অযোধ্যার মন্দির এবং জয় শ্রীরাম ধ্বনির যুগে তিনি আজ বিস্মৃত। অথচ, বিশ শতকের শুরুতে তিনিই প্রথম সুদূর ইটালিতে বসে এক সন্দর্ভে বাল্মীকি এবং তুলসীদাসের রামায়ণের কাহিনিবিন্যাসের প্রতিতুলনা করে দেখান, তুলসীদাস তাঁর আখ্যান বাল্মীকির সংস্কৃত মহাকাব্য থেকে নিলেও তা একেবারে নিজস্ব সৃষ্টি। ভাষাশাস্ত্রের আলোয় সেই প্রথম ইউরোপে দুই রামায়ণের আলোচনা। প্রথম মহাযুদ্ধেরও আগে, ১৯১১ সালে ইটালিতে এই বই যখন ছেপে বেরোল। শ্রীরামচন্দ্র রাজনীতির হাতে অসহায় ক্রীড়নক হওয়ার ঢের আগেই ইউরোপ তাঁকে নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করেছে।
ইটালীয় তরুণ অতঃপর ভারতে এলেন। কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটিতে হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর অধীনে পুরনো পুঁথিসংগ্রহ ও সম্পাদনার কাজ। নেপালের বৌদ্ধ চর্যাগীতি নয়, তাঁর আগ্রহ রাজস্থানের প্রাচীন জৈন পুঁথিতে। কিন্তু সংগ্রাহকদের আনা এক পুঁথির পাঠ অন্যটির সঙ্গে মেলে না, অজস্র অসঙ্গতি। নিজেই চলে গেলেন বিকানের, জয়সলমের, জোধপুর অঞ্চলে।
রামচন্দ্রকে ছেড়ে মহাবীর এবং জৈন তীর্থঙ্করদের কাছে কেন? এ বিষয়ে তাঁর শিক্ষক, জৈন আচার্য বিজয় ধর্মসুরির প্রেরণা আছে। কাথিয়াবাড়ের বিজয় ধর্মসুরি স্কুল কলেজে প্রথাগত লেখাপড়া শেখেননি, কিন্তু জৈন শাস্ত্রে আধুনিক কালের অকম্প এক দীপশিখা। যশোবিজয় জৈন পাঠশালা নামে সারা ভারতে অনেক স্কুল তৈরি করেছিলেন, যশোবিজয় জৈন গ্রন্থাবলি নামে এক সিরিজ়ে পুরনো জৈন শাস্ত্র ও ব্যাকরণগ্রন্থ উদ্ধার করে একের পর এক টীকাটিপ্পনী-সহ সেগুলি জৈন-অজৈন সকলের মধ্যে প্রচার করেন। কলকাতায় এশিয়াটিক সোসাইটির সহযোগী সদস্য ছিলেন, আগ্রহী ইউরোপীয় পণ্ডিতেরা অনেকেই তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। বারাণসীর রাজা ধর্মসুরির পাণ্ডিত্যে মুগ্ধ, তাঁর উৎসাহে সেখানকার পণ্ডিতরা এই শ্বেতাম্বর জৈন সন্ন্যাসীকে ‘শাস্ত্রবিশারদ জৈনাচার্য’ শিরোপা দেন। বারাণসী মানে হিন্দু, আর গুজরাত-রাজস্থান মানে জৈন এলাকা— এই গোদা ধারণা একশো বছর আগেও ছিল না। প্রতিটি ধর্মই তখন পরস্পরের সঙ্গে সংলাপ, আলাপ-আলোচনা চালাত।
ওই জৈন পুঁথি খুঁজতে খুঁজতে ভারতীয় পুরাতাত্ত্বিক সর্বেক্ষণের প্রধান জন মার্শালের অনুরোধে রাজস্থানের মরুভূমিতে কালিবঙ্গান অঞ্চলে লুপ্ত ঘর্ঘরা-হক্কর নদীর অববাহিকায় ইটালীয় তরুণের খোঁড়াখুঁড়ি। সেখানকার মাটির জিনিসপত্র, কুয়ো দেখে তিনিই প্রথম আঁচ করেন যে, এর সঙ্গে আলেকজ়ান্ডারের ভারত আক্রমণের কোনও সম্পর্ক নেই। এটি বরং আরও প্রাচীন কোনও সভ্যতার পরিচায়ক। বিকানের দুর্গের কাছে আজও আছে ক্রুশকাঠচিহ্নিত তাঁর সমাধি।
পুরো নাম লুইজ়ি পিয়ো তেসিতোরি (ছবিতে বাঁ দিকে)। ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে জন্মেছিলেন উদিনে নামে এক শহরে। বাবা ছিলেন হাসপাতালের কর্মী, মায়ের সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। ছাপোষা পরিবারটির তিন কুলে কেউ দুঃসাহসী অভিযাত্রী ছিলেন না। এই বাড়ির ছেলে ফ্লোরেন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষা ও সাহিত্য পড়তে এসে ভারতীয় সংস্কৃতির প্রেমে পড়লেন। সংস্কৃত, পালি ও প্রাকৃত ভাষা শিখলেন। ভারত এই সময় মোটেও বিশ্বগুরু-টুরু নয়— কিন্তু রাজামহারাজা, জাদু এবং হাতির দেশটি নিয়ে ইউরোপে বেশ আগ্রহ ছিল। অষ্টাদশ শতকেই চন্দননগর থেকে সংস্কৃত ভাষার অভিধান অমরকোষ, উপনিষদ-সহ প্যারিসের লাইব্রেরিতে পাঠিয়ে দিয়েছেন এক ফরাসি যাজক। পলিনাস স্যাঙ্কটো বার্থোলোমিউ নামে এক যাজক ভারত থেকে রোমে নিয়ে এসেছেন সংস্কৃত ব্যাকরণের পুঁথি। সেখানেই ১৭৯০ সালে ছাপা হল সেটি। আধুনিক কালে সংস্কৃত ভাষায় প্রথম বইটি ভারতে নয়, ছাপা হয়েছিল রোমে।
ইউরোপ জুড়ে তখন ভারতীয় জ্ঞানকাণ্ডকে জানার প্রবল তরঙ্গ। ভারতীয় দর্শন, মহাকাব্য নিয়ে জার্মান দার্শনিক শোপেনআওয়ার লিখছেন, “ভারতীয় জ্ঞানই ইউরোপে আমাদের প্রথাসিদ্ধ চিন্তাধারাকে বদলে দিতে সক্ষম। উপনিষদ পাঠে যে শান্তি পেয়েছি, আমৃত্যু সে আমার সঙ্গী হয়ে থাকবে।” ফ্রান্সে ভিক্তর উগো, পিয়েরে লামার্তিনের মতো রোম্যান্টিক কবি ও লেখকরা তখন ধ্রুপদী চেতনার জন্য কেবল গ্রিক ও ল্যাটিন ঐতিহ্যে থামতে নারাজ। তাঁরা ভারতকে খুঁজছেন। মধ্যযুগে রেনেসাঁসের আবির্ভাবে ইউরোপ নজর ফিরিয়েছিল গ্রিসের দিকে। এ বার বাণিজ্য, ক্ষমতাবিস্তার, ছাপা বইয়ের সহজলভ্যতা সব মিলিয়ে ভারতের দিকে।
তেসিতোরি এই সময়ের সন্তান। ফ্লোরেন্সের পাঠাগারে তখন ভারত থেকে-আনা অজস্র পুঁথির অনুবাদ, ১৮৭০ সালে বারো খণ্ডে ইটালীয় ভাষায় বাল্মীকি রামায়ণের অনুবাদও সম্পূর্ণ। ফ্লোরেন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে তৈরি হয়েছে সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক পদ। তেসিতোরির কাণ্ড আসলে নতুন বিষয়ের প্রতি উন্মুখ এক ছাত্রের মেধাকীর্তি।
এই কীর্তিটাই নজর করলেন লিঙ্গুইস্টিক সার্ভে অব ইন্ডিয়ার প্রধান জর্জ আব্রাহাম গ্রিয়ারসন। মৈথিলী, ভোজপুরি থেকে বাংলা, কাশ্মীরি, গুজরাতি প্রতিটি ভাষা-ঐতিহ্যের দিকে তাঁর তীব্র নজর। এই গ্রিয়ারসনের নজরে এল ইটালীয় ভাষায় লেখা নিবন্ধটি। তিনি নিজে লেখাটি অনুবাদ করে এক ইংরেজি পত্রিকায় পাঠিয়ে দিলেন। তাঁর উৎসাহেই তেসিতোরি লন্ডনের ইন্ডিয়া অফিসে চাকরির দরখাস্ত পাঠান। জৈন শাস্ত্র ঘাঁটতে গিয়ে ইটালি থেকেই চিঠিতে বিজয় ধর্মসুরির সঙ্গে আলাপ। ১৯১৩ সালের জুলাই মাস থেকে পত্রালাপ শুরু। প্রথম চিঠিতে অচেনা ধর্মসুরিকে মহোদয় সম্বোধনে চিঠি লিখছেন ইটালীয়। তার পর দিন, মাস, বছর ঘুরেছে। সম্বোধন গুরুমহারাজে বদলে গিয়েছে।
এর মধ্যেই ইন্ডিয়া অফিস মঞ্জুর করে পাঠাল তাঁর আবেদন। কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটিতে যোগ দিতে হবে তেসিতোরিকে। ১৯১৪ সালে কলকাতায় পৌঁছলেন তেসিতোরি। স্বপ্নের দেশের গুরুকুলে এই তাঁর প্রথম পদার্পণ।
কয়েক মাস পরে নিজেই ট্রেনে চেপে রওনা হলেন রাজপুতানার দিকে। জয়পুর ছাড়িয়ে সিরোহির কাছে এরিনপুরা শহরের জৈন মঠে ধর্মসুরির সঙ্গে তেসিতোরির প্রথম সাক্ষাৎ। তেসিতোরি তখন রাজস্থানের চারণ, ভাটদের নিয়ে উটের পিঠে চড়ে মরুভূমির গ্রামে পুরনো রাজস্থানি ভাষার পাণ্ডুলিপি খোঁজেন, সহকারীদের সাহায্যে সেগুলি সযত্নে নকল করে রাখেন। কিন্তু বিনামেঘে বজ্রপাত! ইন্ডিয়া অফিস জানাল, মহাযুদ্ধের কারণে রাজস্থানে দেশীয় সাহিত্য খোঁজার এই প্রকল্পে তারা প্রস্তাবিত বাজেট বরাদ্দ করতে পারবে না। গবেষক বরং কোনও দেশীয় রাজ্যের সাহায্য নিন। জয়পুর, জোধপুর সকলে ফিরিয়ে দিল। রাজি হলেন শুধু বিকানেরের রাজা গঙ্গা সিংহ। শুরু হল নতুন অধ্যায়।
এশিয়াটিক সোসাইটিতে তাঁর বেতন যেত শিক্ষা দফতর থেকে। পরের বছর সরকার জানাল, মরুভূমিতে দেশীয় সাহিত্যে খোঁজাখুঁজি প্রকল্পের পুরো ব্যয়ভার শিক্ষা দফতর এই যুদ্ধ পরিস্থিতিতে নিতে পারবে না। প্রত্নতত্ত্ব দফতর এই দায়িত্ব নিক!
দফতরের প্রধান তখন স্যর জন মার্শাল। তেসিতোরির রামায়ণ-সন্দর্ভ তিনি জানতেন। ১৯১৬ সালে মার্শালের সরকারি নোট: এই গুরুত্বপূর্ণ কাজ বন্ধ করা অনুচিত। ভারতের আঞ্চলিক ভাষাগুলির প্রতি সাহেবদের এই রকমই মমত্ববোধ ছিল।
তেসিতোরির শিবির হল বিকানেরে। সেখানে কালিবঙ্গান অঞ্চলে মূর্তি, মুদ্রা, সিলমোহর, পাথুরে অস্ত্র ইত্যাদি মিলছিল। ১৯১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে তেসিতোরি দুই দফায় সেখানে গেলেন। দেখলেন, সিলমোহরের লিপিটি অচেনা। মার্শালকে পাঠানো ২০০ পৃষ্ঠার রিপোর্টে তাঁর সংশয়, “এগুলি আরও প্রাচীন, প্রাগৈতিহাসিক কোনও সভ্যতার অংশ হতে পারে।” পরিচিত বেদ-বেদান্ত, আর্য সভ্যতার বাইরে ভারতে যে একটা প্রাগৈতিহাসিক সভ্যতা থাকতে পারে, এই প্রথম আঁচ করল কেউ।
ইতিমধ্যে খবর এল, তাঁর মা অসুস্থ। তেসিতোরি ফিরলেন দেশে। কিন্তু স্বদেশেও তিনি অক্লান্ত। গ্রিয়ারসনকে সিলমোহরের ছবিগুলি পাঠালেন। তিনি নিশ্চয় বলতে পারবেন, ভাষাটা কী! গ্রিয়ারসনও ব্যর্থ হলেন। তিনি পরামর্শ দিলেন, ভারতে ফিরে তেসিতোরি যেন এশিয়াটিক সোসাইটির পত্রিকায় একটি বিশদ নিবন্ধ লেখেন। অন্য কোনও পণ্ডিত হয়তো আলো দেখাতে পারবেন।
মহাযুদ্ধ শেষে চার দিক এখন থিতু, ১৯১৯ সালের নভেম্বরে ইটালির ছেলে ফের চেপে বসলেন ভারতগামী জাহাজে। কালিবঙ্গান নিয়ে জানাতে হবে এশিয়াটিক সোসাইটির পণ্ডিতদের। নতুন উদ্যমে, অনেক রহস্যের তালাশ করার জন্য সাত-তাড়াতাড়ি কর্মভূমিতে ফিরছেন তিনি।
জাহাজেই অল্প জ্বর ছিল। ভারতে পৌঁছেও তা কমল না, উল্টে গলায় ব্যথা, অস্বস্তি। শ্বাস নিতেও কষ্ট! দিন কয়েক পর ২২ নভেম্বর বিকানেরে মারা গেলেন তিনি। স্প্যানিশ ইনফ্লুয়েঞ্জা!
এ দেশে সিন্ধু সভ্যতার অন্যতম নিদর্শন ওই কালিবঙ্গান। ইতিহাস থেমে থাকে না। শুধু অতিমারি এলোপাথাড়ি শিকার ছিনিয়ে নেয়। রামায়ণ-মহাভারত, সিন্ধু সভ্যতায় তার কিছু আসে যায় না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy