কথকতা: কেসিসি-তে আয়োজিত শিল্প প্রদর্শনী ‘কাহন’-এর শিল্পকর্ম। —নিজস্ব চিত্র।
বাইপাস সংলগ্ন কলকাতা সেন্টার ফর ক্রিয়েটিভিটি সম্প্রতি নিবেদন করল এমন এক কাহন, যার ভিতরে রয়েছে ‘দি আদার সাইড অব স্টোরিটেলার্স’— এক অন্য আমি-র গল্প। শহরের বুকে রমরমিয়ে চার দিন ব্যাপী চলেছিল ‘কাহন’ শিরোনামের এই প্রদর্শনী।
বাধ্যতামূলক পেশার চাপে স্বাধীন সত্তা অনেক সময়েই বঞ্চিত হয় শিল্পজগতের মূল স্রোত থেকে। এই প্রসঙ্গে প্রদর্শনীর অন্যতম উদ্যোক্তা জয় আইচ ভৌমিক জানান ‘কাহন’ নামটির আগের নাম ছিল ‘নিখিলেশ সান্যালদের ছবি’। সুপর্ণকান্তি ঘোষের সেই কালজয়ী লাইন, আর্ট কলেজের ছেলে নিখিলেশ সান্যাল বিজ্ঞাপনের ছবি আঁকতেন। বহিঃপ্রকাশের সুযোগে সকলকে জড়ো করে এই প্রদর্শনীর সূত্রপাত। আসলে প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয় ছাড়াও প্রত্যেক শিল্পীরই একটি অন্য মুখ আছে। আর এই অন্য মুখের আয়না-ই ধরা পড়ল কাহন-এ।
বিজ্ঞাপন জগতের বিভিন্ন স্তরের মোট ৪৭জন পেশাদার শিল্পীকে নিয়ে ইমামি আর্ট গ্যালারির দোতলা জুড়ে ‘অন্য আমির গল্প’র দৃশ্যায়ন ছিল বৈচিত্রে ভরা। নানাবিধ পেন্টিং, ফোটোগ্রাফ, অ্যান্টিক পিস, স্কাল্পচার ও কাগজের মুখোশ নিয়ে স্রষ্টাদের ব্যক্তিগত আবেগ ও কল্পনায় মূর্ত এই আয়োজন এবং বিজ্ঞাপন যেন ভ্রাতৃত্বের একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত সূচনা করল।
যেমন বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রর ছবি নিয়ে ‘স্ট্রিংস অব ইটারনিটি’র অভিনব মিউজ়িক্যাল কম্পোজ়িশন এবং মিশ্র মাধ্যমের ইনস্টলেশনের যুগ্ম দায়িত্বে ছিলেন সঙ্গীত পরিচালক প্রবুদ্ধ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অন্যতম উদ্যোক্তা শৌভিক পায়রা। শিল্পী শৌভিক পায়রার আর একটি মৌলিক তিন রঙের আকর্ষক ইনস্টলেশনের নাম ‘এব অ্যান্ড ফ্লো অব আস’। ছিল গায়ক উপল সেনগুপ্তের ভাবনায় ‘দ্য জয় অব মেকিং আর্থ গ্রিনার’-এর (ক্যানভাসের উপরে ডিজিটাল পেন্টিং ও ক্লে মডেলিং) ছোট ছোট চারটি ফ্রেম। যাদব সেন, যিনি ছাড়া এই বিশাল কর্মকাণ্ডটি বাস্তবায়িত হত না, তাঁর রচনায় ধ্বনিত হয় গভীর ধূসর বর্ণের অনবদ্য দলিলনামা ‘সম্ভবামি যুগে যুগে’র মুরাল।
শিল্পকর্মগুলির অগ্রণী ভূমিকায় সিনিয়র শিল্পীরা ছাড়াও ছিলেন তরুণ প্রজন্মের অসংখ্য বর্তিকা। বোর্ডের উপরে থ্রিডি ইনস্টলেশন ও প্রথা নির্মাণের বাইরে সোলার ভূষণে, শিল্পী সুদীপ্ত দত্তর কেশহীন ‘আনভ্যানকুইশড’ অকৃত্রিম জয়ের কথা বলে। ফেসবুক সিম্বলের ইনস্টলেশনে গ্রন্থবন্দি ‘ফল্টি প্রেমাইসেস’ সুব্রত কুণ্ডুর মেধাকে তুলে ধরে। সৌহার্দ্য সরকারের ‘হিউম্যানস অব টুডে’ (ইনস্টলেশন পেন্টিং), অস্তমিত আলোর গহ্বরে, কোনাকুনি অবক্ষয় প্রকাশের অন্যতম সেরা উদাহরণ। উল্লেখ করার মতো আর একটি ক্লাসিক ইনস্টলেশন কৌশিক দাসের ‘বিয়ন্ড লাভ অ্যান্ড নেচার’।
বস্তুত এই প্রদর্শনীতে কার কাজ ছেড়ে কার কথা বলা যায়, সেটি রীতিমতো একটি কঠিন বিষয়। মিশ্র মাধ্যমের ‘ক্রো’ সিরিজ়ে কাকের তির্যক চাহনি ও পায়ের আগ্রাসন, শিল্পী রৌদ্র মিত্রর জোরালো ড্রয়িংয়ের দক্ষতা প্রমাণ করে। ক্রেয়ন কন্টির ‘চারুলতা’ ফ্রেমে কৌস্তুভ বন্দ্যোপাধ্যায় নিপুণ যত্নে এঁকেছেন নারীমুক্তির নিভৃত সম্পর্ক। অরিন্দম বিশ্বাসের ঝকঝকে নিবেদনে, বর্ণিল উজ্জ্বলতা বাড়িয়ে তোলে দুই শিশুর ‘ড্রিম ক্যাচার্স’ পেন্টিং।
আলোকচিত্র বিভাগে প্রথমেই চোখে পড়ে সঞ্জীব ঘোষের ‘বিসর্জন’। আয়তাকার পরিসরে দু’ধার ঘেঁষে ঝাপসা প্রতিমা ও শবদেহের যাত্রায় অনিবার্য বাস্তবতা দরজায় এসে দাঁড়ায়। শুভেন্দু চাকীর লেন্সে টুকরো টুকরো বিষাদে উঠে আসে অতীতের টাইপ রাইটারের পরিবেশ (ওয়ান্স আপন আ টাইম)।
ক্যানভাস প্রিন্টে ‘ইমেজ ইন ওয়ার্ডস’-এর বডি, শাঁখ, জ্যাকপট নামাঙ্কিত তিনটি ছোট কবিতার অন্তর্দৃষ্টি ব্যাখ্যায় নতুন নজির রাখেন সংস্থার প্রতিনিধি জয় আইচ ভৌমিক— ‘মৃত্যুও কি এক রকম উদ্যাপন নয়?’ এ ছাড়াও নতুন কনসেপ্টের কাজে ছাপ রেখেছেন, সুতনু রায়, সোমনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, নীলাদ্রি দেব, অরিত্র গঙ্গোপাধ্যায় এবং তন্ময় চক্রবর্তী।
’৮০-’৯০ দশকের বহুল জনপ্রিয় বিজ্ঞাপন প্রচারের পুরোধায় ছিলেন প্রখ্যাত শিল্পী রণেন আয়ন দত্ত (১৯২৭-২০২৪)। তাঁকে উৎসর্গ করে তাঁর ১৫টি ছবি নিয়ে একটি শ্রদ্ধাঞ্জলির অংশ নির্ধারিত ছিল।
সব মিলেমিশে সুন্দর একাকার উপলব্ধির রেশ বস্তুতই সুদূরপ্রসারী। বিজ্ঞাপন শিল্পের অভিজ্ঞ ব্যক্তি মৃত্যুঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়, শিল্পী আদিত্য বসাক ও আর্ট কিউরেটর জ্যোতির্ময় ভট্টাচার্যর উপস্থিতিতে এই প্রদর্শনীতে প্রকাশিত হয়েছে একশো বছরের বিজ্ঞাপন নিয়ে একটি বইও। সব মিলিয়ে রেশ রেখে যায় ‘কাহন’।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy