কখনও কখনও ‘বন্দুকের নলই শক্তির উৎস’ হয় বটে, তবে বোধ হয় চিরকালই বন্দুক বা তরোয়ালের থেকে কলমের ধার বা শক্তিই বেশি। সেই শক্তিই বিশ্বে কোথাও জনমত তৈরি করে বিপ্লবের আগুন উস্কে দেয়। কোথাও বা শাসকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী জন-আবেগকে ত্বরান্বিত করে দেশের সরকারের পতন ঘটায়। গান, কবিতা, প্রবন্ধ হোক কিংবা সংবাদ প্রতিবেদন— ধারালো লেখনীর সেই শক্তিকে তাই উপেক্ষা করা কঠিন। আর কঠিন বলেই সেই বিরুদ্ধ স্বরের কলমটিকে ভেঙে দিতে, গুঁড়িয়ে দিতে, এমনকি কলমধারীকে হত্যা করতেও কারও কারও হাত কাঁপে না। এবং বিরুদ্ধ স্বরের সে কলমটি যদি আবার কোনও নারীর হাতে ধরা থাকে, তা হলে অহরহ তাঁর চরিত্র হনন, দল বেঁধে তাঁর ধর্ষণ-সহ নানা যৌন হিংসা চলে। তাঁর হত্যায় মিশে যায় অত্যাচারীর বীভৎস উল্লাস।
দেখা গিয়েছে, পুরুষের মতো নারী সাংবাদিকের কলমও যদি সরকারি নীতি বা কাজের সমালোচনা করে, তবে যেন আক্রোশ বেড়ে যায়। যদি সেই কলম কোনও রাজনৈতিক নেতা, মন্ত্রী, ব্যবসায়ী, অথবা প্রশাসনিক কর্তাদের নানা দুর্নীতি আর অবৈধ কাজের সত্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা করে, তবে কলমধারীর উপর অমানুষিক লাঞ্ছনা-পীড়ন, এমনকি হত্যার খাঁড়াও নেমে আসে।
তা না হলে রাজনীতিবিদ ও বড় ব্যবসায়ীদের হাতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ফান্ড নয়ছয় হওয়ার খবর করতে গিয়ে, বছর ত্রিশের বুলগেরিয়ান সাংবাদিক ভিক্টোরিয়া মারিনোভাকে ধর্ষণ ও নৃশংস হত্যার শিকার হতে হত না। তা না হলে বার বার ধর্ষণ ও হত্যার হুমকি উপেক্ষা করে চলা ত্রিশের কোঠার আইরিশ রিপোর্টার ভেরোনিকা গেরিনকে ‘ড্রাগ লর্ড’-এর বিরুদ্ধে একাধিক খবর প্রকাশ করার দায়ে গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেওয়া হত না। এবং শাসকের সমালোচক হয়ে ওঠায়, রাশিয়ান সাংবাদিক আনা পলিৎকোভস্কায়া, মালটা’র ডাফনে কারুয়ানা গলিজ়িয়া, ভারতের গৌরী লঙ্কেশের মতো অসংখ্য মহিলা সাংবাদিকের রক্তে দেশ-বিদেশের মাটিও নিয়ত ভিজে উঠত না।
আসলে যে শব্দরা তাঁদের পছন্দ নয়, যা তাঁদের মতের বিরোধিতা করে, যে সব শব্দ অপকর্মের পর্দা ফাঁস করে তাঁদের মুখোশটি খুলে দেওয়ার চেষ্টা করে, একচ্ছত্র আধিপত্যের গতি রুখে দিতে চায়— যে ভাবেই হোক সেই বিরুদ্ধ শব্দদের থামাতে হবে। না পারলে চিরতরে বিনাশ ঘটাতে হবে তার। সেই বিনাশের পথ ধরেই কেবল ২০১০ থেকে ২০১৯, এই এক দশকে ইউনেস্কোর নথিভুক্ত তালিকা অনুযায়ী মহিলা সাংবাদিক-সহ বিশ্বের ৮৯৪ জন সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে। ভারতেও এই প্রবণতা ক্রমবর্ধমান।
রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস-এর প্রতিবেদন বলছে, পৃথিবীর যে পাঁচটি রাষ্ট্র সাংবাদিকদের কাছে ইদানীং খুবই বিপজ্জনক হিসেবে গণ্য হয়েছে, ভারত তাদের অন্যতম। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার সূচকেও বিশ্বে ভারতের স্থান ২০১৯-এর ১৪০ থেকে দু’ধাপ আরও নেমে গিয়ে ১৪২-এ। এখন দেখা যাচ্ছে যে, মেয়েরা যখন সংবাদ সংগ্রহের জন্য রাস্তায় নামছেন— বিশেষ করে সে খবর যদি সরকারি নীতির বিরুদ্ধে কোনও বিক্ষোভ সমাবেশ বা গণ আন্দোলনের অথবা রাজনৈতিক হিংসার বিরুদ্ধে হয়— তা হলে তাঁরা প্রায়শই ভয়াবহ শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।
যেমন গত বছর দিল্লিতে সাম্প্রদায়িক গোলমালের সময় শাসক দলের এক নেতাকে সেই বিষয়ে প্রশ্ন করেন টিভি সাংবাদিক পরবিনা পুরকায়স্থ। তাঁর উপর কুৎসিত অত্যাচার চালানো হয়। গত কয়েক মাস ধরে অনবরত ‘ধর্ষণ, অ্যাসিড হামলা ও হত্যার হুমকি’ পেয়েই চলেছেন দেশি বিদেশি পুরস্কারপ্রাপ্ত দিল্লির সাংবাদিক নেহা দীক্ষিত। তিনিও নানা লাঞ্ছনার শিকার হন। এবং সামাজিক ন্যায়, লিঙ্গ ও রাজনৈতিক বিষয়ে প্রিন্ট, টেলিভিশন ও অনলাইন মাধ্যমে তদন্তমূলক সাংবাদিকতায় বিরামহীন নেহার ফ্ল্যাট ভাঙচুর পর্যন্ত পৌঁছে যায় হামলাকারীর হাত।
বস্তুত, সাধারণ মহিলাদের মতো মহিলা সাংবাদিকদের প্রতিও হিংসার অভিযোগ ও এফআইআর নেওয়ায় পুলিশের অনীহা প্রকট। আসলে নিগ্রহকারী বা হত্যাকারীদের মাথার উপর প্রশাসনের এক অদৃশ্য হাত থাকে। তাই বোধ হয় প্রায়শই বিচারের কাঠগড়া পর্যন্ত তাঁদের যাওয়ার দরকারই পড়ে না। ভারতে তো ওই সাংবাদিক নিগ্রহকারী বা হত্যাকারীদের সাজা প্রায় আণুবীক্ষণিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ভাবেই তাঁদের নিরাপত্তা ধ্বস্ত হচ্ছে ক্রমাগত।
কিন্তু, পরিবার ও সমাজের শত প্রতিকূলতা সরিয়ে যখন এই মেয়েরা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে একেবারে অপরাধ জগতের কঠিন মাটিতে সত্য উদ্ঘাটনের জন্য এক বার পা বাড়ান, তখন তাঁদের লক্ষ্যে অবিচল রাখে অনমনীয় জেদ, দৃঢ়তা আর চরম আত্মবিশ্বাস। চরম হিংসা ও হত্যার হুমকিকেও হেলায় উপেক্ষা করার অসীম সাহসিকতা তাঁদের কাজ থেকে পিছু হটতে দেয় না।
দেয় না বলেই তাকে নিষ্ঠুরতম উপায়েও দমনের চেষ্টা হয়। সেই দমনের উৎসাহকে যেন মান্যতা দিতেই কখনও ফিলিপিন্সের লেডি অ্যান সালেম’কে ‘মিথ্যে কেস’-এ হাজতবাস, কখনও তামিলনাড়ুর অবৈধ বালির ব্যবসার খবর করার জন্য সন্ধ্যা রবিশঙ্করের বিরুদ্ধে ধর্ষণের হুমকি-সহ মানহানির মামলা চলে। কখনও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্না রানা আয়ুবের মতো সাংবাদিককেও ক্রমাগত প্রাণ কেড়ে নেওয়ার হুমকি সহ্য করতে হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও ভয়ে তাঁরা কেউই কলম নামিয়ে রাখছেন না?
পদে পদে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়েও কয়েক দশক ধরে সাংবাদিকতায় যুক্ত ফিলিপিনো-আমেরিকান সাংবাদিক মারিয়া রেসা। একদা প্রতি ঘণ্টায় ৯০টি ব্যক্তিগত বিদ্বেষ বার্তা পেতেন তিনি। সেই জন্যই তো বলতে পারেন, “আমরা সাংবাদিক। আমাদের ভয় দেখানো যাবে না। আলো জ্বালিয়ে সব দেখাব আমরা। যুদ্ধ জারি থাকবে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy