Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪
Bolpur

Bolpur: দেবেন্দ্রনাথের হাত ধরে ব্রাহ্ম উপাসনার পীঠস্থান হয়ে ওঠা বোলপুরের এই বাড়ি এখন ‘ভুতুড়ে’

সিংহবাড়ির সদস্যেরা দেবেন্দ্রনাথকে ‘গুরুদেব’ বলে ডাকতেন। তাঁর হাত ধরেই কলকাতার বাইরে ব্রাহ্ম উপাসনার পীঠস্থান হয়ে ওঠে এই বাড়ি।

দেবেন্দ্রনাথের স্মৃতি বিজড়িত বাড়ি এখন ধ্বংসস্তূপ।

দেবেন্দ্রনাথের স্মৃতি বিজড়িত বাড়ি এখন ধ্বংসস্তূপ। —নিজস্ব চিত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
বোলপুর শেষ আপডেট: ১৪ জুন ২০২১ ১৯:৪৬
Share: Save:

সময়ের ঘষা লেগে ফিকে হয়ে গিয়েছে জৌলুস। অবশিষ্ট যা পড়ে রয়েছে, তা খানাখন্দে ভরা ইতিহাস। শান্তিকেতনে আশ্রম প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা ছিল বোলপুরের রায়পুর জমিদারবাড়ির। কিন্তু এত বছর পর সেই বাড়ি নিয়ে আর মাথাব্যথা নেই সরকার বা বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের। তাই ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক থাকা ওই বাড়ি রক্ষণাবেক্ষণের দাবিতে এ বার সরব হলেন স্থানীয়রাই। তাঁদের দাবি, প্রাসাদোপম বাড়িটির যেটুকু অবশিষ্ট রয়েছে, সেটুকু রক্ষণাবেক্ষণ করা হোক। গড়ে তোলা হোক সংগ্রহশালা।

বোলপুরের এই জমিদারবাড়ির বয়স প্রায় ২৫০ বছর। প্রশাসনিক নথি ঘাঁটলে দেখা যাবে, প্রথম ১৫০ বছর এই বাড়ি বাসযোগ্য ছিল। ১৭৪০ সালে চন্দ্রকোনা থেকে নিজের পরিবার এবং ১ হাজার তাঁতিকে নিয়ে বোলপুরে বসতি গড়েন জমিদার লালচাঁদ সিংহ। তার ঠিক ৪০ বছর পর, ১৭৮০ সালে লালচাঁদের ছেলে শ্যামকিশোর সিংহ জমিদারবাড়ি তৈরিতে হাত দেন। যে জমির উপর বাড়ি তৈরি হয়, সেটিকে নিয়ে আশপাশে প্রায় ৬০ থেকে ৭০ বিঘা জমি ছিল তাঁদের। তার মধ্যে পাঁচ থেকে ছ’টি পুকুর ছিল।

১৭৮৪ সালে আড়েবহরে আরও বাড়ানো হয় বাড়িটিকে। সেই সময় বোলপুরে এটাই একমাত্র চারতলা বাড়ি। বাইরের আক্রমণ থেকে বাঁচতে বাড়ির ভিতরে বানানো হয়েছিল সুড়ঙ্গপথও। আলাদা করে অন্দরমহলও বানানো হয়। পরবর্তী কালে এই বাড়ির সঙ্গে নিবিড় সংযোগ গড়ে ওঠে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের, যার নেপথ্যে ছিলেন জমিদার লালচাঁদ সিংহের পৌত্র শ্রীকণ্ঠ সিংহ। ১৮৫৫ থেকে ১৮৬৩ পর্যন্ত নিয়মিত ওই বাড়িতে যাতায়াত ছিল দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের। সিংহবাড়ির সদস্যেরা দেবেন্দ্রনাথকে ‘গুরুদেব’ বলে ডাকতেন। তাঁর হাত ধরেই কলকাতার বাইরে ব্রাহ্ম উপাসনার পীঠস্থান হয়ে ওঠে এই বাড়ি। সেখানে চারতলায় দেবেন্দ্রনাথের জন্য একটি ঘরও আলাদা করে সংরক্ষিত ছিল। যখনই যেতেন সেই ঘরেই থাকতেন দেবেন্দ্রনাথ।

 ‘খন্ডহর’ ছবির একটি দৃশ্যে জমিদারবাড়িতে নাসিরুদ্দিন শাহ এবং শাবানা আজমি।

‘খন্ডহর’ ছবির একটি দৃশ্যে জমিদারবাড়িতে নাসিরুদ্দিন শাহ এবং শাবানা আজমি। —ফাইল চিত্র।

রায়পুর জমিদারবাড়ির সঙ্গে দেবেন্দ্রনাথের সংযোগ খুঁজে পেয়েছেন গবেষকরাও। ৭০ দশকে ছাত্রাবস্থায় দেবেন্দ্রনাথের ওই ঘর নিয়ে গবেষণা করেন বিশ্বভারতীর প্রাক্তন উপাচার্য সবুজকলি সেন। ঘরের দেওয়ালে কিছু কিছু লেখা এবং দেবেন্দ্রনাথের স্বাক্ষর ছিল বলে জানান তিনি। কিন্তু বর্তমানে সে সবের লেশমাত্র নেই। ঘরটি এখন প্রায় ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয়েছে। দেবেন্দ্রনাথ-সহ বহু জ্ঞানীগুণী মানুষের আনাগোনা যেমন ছিল এই বাড়িতে, তেমনই এই বাড়ি থেকে একাধিক রত্নও বেরিয়ে এসেছেন। বিহার ও ওড়িশার প্রথম গভর্নর তথা ভারতীয় হিসেবে বাংলার প্রথম অ্যাডভোকেট জেনারেল এবং তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্য লর্ড সত্যেন্দ্রপ্রসন্ন সিংহের জন্মও এই বাড়িতেই, ১৮৬৩ সালে। যাঁর নামে কলকাতায় লর্ড এসপি সিনহা রোডের নামকরণ হয়েছে।

কিন্তু যে বাড়ি এক সময় বোলপুরের শিক্ষা-সংস্কৃতির পীঠস্থান হয়ে উঠেছিল, সেই বাড়ির লোকজন যত খ্যাতনামী হয়ে উঠতে শুরু করেন, ঘর ছেড়ে শহরে পাড়ি দেন, রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ততই জীর্ণ হতে শুরু করে বাড়িটি। তার পরেও ১৯৭৪ থেকে ’৭৬-এর মধ্যে এই বাড়িতেই ‘খন্ডহর’ ছবির শ্যুটিং সারেন পরিচালক মৃণাল সেন। এই বাড়িতেই শ্যুটিং করেন নাসিরুদ্দিন শাহ এবং শাবানা আজমি। ছবিটি যদিও শ্যুটিংয়ের ১০ বছর পর ১৯৮৪ সালে মুক্তি পায়। ছবির একটা বড় অংশ জুড়ে ছিল এই বাড়ি। কিন্তু এখন ইট-পাথরও কার্যত অদৃশ্য হওয়ার পথে।

ইট-পাথরও কার্যত অদৃশ্য হওয়ার পথে।

ইট-পাথরও কার্যত অদৃশ্য হওয়ার পথে। —নিজস্ব চিত্র।

এ নিয়ে রাজ্য সরকার তো বটেই বিশ্বভারতীর ভূমিকায় আক্ষেপ করছেন সিংহবাড়ির উত্তরাধিকারী বাদল সিংহ এবং সিদ্ধার্থ সিংহ। আইনজীবী মাণ্ডবী চৌধুরী জানিয়েছেন, তাঁর মক্কেল ক্যারোলিন সিংহও ওই বাড়ির উত্তরাধিকারী। রায়পুর যুবসঙ্ঘ ক্লাবের তরফে ইতিমধ্যেই বাড়িটি সংরক্ষণের জন্য আবেদন জানানো হয়েছে প্রশাসনের কাছে। কিন্তু অভিযোগ, শান্তিকেতনে আশ্রম প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা ছিল যে বাড়ির, সেটিকে সংরক্ষণ করা নিয়ে একেবারেই হেলদোল নেই কারও। ইতিহাসকে ধরে রাখতে বাড়ির অবশিষ্ট অংশকে মেরামত করে সংগ্রহশালা গড়ে তোলার দাবি জানাচ্ছেন তাঁরা। তাঁদের দাবি, সস্তা প্রচারের লোভে যে সে এসে বাড়িটিকে ভুতুড়ে বাড়ি বলে ইউটিউবে তুলে ধরছেন। বাড়িটিকে ঘিরে কুসংস্কার এবং মিথ্যা প্রচার দানা বাঁধছে। এখনই উদ্যোগী হলে বাড়িটির সঠিক ইতিহাস এবং তথ্য আগামী প্রজন্ম জানতে পারবে।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE