কলকাতা বেতার-কেন্দ্রে ১২ অক্টোবর ১৯৪৮ তারিখে পঠিত হয়েছিল একটি প্রবন্ধ, যেখানে উচ্চারিত হয়েছিল অনেক স্মরণীয় শব্দ। তার কেন্দ্র থেকে একটি বাক্য সমস্ত তরঙ্গ অতিক্রম করে, সময় পেরিয়ে, ইতিহাস গড়ে নিতে নিতে ভবিষ্যতের জন্য রেখে গিয়েছিল একটি বাণী, অন্তর্বিস্ফোরণের সমস্ত গানপাউডার প্লট বুঝি লিখে ফেলা হয়েছিল সেই জীবনের তন্ত্রে। সেখানে বলা হয়েছিল, “খাঁটি কাজের পুরস্কার অনেক সময় এ জীবনেই পাওয়া যায়।... যেসব যুবক নীরবে কাজ করবার জন্য বুক বেঁধেছে, আমি নিজ দীর্ঘ জীবনে অভিজ্ঞতা থেকে তাদের এই আশ্বাস দিচ্ছি—তোমরা ঠিক পথ বেছে নিয়েছ, তোমরা সফল হবেই হবে, ‘জীবনে না হয়, মরণে’।” ভবিষ্যৎ প্রজন্মের গবেষকদের এই সাহসটিই জুগিয়ে গিয়েছেন তিনি— ইতিহাসবিদ স্যর যদুনাথ সরকার (১৮৭০-১৯৫৮)।
নীরবে কাজ করে যাওয়ার জন্য যাঁদের প্রেরণা দিয়েছিলেন স্যর যদুনাথ, তাঁরা জানেন কী ভাবে ইতিহাসচর্চা করেছিলেন তিনি। কী ভাবে তাঁর রচিত গ্রন্থগুলির মাধ্যমে প্রমাণ করেছিলেন ‘ইতিহাস-চর্চ্চার যাহা শ্রেষ্ঠ পন্থা তাহা বৈজ্ঞানিক পন্থা’। সেই পন্থা যদুনাথ সরকারের রচনাসম্ভার আমাদের চোখের সামনে সাজিয়ে রেখেছে, কেবল আমাদেরও খুলে রাখতে হবে দেখার দৃষ্টি, নইলে বুঝতে পারব না ইতিহাসবিদের সংবেদী মননের, তাঁর সমানুভূতির সিঁড়িধাপগুলি। ইতিহাসচর্চা তো কেবল প্রাণহীন অতীতকে বর্তমান সময়ে হাজির করা নয়, ‘প্রকৃত ইতিহাস অতীতকে জীবন্ত করিয়া চোখের সামনে উপস্থিত করে’, এ কথা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন স্যর যদুনাথ। কী ভাবে ছোঁয়ানো যাবে প্রাণের সেই এলিক্সির? তাঁর গবেষণার পদ্ধতি-প্রণালী জানলে ব্যক্তি যদুনাথের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলিও পরিষ্কার হয়ে যায় আমাদের কাছে।
ইতিহাসের আকর হিসেবে তো রয়েছেই পাণ্ডুলিপি, পুঁথি, স্পর্শগ্রাহ্য জিনিসপত্র। কিন্তু নামের সঙ্গে নাম, মুখের সঙ্গে মুখ মিলিয়ে দেওয়া একটি পাসপোর্ট যেমন হদিস দিতে পারে না আসল মানুষটির, তেমনই ইতিহাস কখনওই বাঙ্ময় হয়ে উঠতে পারে না কেবল কয়েকটি মুদ্রা কিংবা পাথর অথবা অক্ষরের সাহায্যে। তা হলে অন্য পন্থাটি কী, যেখানে অতীত হয়ে উঠতে পারে জীবন্ত? যদুনাথ সরকার লিখেছেন, ‘আমরা যেন সেই সুদূর কালের লোকদের দেহের মধ্যে প্রবেশ করিয়া তাহাদের ভাবে ভাবি, তাহাদের সুখ দুঃখ আশা ভয় আমাদের হৃদয়ে অনুভব করি।’ এইবার পাঠকের কাছে অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে যায়, কে দিতে পারে অন্ধজনে আলো আর মৃতজনে প্রাণ। সুদূর কালের মানুষের প্রতি এমপ্যাথি— জেনে নেওয়া তাঁদের সুখ দুঃখ আশা ভয়..., সব স্তরের মানুষ, সব শ্রেণির মানুষ। এ ভাবে যদি করা যায় ইতিহাসের চর্চা— যা নিঃসন্দেহে যদুনাথের মতে বৈজ্ঞানিক পন্থা— তবে কি জানা যাবে না সমসময়কেও? ইতিহাসের প্রকৃত উদ্দেশ্য কি তা-ও নয়? যখন জানতে পারব রক্তমাংসের মানুষের ভাষা, তখনই উপলব্ধি করতে পারব ‘অতীত কাল সম্বন্ধে অবিকল ও পূর্ণাঙ্গ সত্য’। কারণ স্যর যদুনাথ মানতেন, ‘সত্যের দৃঢ় প্রস্তরময় ভিত্তির উপর ইতিহাস দাঁড়াইয়া থাকে’।
জীবন যদি সেই সত্যের অনুসন্ধান না করে, তবে ইতিহাসচর্চাও ব্যর্থ হতে একপ্রকার বাধ্য। স্যর যদুনাথের জীবন, তাঁর ‘জীবনের তন্ত্র’-ও বুঝি সেই সত্যের আদর্শে গঠিত হয়েছিল। রাজশাহি জেলার করচামারিয়ার জমিদারবাড়িতে যদুনাথের জন্ম হয় ১০ ডিসেম্বর, ১৮৭০ সালে। সিংড়া উপজেলার জমিদার বা জ়মিনদার্স অব নাটোর-এর তালিকায় এখনও খানিক আন্তর্জাল ঘাঁটলেই চোখে পড়ে যদুনাথ সরকারের নাম। অবশ্য অনুল্লিখিত থেকে যান তাঁর পিতা রাজকুমার সরকার, যিনি গ্রামের বাড়িতে ইংরেজি সাহিত্য ও ইতিহাসগ্রন্থের রীতিমতো লাইব্রেরি গড়ে তুলতে পেরেছিলেন। পড়াশোনার প্রথম উৎসাহই কেবল নয়, তাঁর বাবাকে দেখেই ‘নিজ জীবনের ধ্রুব লক্ষ্য স্থির করতে’ পেরেছিলেন যদুনাথ। গ্রামের স্কুলে পড়াশোনা শুরু, সেখান থেকে রাজশাহি এবং তারপর কলকাতার হেয়ার স্কুল। বেনিয়াটোলার ভাড়াবাড়ি থেকে ছেলেকে নিয়ে রাজকুমার গিয়েছিলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতো ব্যক্তিত্বের কাছে।
স্যর যদুনাথ তাঁর ‘বিদ্যাসাগর’ নিবন্ধে ঈশ্বরচন্দ্রকে তুলনা করেছিলেন স্যামুয়েল জনসনের সঙ্গে। দু’জনের চরিত্র বোঝাতে কতকগুলি বিশেষণ ব্যবহার করেছিলেন, যাদের আমরা নির্দ্বিধায় যদুনাথ সরকারের পাশে স্থান দিতে পারি। যদুনাথ লিখেছিলেন, বিদ্যাসাগর এবং জনসন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ছিলেন ‘মিতব্যয়ী, সরল, করুণহৃদয়, নির্ভীক স্পষ্টবক্তা এবং কঠোর শ্রমী’। এই সব ক’টি বৈশিষ্ট্য যদুনাথেরও ছিল। জানা যায়, তিনি ছাত্রাবস্থায় ঘন ঘন ম্যালেরিয়ায় ভুগতেন। কিন্তু ১৮৮৯ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময়ে ইডেন হিন্দু হস্টেলের আবাসিক হয়ে বন্ধু হিসেবে পেয়েছিলেন শোভাবাজার ফুটবল দলের খেলোয়াড় সুরেশ চক্রবর্তীকে, যাঁর উৎসাহে যদুনাথ ফুটবল খেলতে আরম্ভ করেন এবং স্বাভাবিক ভাবেই স্বাস্থ্যোন্নতিও হয়। শ্রম যে তাঁকে করতেই হবে, এ কথা তিনি নিশ্চয়ই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন তখনই। খানিক দূরবর্তী তুলনা মনে হলেও এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে ঔপন্যাসিক হারুকি মুরাকামির একটি উক্তি। তাঁর দৌড়নোর প্যাশনের কথা আমাদের অজানা নয়। একটি সাক্ষাৎকারে খানিক অতিশয়োক্তি মনে হলেও মুরাকামি বলেই ফেলেছিলেন, ‘once a writer puts on fat, it’s all over’।
যদুনাথ সরকারের মতো ইতিহাসবিদ যে ভাবে কাজ করে গিয়েছেন, তার কথা জানলে বোঝা যায় এক-একটি কাজের নেপথ্যে কতখানি শ্রম দিতে হয়েছে তাঁকে। যদুনাথ নিজেই জানিয়েছেন, একটি ইতিহাস বা জীবনীগ্রন্থ রচনা করার সময়ে প্রথম দশ বছর কেটে গিয়েছে কেবল উপকরণ সংগ্রহ করতে। সব তথ্য, তত্ত্ব, ভাবনা সাজিয়ে নিয়ে তবে শুরু করা লেখা, তার আগে নয়। শিখতে হয়েছে ভাষার পর ভাষা—ফারসি, মরাঠি, পর্তুগিজ়... ছুটে বেড়াতে হয়েছে নানা স্থানে, কিনতে হয়েছে অসংখ্য দুষ্প্রাপ্য, দুর্মূল্য বই। অনন্ত ধৈর্য, অপরিসীম পরিশ্রম, তার পরেও, ‘আমাদের গবেষণার ফলটি প্রকাশিত হবামাত্র চারদিক থেকে তার মূল্য সম্বন্ধে অবিশ্বাস, ঈর্ষ্যার কুৎসিত অপবাদ আমাদের ঘিরে ফেলে,’ জানতেন যদুনাথ। তবু জ্ঞানসাধনার পথ থেকে তিনি কোনও অবস্থাতেই সরে আসেননি। জানতেন খাঁটি কাজের কোনও বিকল্প নেই, থাকতে পারে না। এবং তা যদুনাথ প্রমাণ করেছিলেন একেবারে ছাত্রাবস্থা থেকেই। এম এ পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েও ইংল্যান্ডে উচ্চশিক্ষার জন্য সরকার-প্রস্তাবিত বৃত্তি প্রত্যাখান করে প্রেমচাঁদ-রায়চাঁদ বৃত্তির জন্য পড়াশোনা করেন।
১৯০১ সালে ‘ইন্ডিয়া অব ঔরঙ্গজেব’ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। এর আগেই অবশ্য যদুনাথ রিপন কলেজে অধ্যাপনা করতে শুরু করেছিলেন ১৮৯৩ থেকে। তার পর মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশনে ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবে পড়িয়েছিলেন ১৮৯৬ থেকে ’৯৮ পর্যন্ত। এর পর নানা জায়গায় অধ্যাপনা— প্রেসিডেন্সি কলেজ, সেখান থেকে পটনা কলেজ, আবার প্রেসিডেন্সি, ফের পটনা। সেখান থেকে বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটি, অতঃপর কটকের র্যাভেনশ কলেজ... পড়াচ্ছেন ইংরেজি সাহিত্য, ইতিহাস, এমনকি বাংলাও। বারাণসীতে তিক্ত অভিজ্ঞতার পর প্রত্যাবর্তন পটনায় এবং সেখান থেকেই ১৯২৬ সালের ৯ ডিসেম্বর অবসরগ্রহণ।
আসলে যদুনাথের মতো ব্যক্তিত্বের অবসর বলে কিছু হয় না। অধ্যাপক দীপেশ চক্রবর্তী জানিয়েছেন, বাংলা ভাষায় যদুনাথের গ্রন্থসংখ্যা চার এবং প্রবন্ধ-বক্তৃতা ১৫৮। ইংরেজি ভাষায় বই লিখেছিলেন অন্তত ১৭টি, যার বেশ কয়েকটির একাধিক খণ্ড, ২৬০টি প্রবন্ধ এবং বিবিধ সংবাদপত্র ও পত্রিকায় প্রকাশিত ১১০টি নিবন্ধ, অভিভাষণ ইত্যাদি। এর পাশাপাশি ছিল ফারসি, ফরাসি প্রভৃতি ভাষা থেকে নানা অনুবাদ, গ্রন্থের ভূমিকা রচনা, গ্রন্থ সমালোচনা ইত্যাদি। সবই আসলে এক সত্যের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নিরন্তর সাধনা, তাঁর ‘এম্পায়ার অব ট্রুথ’।
শ্রম ও সংযম— যদুনাথ সরকারের জীবনে ও কর্মে এই দুইয়ের উল্লেখ বারেবারেই ফিরে আসে। তার আর এক চমকপ্রদ ভাবনার খোরাক পাওয়া যায় দীপেশ চক্রবর্তী উল্লিখিত তাঁর হস্তাক্ষর থেকে। যদুনাথ সরকারের হাতের লেখার দু’-একটি নমুনা আমরা কোনও কোনও বইয়ে দেখেছি। দীপেশ চক্রবর্তী সেই লেখা দেখার ‘আর্কাইভাল এক্সপিরিয়েন্স’ থেকে বুঝতে পেরেছিলেন, স্যর যদুনাথ ‘প্রতিটি কর্তব্যকর্মে... সম্পূর্ণভাবে মন দিতে’ পারতেন। উদাহরণও দিয়েছেন তিনি। দীপেশ চক্রবর্তী লিখেছেন, “ধরুন, আমি যখন ইংরিজিতে g-o-i-n-g কথাটি লিখি, ‘g’ ও ‘o’-এর পরেই আমার কলম কেমন বেহালার ছড়ের মতো দ্রুতগতিতে ‘ing’ লেখা সেরে ফেলে, যেন আমার কোনো অবিশ্বাস্যরকম তাড়া আছে! যদুনাথের হস্তলিপিতে... কোনো তাড়া নেই।” এখানেই এসে পড়ে যদুনাথ সরকারের ‘শৃঙ্খলাপ্রিয় ব্যক্তিত্বের প্রসঙ্গ’।
এমন শৃঙ্খলা কি মানুষকে আত্মকেন্দ্রিক, এমনকি নিষ্ঠুরও করে তোলে? সাধারণ লোকজন হয়তো ভাববেন এমনটাই, কিন্তু যদুনাথের মতো ব্যক্তিত্ববান পুরুষ কখনওই বেআব্রু করে প্রকাশ করবেন না ব্যক্তিগত-কে, নিজের দুঃখ-যন্ত্রণা। পরিবারের ঘনিষ্ঠজনের একের পর এক মৃত্যু তাঁকে দেখতে হয়েছে, সহ্য করতে হয়েছে গভীর শোক। তথ্য বলছে, যদুনাথের দাদা মারা গিয়েছিলেন তাঁদের মায়ের মৃত্যুর আগেই। যদুনাথের জামাই প্রয়াত হয়েছিলেন সাতটি কন্যাসন্তান রেখে, যাদের প্রতিপালন করেছিলেন যদুনাথ। আর এক জামাই সুশীলকুমার ঘোষ সিঙ্গাপুরের কাছ থেকে হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যান। তাঁরও ছিল তিন নাবালক পুত্র। কলকাতায় ১৯৪৬-এর ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষে প্রাণ হারান যদুনাথের দুই পুত্র। কন্যা রমা ইংল্যান্ডে গবেষণা করতে গিয়েছিলেন, তিনিও প্রাণ হারান সেখানেই। স্ত্রী, ভ্রাতুষ্পুত্র এমনকি নাতির মৃত্যুও তাঁকে সহ্য করতে হয়েছিল।
আবার এ সবের পাশাপাশি, যদুনাথ-সংক্রান্ত মিতায়তন এক জীবনীগ্রন্থ থেকে জানা যায়, একই চিঠিতে তিনি প্রিয়জনের মৃত্যুসংবাদ প্রেরণের সঙ্গে সঙ্গেই আলোচনা করছেন ইতিহাসের নানা বিষয় নিয়ে। এই প্রসঙ্গে পাঠকের মনে পড়তে পারে যদুনাথের লেখা নিবন্ধ, রবীন্দ্রনাথের “‘সোনার তরী’র ব্যাখ্যা” থেকে কয়েকটি বাক্য। যদুনাথ কবিতা-বিশ্লেষণে লিখেছিলেন, ‘সর্ব্বশ্রেষ্ঠ মনীষীরা একক; জীবনের মধ্য দিয়া তাঁহারা নিজ কাজ করিয়া যান, সাহায্য পান না, উৎসাহ পান না, সফলতা বড় দূরবর্ত্তী বোধ হয়। তাই তাঁহাদের জীবন সঙ্গীহীন, বিষাদছায়া মাখা’। যদুনাথ সরকারের আলোচনায় স্বাভাবিক ভাবেই আসবেন রবীন্দ্রনাথ, থাকবে তাঁদের সখ্য ও দূরত্বের প্রসঙ্গও। অনেক তথ্যই আমাদের জানা, রবীন্দ্র-যদুনাথের যে বিরোধ, তার পাশাপাশি পারস্পরিক শ্রদ্ধার প্রতিবেশও ছিল শেষ পর্যন্ত। ১৯২৭-এর চিঠিতেও রবীন্দ্রনাথ লিখে জানিয়েছিলেন রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়কে, যাঁদের তিনি শ্রদ্ধা করেছেন, তাঁদেরই বন্ধু হিসেবে গণ্য করেছেন এবং সেই তালিকায় ছিলেন রামানন্দ নিজে এবং ‘জগদীশ,...যদুবাবু, ও রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী’।
১৯০৪ সালে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে গয়ায় বেড়াতে গিয়েছিলেন যদুনাথ। পটনা থেকে তিনি শান্তিনিকেতনেও এসেছেন একাধিক বার। ‘আন্তরিক শ্রদ্ধার নিদর্শন-স্বরূপে’ রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘অচলায়তন’ গ্রন্থ উৎসর্গ করেছিলেন যদুনাথকে। যদুনাথ নিজে অন্তত ১৭টি গল্প ও প্রবন্ধের ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করেন ‘মডার্ন রিভিউ’ পত্রিকায়। এ ছাড়া বাংলায় লেখা তো ছিলই। ১৯২২ সালে যদুনাথ সরকারকে রবীন্দ্রনাথ আমন্ত্রণ জানান বিশ্বভারতীর কর্মসমিতির সদস্যপদ গ্রহণ করার জন্য। কিন্তু বিশ্বভারতীর শিক্ষাদর্শ, তার প্রতিবেশ যদুনাথের পছন্দ হয়নি। ৩১ মে ১৯২২ তারিখের চিঠিতে যদুনাথ জানিয়েছেন, বিশ্বভারতীর গভর্নিং বডির সদস্যপদ গ্রহণ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়, কারণ স্থানিক দূরত্ব। ‘যেখানে কাজ করিতে পারিব না, সেখানে নামে সদস্য হইয়া থাকাটা আমি নিজের পক্ষে লজ্জাকর ব্যবহার এবং ঐ সংস্থানের প্রতি অবিচার বলিয়া মনে করি’। কিন্তু এটুকুই কারণ নয়, তিনি রীতিমতো আক্রমণের ভঙ্গিতে জানান, বোলপুরের ছাত্ররা কেবল ভাবের দিকে, ইমোশন এবং ‘সিন্থেসিস অফ নলেজ’-এর দিকে তাকায়, এগজ়্যাক্ট নলেজ শেখে না। কেবল তা-ই নয়, ‘বরং শেখা অনুচিত, কুশিক্ষা বলিয়া মনে করে’। সর্বোপরি, বিশ্বভারতীর আদর্শ যা-ই হোক, যদুনাথের মনে হয়েছিল, বিশ্বের দরবারে, বিশ্ববাসীর চোখে সেটি এমন এক প্রতিষ্ঠান হয়েই থেকে যাবে, যাকে দেখে বাইরের লোকজন উচ্ছ্বাসে বলে উঠবে— ‘How truly oriental!’ ভারতীয় চিত্রকলা প্রসঙ্গে তিনি এই কথাটি লিখেছিলেন, কিন্তু তা উপমা হিসেবেই। প্রতিতুলনায় ছিল বিশ্বভারতীরই উল্লেখ। ১৯২৮ সালের এক বক্তৃতায়ও রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে যদুনাথ কিছু বিরূপ মন্তব্য করেছিলেন। সেই বছরই রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়কে লেখা চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘যদুনাথ সরকার মহাশয় মৃত যুগের কাহিনী নিয়ে কারবার করেন— টুক্রো খবর জোড়াতাড়া দেওয়াই তাঁর অভ্যেস। তিনি পণ্ডিত, সংবাদ সংগ্রহ করে সেগুলিকে শ্রেণীবিভক্ত করে তাতেই তিনি তৃপ্তি পান— মরা জিনিষ নিয়ে এমন করে ম্যুজিয়ম সাজানো চলে...কিন্তু পাণ্ডিত্যের ঘরগড়া কাঠামোর মধ্যে জীবধর্ম্মী পদার্থকে লেব্ল্ মেরে যিনি আত্মপ্রসাদ লাভ করেন তিনি অস্থানে আপন শক্তির অপব্যবহার করে থাকেন।’
এ সব তথ্যই আজ ইতিহাসের উপাদান, অতীতচারণের বিবিধ উপলক্ষ। সেই পরিসরে যদুনাথ সরকারের মতো ব্যক্তিত্বের জীবনকথা পড়লে, তাঁর লেখায় মনোনিবেশ করতে পারলে নিশ্চিত ভাবেই উপলব্ধি করা যায় এক সত্য, তাঁর এম্পায়ার অব ট্রুথ— যাকে বলা যায় ‘শ্রীকে উপাসনা, শৃঙ্খলাকে উপাসনা, ছন্দকে উপাসনা’।
তথ্যঋণ:
নিখিলেশ গুহ, রাজনারায়ণ পাল (সঙ্কলন ও সম্পাদনা), যদুনাথ সরকার রচনা সম্ভার
বিকাশ চক্রবর্তী, ব্যাহত সখ্য: রবীন্দ্রনাথ ও যদুনাথ সরকার
অনিরুদ্ধ রায়, যদুনাথ সরকার
দীপেশ চক্রবর্তী, দ্য কলিং অফ হিস্টরি: স্যর যদুনাথ সরকার অ্যান্ড হিজ় এম্পায়ার অব ট্রুথ দীপেশ চক্রবর্তী, স্যার যদুনাথের সান্নিধ্য, গ্রন্থাগারে
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, চিঠিপত্র, দ্বাদশ খণ্ড
পরিমল রায়, কাজী অনির্বাণ, দীপংকর বসু, বইখানির নাম “গড্ডলিকা প্রবাহ”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy