘নির্যাতিতার শরীরে সঞ্জয় রায় ছাড়াও অন্য পুরুষ ও নারীর ডিএনএর উপস্থিতি মিলেছে। কিন্তু তা শনাক্ত না হওয়ায় রিপোর্টে সেগুলিকে ‘কন্টামিনেটেড’ (দূষিত) বলা হয়েছে। আরজি করের ঘটনায় সঞ্জয় রায় ছাড়া অন্য কাউকে গ্রেফতার (সরাসরি নির্যাতনে জড়িত থাকার অভিযোগে) করা হয়নি। ফলে অন্য কোনও ডিএনএর নমুনাও সংগ্রহ করা যায়নি।’’

বীর্য এবং বিচার, বিভ্রাটের সম্ভাবনা?

নির্যাতিতার বাবা-মা চলতি মাসে শিয়ালদহ আদালতে ৫৭ পাতার লিখিত বক্তব্যে জানিয়েছিলেন, এমন ঘটনা কারও পক্ষে একা ঘটানো সম্ভব নয়। তার আগে কলকাতা হাই কোর্টে তাঁরা নতুন করে তদন্তের দাবিতে যে আবেদন জানিয়েছিলেন, সেখানে বলেছিলেন, ‘১৫১ গ্রাম সাদা ঘন তরল পদার্থের উপস্থিতির উল্লেখ রয়েছে। যৌন নির্যাতনের সময় মাত্র এক জন উপস্থিত থাকলে কোনও ভাবে তা সম্ভব নয়। এর থেকে বোঝা যাচ্ছে, এ ক্ষেত্রে অন্তত ৮-১০ জনের প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল।’’

তরলের ‘চরিত্র’ নির্ধারণ না করেই আরজি কর-কাণ্ডের বিচার নিয়ে কি তা হলে সংশয় রয়ে গেল? সুবর্ণের জবাব, ‘‘না, তা মোটেই নয়। আমাদের সংবিধান বলে, হাজার অপরাধী ছাড়া পেয়ে যাক। কিন্তু এক জন নিরপরাধও যাতে সাজা না পায়। মাননীয় বিচারক যে রায় ঘোষণা করেছেন, আইনের মানদণ্ডে নিঃসংশয় হয়েই করেছেন।’’

(ধর্ষণ বা শ্লীলতাহানির ঘটনায় যত ক্ষণ না অভিযুক্তকে ‘দোষী’ সাব্যস্ত করা হচ্ছে, তত ক্ষণ তাঁর নাম, পরিচয় প্রকাশে আইনি বাধা থাকে। আনন্দবাজার অনলাইন সেই নিয়ম মেনেই আরজি কর পর্বের প্রথম দিন থেকে অভিযুক্ত সঞ্জয় রায়ের নাম বা ছবি প্রকাশ করেনি। শনিবার আদালত তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করায় আমরা তাঁর নাম এবং ছবি প্রকাশ করা শুরু করছি।)

অন্য বিষয়গুলি:

RG Kar Rape and Murder Case RG Kar Medical College and Hospital Incident RG Kar Protest R G Kar Movement R G Kar Medical College and Hospital R G kar Incident
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy