ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল
মরসুমের সবচেয়ে বেশি আকাশভাঙা বৃষ্টি।
যোধপুর পার্কে লেখকের ফ্ল্যাটের ডোরবেল টিপে ভাবছিলাম ঝড়-বৃষ্টি-বিদ্যুৎ-এর কানফাটানো শব্দে সে ঘণ্টাধ্বনি আদৌ শোনা যাবে কি না।
আশঙ্কা অমূলক। দরজা খুলল।
বৈঠকখানার দিকে এগোতেই প্রচণ্ড প্রকৃতি-গর্জন ছাপিয়ে ক্রমশ কানে এল ভক্তিগীতি, সুরেলা স্তোত্রপাঠ আর মন্ত্রোচ্চারণ।
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়।
খানিকক্ষণ পর পুজো সেরে স্যান্ডো গেঞ্জি আর লুঙ্গি পরে সামনে এসে যিনি বসলেন তাঁর জীবনযাপনে আ-যৌবন মিশে আছে আধ্যাত্মিকতার প্রতি টান। কিছুটা লেখাতেও। বইয়ের উৎসর্গপত্রে তো বটেই।
বয়স আশি পূর্ণ করার পথে, অথচ এক সদা-উৎসাহী সরল ছেলেমানুষি যেন আগাগোড়া খেলা করে বেড়ালো তাঁর গোটা আলাপচারিতা জুড়ে। কখনও কখনও তাই বিপজ্জনক ভাবে অকপট শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়।
পত্রিকা: শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় আসলে কে? কোন লেখার কোন চরিত্রটা? সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘আত্মপ্রকাশ’-এ কিছুটা ওঁকে পাওয়া যায়। কিন্তু আপনার কোনও উপন্যাসেই শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়কে চেনা খুব মুশকিল।
শীর্ষেন্দু়: ঠিকই, কারণ যখন আমি লিখি, আমি নিজেকে পুরোপুরি ভাবে ভুলে যেতে পারি। আমি তখন সেল্ফ ডিস্ট্র্যাক্ট।
পত্রিকা: সচেতন ভাবেই?
শীর্ষেন্দু: হ্যাঁ, একেবারে সচেতন ভাবে। আমার জীবনের ঘটনাগুলো স্তিমিত। জীবনটাকে ঘটনাবহুল বলা যাবে না। সুনীলের জীবনে, শক্তির জীবনে খানিকটা অ্যাডভেঞ্চার ছিল। ওদের গ্রুপটারই এটা ছিল।
পত্রিকা: আপনার নিস্তরঙ্গ গার্হস্থ্য সংসারী জীবন...
শীর্ষেন্দু: সেটা পরে। কিন্তু তার আগেও আমি অনেক লো-প্রোফাইল জীবন কাটিয়েছি। আমি নিজেকে প্রোজেক্ট করতে পারিনি কখনও। মনে হয়েছে আমার মধ্যে প্রোজেক্ট করার মতো নেই কিছু । তবে আমার ভাবনা-চিন্তাগুলোর মধ্যে আমার কিছুটা এসেছে ধীরে ধীরে। কৃষ্ণজীবনের চরিত্রটা, বা তারপর ‘ঘুণপোকা’-র শ্যামের মধ্যে আমার জীবনের কিছুটা প্রজেকশন আছে। তাও পুরোটা নেই, খানিকটা, আংশিক। আমার জীবনযাপনটাকে আমি মোটেই খুব একটা রিফ্লেক্টেড হতে দিইনি আমার লেখায়। তবে ‘উজান’ উপন্যাসটায় আমার বাল্যকালের কথা আছে। অনেকটা, পুরোটা নয়। ওর মধ্যে অনেক কাল্পনিক চরিত্র আছে, অনেক ঘটনা আছে, আবার যে মানুষগুলোকে কাছ থেকে দেখেছি তাদের কথা আছে। লেখকের রান্নাঘরে যেমনটা হয় আর কী।
পত্রিকা: ছোটবেলার আত্মজীবনী না হয় বুঝলাম, কিন্তু সুনীলদার একটা ‘অর্ধেক জীবন’ পেয়েছি, আপনার তো কোয়ার্টার জীবনও পেলাম না!
শীর্ষেন্দু: (হাসি) অনেকেই আমাকে বলেন, ‘কেন আপনি লিখছেন না?’ আসলে আমি খুব গেঁতো-অলস লোক। প্রকাশক তো আমায় মাঝে মাঝে ধরে জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনার মাথায় পিস্তল না ধরলে কি আপনি লিখতে পারেন না?’ আমি বলি, ‘যা বলেছেন এক্কেবারে ঠিক বলেছেন। আমি খানিকটা পয়েন্ট অব নো রিটার্ন-এ যখন যাই, তখন তেড়েফুঁড়ে লিখতে বসি, তা না হলে আমার লেখা আসে না।’ শুরুতে যখন আত্মপ্রকাশের একটা তাগাদা ছিল, উত্সাহও ছিল তখন। এখন মনে হয় আবার লিখতে হবে, আবার ছাপা হবে! আবার টেনশন, আরও ঘরের মধ্যে থাকা... লেখা মানে তো কেরানিগিরি। আমার স্ত্রী বলেন, ‘আমি তো কেরানিকে বিয়ে করতে চাইনি, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কেরানিই জুটে গেছে।’কেরানি তবু শুধু অফিসে কাজ করে, আমি তো বাড়িতেও কাজ করি (হাসি)।
পত্রিকা: ‘ঘুণপোকা’ উপন্যাসে তো দেশভাগ, উদ্বাস্তু সমস্যার ছোঁয়া পাই। অভিজ্ঞতা, দর্শন না কল্পনা?
শীর্ষেন্দু: আমি তো একজন উদ্বাস্তু। যদিও উদ্বাস্তু সমস্যা আমায় পোহাতে হয়নি কারণ, বাবা রেলে চাকরি করতেন। দেশভাগের ফলে আমাদের বিরাট একটা ক্ষতি হয়েছিল। দেশ ছেড়ে আমাদের চলে আসতে হয়। বিশাল যৌথ পরিবার থেকে বেরিয়ে আলাদা আলাদা ছোট ছোট পরিবারে আমরা ভাগ হয়ে গেলাম। এখন তো অনেক আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা হলে চিনতেই পারব না। তাঁরা কেউ দূরের আত্মীয় না। মাসতুতো বোন, মামাতো ভাই, জ্যাঠতুতো দাদা... দেশভাগের পর থেকে এত বিচ্ছিন্নতা এসে গেছে যা আমাকে পীড়া দেয়। কোনও এক ভাই হয়তো ফোন করল, ‘দাদা চিনতে পারছ?’ চিনতে পারলাম, নন্দ, কিন্তু চেহারাটা মনে পড়ল না। তখন এত লজ্জা লাগে! দেশভাগের পর নানা ঘটনা আমার জীবনে পীড়া দিয়েছে, আমায় ভাবায়। দেশভাগ অনেক কিছু কেড়ে নিয়েছে। ঠিকই, ‘ঘুণপোকা’ উপন্যাসের মধ্যে এই অভিজ্ঞতা কিছু আছে, অন্যান্য উপন্যাসের মধ্যেও আছে।
পত্রিকা: মানে, ওই যন্ত্রণাটাও কোথাও আপনার সৃষ্টিতে মিশে যায়।
শীর্ষেন্দু: যন্ত্রণাটাই বেশি মেশে। আমি তিন বঙ্গের মানুষ তো! আমার পূর্ববঙ্গে জন্ম, উত্তরবঙ্গে বড় হয়েছি, শিলিগুড়িতে দীর্ঘদিন থেকেছি। এখন দক্ষিণবঙ্গে থাকছি। কাজেই তিনটে বঙ্গই আমার চেনা—এটা আমার সৌভাগ্য। অসমে ঘুরেছি বাবার সঙ্গে। ছেলেবেলা থেকে এমন একটা পটভূমি পেয়েই বড় হয়েছি আমি।
পত্রিকা: কিন্তু এই পটভূমি, এই বিস্তীর্ণ ঘোরার অভিজ্ঞতা থেকে নীললোহিতের মতো কোনও চরিত্র তো আপনার কাছে থেকে পেলাম না!
শীর্ষেন্দু: নীললোহিত সুনীলের একটা মার্কামারা চরিত্র। সুনীলের নিজস্ব একটা ব্যাপার আছে ওতে। সুনীলের বুদ্ধিদীপ্ত লেখা নীললোহিত। নীললোহিত যে’কটা লিখেছে, সব কটাই যে ভালো হয়েছে তেমনটা নয়, তবে কয়েকটা লেখা বেশ ভাল। কোনও কোনও সময়ে ওই নীলুর চরিত্রটির কিছু কিছু সংলাপ আমাকে চমকে দিয়েছে। সুনীলের এই গুণটা ছিল। কিন্তু সুনীল এই গুণটা হারিয়ে ফেলল একটা সময়ের পরে। ওর লাইফস্টাইলটা অন্যরকম হয়ে গেল। ধীরে ধীরে, ও আমাদের মধ্যে সবচেয়ে আগে হায়ার ইকনমিক ক্লাসে চলে গেল।
তারপর গাড়ি করে ঘোরা-টোরা শুরু করল। এসব কিছু আমার কাছে খুব অপছন্দই ছিল। আমি ওকে বলতাম, ‘দিস ইজ নট গুড। কমন পিপলের সঙ্গে যোগাযোগটা থাকে না এতে। গাড়ি-টাড়ি আবার কেন?’ তারপর মজা হল, কোনও মফস্সলে হয়তো ও যাচ্ছে, সেখানে বিডিও আসছেন, এসডিও আসছেন, পুলিশ অফিসার আসছেন, মদের আসর বসছে, ফলে পাবলিক-এর সঙ্গে আর দেখা হচ্ছে না। আর পাবলিক-এর সঙ্গে দেখা হলেও তাঁরা ভাবছেন ‘বাবা! কে এসেছে!’ তখন বুঝলাম এই জগত্টা থেকে ও দূরে চলে গিয়েছে। রবীন্দ্রনাথের যা হয়েছিল—‘বাধা হয়ে আছে মোর বেড়াগুলি’—তেমনই সাধারণ জগৎটাকে তখন ও আর চেনে না। তবে আমার ক্ষেত্রে সেইটা ভাগ্যক্রমে হয়নি। অলওয়েজ উইথ দ্য পাবলিক। আমি তো ক’দিন আগেও বাসে উঠেছি। আমি যে বাজারটাতে যাই, সেখানে প্রত্যেক তরকারিওয়ালাদের সঙ্গে আমার গভীর সখ্য।
পত্রিকা: শীর্ষেন্দুদা, লেখকদের একটা অ্যাসপিরেশনাল লেভেল থাকে যে লিখেই আমি এতটা প্রতিষ্ঠা পাব যে জীবনটা অন্য স্তরে পৌঁছবে, আর্থিকভাবেও। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সেই পর্যায়ে অনেক আগে পৌঁছে গিয়েছিলেন বলে অনেকে ঈর্ষা করেন। আপনি হিংসা করতেন না সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে?
শীর্ষেন্দু: একেবারেই উল্টোটা বরং। সুনীলের সঙ্গে আমার বন্ধুত্বটা এমন ছিল। আমিই একমাত্র বন্ধু, যে ওকে রীতিমতো বকাঝকা করতে পারতাম। প্রচুর বকতাম ওকে। তবে সব সময় যে ও শুনত এমনটা আমার মনে হয় না। তবে আমি করেছি। ওর জীবনের শেষ দিকে একবার ওর সাতাত্তর বা আটাত্তর বছরের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে আমি গিয়েছি। তখন দেখি হাত-পা গুলো ওর বশে নেই আর। দাঁড়ালে পা কাঁপে। আমি ওর পাশে গিয়ে বললাম, ‘সুনীল, আপনাকে আরও অনেক দিন বাঁচতে হবে। বেঁচে থাকার জন্য যা-যা দরকার, করতে হবে।’ ও আমার হাতটা চেপে ধরল। আসলে মানুষ মাঝেমাঝে ‘ভিক্টিম অব ওনস্ প্যাশন’ হয়ে যায় তো। ও কী আর করবে? ওই বন্ধুবান্ধব, মদ্যপান এড়াতে পারত না। অনেক সিগারেটও খেত। এদিকে সুগারও ছিল। ও খানিকটা নিজের মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করেছিল। ওর বেসিক স্বাস্থ্য তো ভাল ছিল— অনেক দিন বাঁচতে পারত। কিন্তু সেটা তো হল না। তবে, সাকসেস অফ সুনীল কোনও দিনও আমাকে ঈর্ষান্বিত করেনি। এটা আমাকে মজা দিয়েছে, আমার ভাল লেগেছে। মনে হত, ওর সাফল্যটা যেন আমাকেও কিছুটা আলোকিত করেছে। ঈর্ষা করেছি বলে তো মনে হয় না।
পত্রিকা: কিন্তু লেখক হিসেবে কাউকে ঈর্ষা করেননি? বহু বছর আগে দূরদর্শনের জন্য আপনি তো বনফুলের একটা সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন তাঁর বাড়িতে। এমন কোনও লেখকের কথা আপনি বলবেন, যাঁর মতো লিখতে চেয়েছেন আপনি, ভেবেছেন ‘ইশ! ওঁর মতো যদি লিখতে পারতাম.....।’
শীর্ষেন্দু: কমলকুমার মজুমদার-এর কিছু লেখা নিয়ে এমনটা বলতে পারি। কমলদা অনেক লেখাই লিখেছেন। সব কটা যে ভাল এমনটা নয়। ওঁর লেখার মধ্যে গোটা তিন-চার লেখা আউটস্ট্যান্ডিং। সতীনাথ ভাদুড়ির ‘ঢোঁড়াই চরিত মানস’ ভাল লেগেছে। ওই ধরনের লেখা আমি লিখতে পারতাম না। জনপ্রিয় লেখা তো কোনও ব্যাপার নয়, কিন্তু ওই ধরনের লেখা আই ওপেনার। মানুষকে একটা দিশা দেখায়। কখনও সখনও মনে হয়েছে আমাদের সমসাময়িকদের মধ্যেও অনেকে খুবই ভাল লিখেছে, যেমন একটা সময়ে মতি নন্দীর লেখা, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, সুনীলেরই এক-আধটা লেখা আছে, খুবই ভাল। শক্তির খুবই ভক্ত ছিলাম।
পত্রিকা: মানুষ শক্তি চট্টোপাধ্যায়কেও তো আপনি সস্নেহে আগলে রাখতেন শুনেছি।
শীর্ষেন্দু: সেটা ঠিক। কিন্তু শক্তির সঙ্গে আমার দেখা-সাক্ষাৎ খুবই কম হত। তার কারণ, ও মদ্যপানজনিত ব্যাপার-স্যাপারে একটা জগতে চলে গিয়েছিল। তাই সব সময়ে ওকে পাওয়া যেত না। কিন্তু যখন পেতাম ওর সঙ্গে আমার একেবারে তুই-তোকারি সম্পর্ক ছিল। ঠাট্টা-ইয়ার্কি সব চলত। কিন্তু ওর ওই একটাই দোষ। ও আবার ভূতের ভয় পেত মারাত্মক। আমাদেরই এক বন্ধু যখন মারা গেল, নকুল— লাইব্রেরিয়ান, তারপর শক্তির সে কী ভয়! শক্তি আর সিরাজেরও, ওফ!
পত্রিকা: সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজকে নিয়ে আপনার কী মূল্যায়ন? ওঁর সঙ্গে অম্ল-মধুর একটা সম্পর্ক ছিল?
শীর্ষেন্দু: সিরাজ অত্যন্ত ক্ষমতাবান লেখক ছিল। কিন্তু ও শেষ দিকে কর্নেল ছাড়া আর কিছু লিখত না। গোয়েন্দা কাহিনি, সেগুলো সব বিদেশি উপন্যাসের ছায়ায়। আমি বলতাম, এ সব ছাইভস্ম কেন লিখিস? ও বলত ‘টাকার খুব দরকার ছিল’। তবে আমার তা মনে হত না ওর অত টাকার দরকার আছে। আনন্দবাজার-এ চাকরি করত, ভালই মাইনে পেত। তবে ওর বেহিসেবি ব্যাপার ছিল। তখনকার দিনে বউয়ের সঙ্গে বেরিয়ে চারশো টাকা দিয়ে ডিনার সেট কিনে ফেলল! ভাবা যায়! আমি বলেছিলাম, ‘ডিনার তো খাবি তুই আর তোর বউ! কিনলি কেন ডিনার সেট? বাড়িটা ছোট্ট। ডাইনিং টেবিলও পাতার জায়গা নেই। প্রায়ই ওর সঙ্গে খুব ঝগড়া হত। আবার ভাবও।
পত্রিকা: শীর্ষেন্দুদা, আপনি ছাড়া দিকপাল সাহিত্যিক যাঁরা, প্রত্যেকে নিজের চতুর্দিকে একটা বৃত্ত, একটা ভক্তমণ্ডলী, অনুগত অল্পবয়স্ক লেখকগোষ্ঠী নিয়েই বাঁচেন। আপনি একেবারে একা, একক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। এটাও সচেতন ভাবে?
শীর্ষেন্দু: (হাসি) হ্যাঁ, আমার কোনও বলয় নেই। নেই, কারণ আমি সেই পজিশনে কখনও যাইনি। একটা ঘটনার কথা বলি। তখন, আনন্দ বাগচী দেশ পত্রিকায় গল্পের সিলেক্টর, গল্প দেখেন। এমন সময়ে সাগরদা (সাগরময় ঘোষ) তাঁর ওপর কোনও ব্যাপারে অসন্তুষ্ট হয়ে আমায় ডেকে পাঠালেন। আমি ওঁর ঘরে গেলাম। আমায় বললেন, ‘শোনো, গল্পের সব দায়িত্ব নিয়ে নাও। আমি আনন্দকে বলে দিয়েছি। ফাইলগুলো নিয়ে নাও। এবার থেকে গল্পের বিভাগটা তুমিই দেখবে।’ আমার মাথায় সঙ্গে সঙ্গে বজ্রাঘাত হল। সাগরদার মুখের ওপর তো আর কথা বলা যায় না। চলে এলাম। মনে মনে প্রমাদ গুনলাম, এই গল্পের ভার যখন আমি নিলাম, তার মানে হচ্ছে একগাদা তরুণ গল্পলেখককে সামলাতে হবে। তারা সবাই আমার দিকে শ্যেনদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকবে এবার। আমার বাড়িতে যাবে, বাজার করে দেবে, এটা-সেটা করে দেবে...। আমার মিথ্যে স্তুতি করে, ভূয়সী প্রশংসা করে যাকে বলে একেবারে তেল দেওয়া, তাই দেবে....। এবার আমার জীবন হেল হয়ে যাবে! কার গল্পটা কবে ছাপা হবে, না হবে এই সব প্রশ্নে একেবারে ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠতে হবে। এই ভাবে যদি চলে, তাহলে আমার ইম্পর্ট্যান্স হয়তো বাড়বে, কিন্তু আমার জীবনটা হেল হয়ে যাবে। আমি এসে তখন আনন্দকে খুব বকলাম। বললাম, ‘কী ব্যাপার আনন্দ, কী হল তোমার?’ আনন্দ বলল, ‘আমি তো ভাই কিছু বুঝতে পারছি না।’ আমি বললাম, ‘তুমি ভাই একটা কাজ করো। সাগরদাকে গিয়ে বলো, শীর্ষেন্দু যদি গল্প দেখে, তাহলে ও লিখবে কখন?’ ও বলল গিয়ে। কথাটা শোনার পর সাগরদা আনন্দকে বললেন, ‘আচ্ছা, তুমিই দেখো তা হলে।’ তখন আমার ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল।
পত্রিকা: এটা কি মানুষ হিসেবে আপনার প্রকৃতির জন্য? বলয় মানে স্তুতি, স্তুতি মানে আত্মতুষ্টি—তাই?
শীর্ষেন্দু: দ্যাখো, গল্প দেখতে আমার কোনও আপত্তি ছিল না। সমস্যাটা হল গল্প দেখা শুরু করলেই ইয়ং রাইটার্সরা আমায় ঘিরে ধরবে। তুমি যে বলয়ের কথা বলছিলে, তা আমার প্রার্থিত বলয় নয়। এ বলয় থাকলে মানুষের সর্বনাশ হয়ে যায়। যখনই তোমার চারপাশে তোমার তোষামোদকারীরা জুটে যাবে, তখনই তোমার বারোটা বেজে যাবে। তোষামোদকারীদের আমি ভীষণ ভয় পাই। কেউ আমার প্রশংসা শুরু করলেই আমি শিহরিত হই ‘এই রে!’ এই কারণেই আমার চারপাশে বলয়টা তৈরি হয়নি। আরেক কারণও অবশ্য আছে। মদ্যপান ইত্যাদি বিষয়ের থেকেও আমি দূরেই থেকেছি। আমার বাড়িতে ওসবের চল ছিল না। সেটাও একটা কারণ। বলয় না থাকাটা আমার ক্ষেত্রে শাপে বর হয়েছে। সুনীলের এই বলয়টা ছিল। ও বলয়টাকে খুব পছন্দও করত। এটা আমার খুব অপছন্দ ছিল। অনেকদিন বলেছি, ‘সুনীল এটা ভাল না।’ পরের দিকে সুনীল কিন্তু কোনও সমালোচনা সহ্য করতে পারত না। কোনও রকম বিরূপ সমালোচনা হলেই সুনীল ক্ষুব্ধ হত। এমনটা তো ভাল নয়। বিরূপ সমালোচনা তো হবেই। আমি লিখলাম, লেখাটা ছেড়ে দিলাম। লেখাটা ছাপা হয়ে গেল। তারপর লোকে যদি গালাগাল করে তো করবে! এতে কী যায় এসে গেল? সত্যি কথা বলতে, আমার গালাগালেও কোনও রিঅ্যাকশন হয় না। লেখা তো খারাপ লাগতেই পারে। লেখার তো কোনও নির্দিষ্ট ষ্ট্যান্ডার্ড নেই।
পত্রিকা: আরেকটা ব্যাপার আপনি সচেতন ভাবে অ্যাভয়েড করেছেন, সুনীলদার ক্ষেত্রে যেটা ছিল, রাষ্ট্রশক্তি বা ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে একটা নৈকট্য। আপনি এই নৈকট্য এড়িয়ে গিয়েছেন।
শীর্ষেন্দু: হ্যাঁ, অ্যাভয়েড করেছি। একটা কারণেই অ্যাভয়েড করেছি। দেখছ তো নেতাদের চরিত্র! তাঁরা ইন্টেলেকচুয়ালি হাই বা লো, সে কথা বলছি না। জ্যোতি বসুর মতো একজন প্রবীণ নেতা দাঁড়িয়ে মিথ্যে কথা বলছেন! দলের স্বার্থে তাঁকে মিথ্যে কথা বলতে হচ্ছে! এই ইমমরালিটিটা আমার সহ্য হয় না। এদের সঙ্গে তুমি কী ঘনিষ্ঠতা করবে বলো তো? জ্যোতিবাবুকে অনেক কাজের জন্য মাথায় করে রাখা হয়। তবে জ্যোতিবাবুকে আমি দাঁড়িয়ে মিথ্যে কথা বলতে শুনেছি। বুড়ো মানুষ। তখন নব্বুই-এর ওপর বয়স হয়ে গেছে। তখনও মিথ্যে কথা বলছেন। শুনে অবাক লাগত যে এই বয়সে কেউ মিথ্যে কথা বলে? দলের স্বার্থে, দল বলাচ্ছে। উনিও বলছেন দলের স্বার্থে, নেতৃত্ব বজায় রাখার স্বার্থে। প্রত্যেকটা নেতাই গুন্ডাদের প্রশ্রয় দেওয়া, ছাড়িয়ে আনা— ইমমরাল যা যা করার সব করেন। দেখছি তো চারিদিকে। তাই রাষ্ট্রশক্তির কাছে নতজানু হইনি কখনও। কিছু সাহায্য চেয়েছি কখনও সখনও। নিজের জন্য নয়। কারও আত্মীয় হয়তো হাসপাতালে ভর্তি হবে, খুব গুরুতর অসুস্থ। আমার খুব পরিচিত কেউ থাকলে তাঁকে হয়তো বললাম। ব্যস, ওই পর্যন্তই। আমার তো এমপি হওয়ারও বিষয় নেই, কিছু পাওয়ারও নেই।
(এর পর আগামী শনিবার)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy