চাকরিহারা শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীদের স্কুলে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এখনও কাউকে বরখাস্ত করা হয়নি, তা-ও জানিয়েছেন তিনি। মুখ্যমন্ত্রীর বার্তার পরে মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছে চাকরিহারা শিক্ষক, শিক্ষাকর্মীদের অন্দরে। অনেকেই চাইছেন স্কুলে যেতে। আবার এমনও অনেকে রয়েছেন, যাঁরা স্কুলে যেতে চাইছেন না। আবার কেউ সমবেত ভাবে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পক্ষে। সোমবার দুপুরে নেতাজি ইন্ডোরে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পরে চাকরিহারাদের কেউ কেউ আশ্বস্ত হয়েছেন। আবার অনেকে কেবল মৌখিক আশ্বাসে কিছুটা ধন্দে রয়েছেন। মমতার কথা শুনে চাকরিহারা শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীদের মধ্যে একাধিক প্রশ্ন এবং ভিন্ন মত রয়েছে।
মুখ্যমন্ত্রী আশ্বস্ত করেন, যোগ্যদের চাকরি নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের। চাকরিহারাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘‘আপনারা কি এখনও বরখাস্তের নোটিস পেয়েছেন? চাকরি করুন না। স্বেচ্ছায় সকলেই কাজ করতে পারেন।’’ তিনি আরও বলেন, “আমরা দু’মাসের মধ্যেই বিকল্প ব্যবস্থা করে দেব। যোগ্যদের কারও চাকরি বাতিল হবে না।” তাঁর বক্তব্য, মানবিকতার খাতিরে সুপ্রিম কোর্ট রাজ্য প্রশাসনের হাতে যোগ্য-অযোগ্যের তালিকা তুলে দিক। তবে চাকরিহারাদের প্রশ্ন, স্কুলে তো না-হয় গেলাম। কিন্তু বেতনের কী হবে! তাঁরা এখনও বরখাস্ত হননি, তবে বেতন কি আগের মতোই পাবেন? তা ছাড়া, এই ব্যবস্থা কত দিনের জন্য চলবে, স্থায়ী সমাধান কী রয়েছে, তা নিয়েও ধোঁয়াশা রয়ে গিয়েছে চাকরিহারাদের একাংশের মনে। যোগ্য-অযোগ্যদের তালিকা সুপ্রিম কোর্ট দেবে, না স্কুল সার্ভিস কমিশনের দেওয়া উচিত, তা নিয়েও ধন্দ তৈরি হয়েছে শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং শিক্ষাকর্মীদের একাংশের মনে।

নেতাজি ইন্ডোর থেকে বেরোনোর পরে অনেকেই জানাচ্ছেন, তাঁরা স্কুলে যেতে চান, যাবেনও। কিন্তু স্কুলে গেলে কি তাঁরা বেতন পাবেন, না কি শুধুই স্বেচ্ছাশ্রম? আর্থিক এই বিষয়টি নিয়েও তাঁরা চিন্তিত। নদিয়ার পলাশি থেকে মুখ্যমন্ত্রীর কথা শুনতে এসেছিলেন চাকরিহারা মহম্মদ মুর্শিদ বিশ্বাস। তিনি মুর্শিদাবাদের এক স্কুলে চাকরি পেয়েছিলেন। মমতার আশ্বাসের পরে তিনি বলেন, “আমরা শিক্ষক ছিলাম। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে আমরা শিক্ষক নেই। মৌখিক কথায় কোনও বিশ্বাস নেই। আজ এক, কাল অন্য এক হয়ে যেতে পারে!” আগামিকাল থেকে স্কুলে যাবেন কি না, তা নিয়ে প্রশ্নে বললেন, “স্কুলে তো অবশ্যই যাব। ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্টে বেতন ঢুকলে, আমরা তো নেব। আমরা তো বলছি না যে নেব না।” তবে একই সঙ্গে তিনি চান, আইনগত ভাবে তাঁদের চাকরি সুনিশ্চিত করুন মুখ্যমন্ত্রী।
যদিও কিছু ব্যতিক্রমে স্বরও রয়েছে। যেমন চাকরিহারা মেহেবুব মণ্ডলের দাবি, “যোগ্য এবং ভলান্টিয়ারি— দু’টি পৃথক শব্দ। আমরা যোগ্য। আমরা কোনও চুক্তিভিত্তিক চাকরির সুবিধা গ্রহণ করতে চাই না। রাস্তাই আমাদের আসল জায়গা। আমরা এখনই স্কুলে যাব না। অযোগ্যদের নিয়ে আমরা কোনও রকম কম্প্রোমাইজ় করব না।” আবার একাংশের শিক্ষক-শিক্ষিকার বক্তব্য, তাঁরা শহিদ মিনার প্রাঙ্গণে নিজেদের মধ্যে বৈঠক করে একত্রিত ভাবে সিদ্ধান্ত নেবেন।
দক্ষিণ ২৪ পরগনার সোনারপুর থেকে আসা প্রতাপ রায়চৌধুরীও জানালেন তিনি স্কুলে যাবেন। কিন্তু স্বেচ্ছাশ্রমে রাজি নন তিনি। প্রশ্ন শুনে বললেন, “বেতন পাই, কিসের স্বেচ্ছাশ্রম! প্রশ্নই ওঠে না। বরাখাস্তের নোটিস না-পাওয়া পর্যন্ত আমরা শিক্ষক।” মুখ্যমন্ত্রীর বার্তার পরে খুব একটা সন্তুষ্ট দেখাল না তাঁকে। তাঁর দাবি, রাজ্য সরকার একটি নোটিস জারি করে জানাক, যাঁদের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ নেই তাঁদের চাকরিতে পুনর্বহাল করা হল। স্কুলে যাওয়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী তো বলেই দিলেন, কাল থেকে স্কুলে যেতে। আমরা তো স্কুলে যাবই। কারণ আমরা নিজেদের যোগ্য বলে মনে করি।”
পশ্চিম মেদিনীপুরের খড়্গপুর থেকে নেতাজি ইন্ডোরে এসেছিলেন সরোজ ভুঁইয়া। ২০১৬ সালের প্যানেলে শিক্ষাকর্মী হিসাবে চাকরি পেয়েছিলেন। গত বছর মস্তিস্কে স্ট্রোকের কারণে তাঁর শরীরের ডান দিক সম্পূর্ণ পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে যায়। এখন কথা বলতে পারেন না তিনি। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে চাকরি গিয়েছে তাঁরও। মুখ্যমন্ত্রীর কথা শুনতে হুইল চেয়ারে বসিয়ে সরোজকে নিয়ে নেতাজি ইন্ডোরে এসেছিলেন তাঁর স্ত্রী রুপালি। কিন্তু দম্পতির দাবি, সে ভাবে কোনও আশার আলো দেখতে পেলেন না তাঁরা।
চাকরিহারাদের অনেকে আবার মুখ্যমন্ত্রীর বার্তার পরে কিছুটা আশার আলো দেখতে শুরু করেছেন। নদিয়ার তেহট্ট থেকে আসা মধুমঙ্গল রায় মুখ্যমন্ত্রীর আশ্বাসে কাজে ফিরতে চান। স্কুলে যাবেন কি না প্রশ্নে উত্তর এল, “অবশ্যই। স্কুলে পরীক্ষা চলছে। আগামিকালই আমরা স্কুলে যোগ দেব।” মধুমঙ্গল জানালেন, যে আশা নিয়ে তিনি মুখ্যমন্ত্রীর কথা শুনতে এসেছিলেন, তাতে তিনি সন্তুষ্ট।
সোমবার দুপুরে নেতাজি ইন্ডোরের মঞ্চে মুখ্যমন্ত্রীর সামনে একে একে নিজেদের দাবি পড়ে শোনান চাকরিহারা শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীরা। তাঁদের দাবি, সুপ্রিম কোর্টে রিভিউ পিটিশন দিতে হবে এবং পুনর্বিবেচনা প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে। পুনর্বিবেচনা প্রক্রিয়া সম্পন্ন না-হওয়া পর্যন্ত কাউকে চাকরি থেকে বরখাস্তের চিঠি দেওয়া যাবে না। তাঁদের আরও বক্তব্য, যে বিচারপতি রায় দিয়েছেন, তাঁর বেঞ্চে রিভিউ পিটিশন দাখিল করা যাবে না। পুনর্বিবেচনা প্রক্রিয়া শেষ না-হওয়া পর্যন্ত তাঁরা যেখানে চাকরি করছেন, সেখানেই তাঁদের স্বমহিমায় বহাল রাখতে হবে। এই সময়ের মধ্যে নতুন করে পরীক্ষার কোনও বিজ্ঞপ্তি জারি করা যাবে না। চাকরিহারারা এ-ও জানিয়েছেন, তাঁরা পরীক্ষা পদ্ধতির মধ্যে যেতে চাইছেন না। তাঁদের আরও দাবি, সুপ্রিম কোর্টের রায়ে, সিবিআইয়ের নথিতে যোগ্য এবং অযোগ্যের ভাগাভাগি রয়েছে। যোগ্যদের পরিচ্ছন্ন তালিকা নিয়ে রিভিউ প্রক্রিয়ায় যেতে হবে। এই পরিস্থিতি নিয়ে সর্বদল বৈঠক ডাকার জন্যও সরকারকে অনুরোধ করেছেন তাঁরা। চাকরিহারাদের বক্তব্য, তাঁরা দক্ষ আইনজীবীর অভাব বোধ করেছেন। তাই তাঁদের এক জন দক্ষ আইনজীবীর ব্যবস্থা করে দেওয়া হোক।
- ২০১৬ সালের এসএসসিতে নিয়োগের পুরো প্যানেল বাতিল করল সুপ্রিম কোর্ট। বলল, পুরো প্রক্রিয়ায় কারচুপি করা হয়েছে। ওই নিয়োগপ্রক্রিয়ার কোনও বিশ্বাসযোগ্যতা নেই।
- এসএসসি-র শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল। কলকাতা হাই কোর্ট এই সংক্রান্ত শুনানির পর ২০১৬ সালের সম্পূর্ণ নিয়োগপ্রক্রিয়াই বাতিল করে দিয়েছিল।
- রাজ্যের ২৬ হাজার চাকরি (আদতে ২৫,৭৫২) বাতিল করে প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খন্না এবং বিচারপতি সঞ্জয় কুমারের বেঞ্চ জানিয়েছে, তিন মাসের মধ্যে নতুন নিয়োগপ্রক্রিয়া শুরু করতে হবে।
-
আপাতত চাকরি ফিরল, তবে চিন্তামুক্ত হতে পারছেন না শিক্ষক-শিক্ষিকারা, সুপ্রিম রায়ে স্বস্তি দেখছে মমতার সরকার
-
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের পরে স্কুলে ফিরতে চান অবস্থানরত শিক্ষকেরা, একই সঙ্গে জিইয়ে রাখতে চাইছেন আন্দোলনও
-
স্কুলে ফিরছেন চাকরিহারা শিক্ষকেরা, চলতি বছরের শেষে নতুন করে পরীক্ষা নিয়ে নিয়োগের নির্দেশ
-
‘একটা স্বস্তি হলে তার উপর ভবিষ্যতের স্বস্তি নির্ভর করে’, শিক্ষকদের একাংশের প্রসঙ্গে সুপ্রিম-নির্দেশ নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী
-
দিল্লিতে শেষ হল চাকরিহারাদের অবস্থান, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীকে স্মারকলিপি দিয়ে কলকাতার পথে