বাঙালি নাকি স্মৃতিমেদুরতায় আক্রান্ত। তাই আধুনিকতাকে সাদরে বরণ করে নিলেও অতীতে ফিরতে ক্লান্তি নেই তার। উৎসব, পার্বণ বা বছরের বিশেষ দিনের রীতি পালনে তার জুড়ি নেই। তাই কি, ফুড ডেলিভারি অ্যাপে অভ্যস্ত নাগরিক সমাজ নববর্ষে বাঙালি খাবারে ডুব দেয়? বছরের নির্দিষ্ট কোনও দিনে বাঙালি খাবারের মাধ্যমে কি সারা বছর মাছ-ভাতে ‘বাঙালিয়ানা’ বজায় থাকে? বিশেষ এই দিনটিতে টলিপাড়ার তারকারা কী কী খেতে পছন্দ করেন।
নিজেকে ‘মাছে ভাতে বাঙালি’ হিসেবে উল্লেখ করতেই পছন্দ করেন অভিনেতা বিশ্বনাথ বসু। সারা বছর তাঁর বাড়িতে বাঙালি খাবারের প্রাধান্য বেশি। বিশ্বনাথের কথায়, ‘‘চাইনিজ় আর পঞ্জাবি খাবার ভাল লাগে। খুব বেশি যে কনটিনেন্টাল খাবারের নাম জানি, তেমনও নয়। আমার সব থেকে প্রিয় বাঙালি খাবার।’’
বিশ্বনাথ ব্যস্ত অভিনেতা। তবে নববর্ষের দিন পরিবারের সকলকে নিয়ে মধ্যাহ্ণভোজন তাঁর কাছে ‘মাস্ট’। বছরের আর পাঁচটা দিন বাঙালি পদ নিয়ে আলাদা করে মাথা না ঘামালেও, নববর্ষের দিন পাতে বিশেষ কিছু পদ বিশ্বনাথের চাই-ই চাই। তবে নববর্ষের দিনটা পরিবারের সঙ্গে ছুটির মেজাজে কাটে অভিনেতার। তাই বাড়িতে কোনও রান্নার পর্ব রাখা হয় না। সকলকে নিয়ে কোনও বাঙালি রেস্তরাঁতেই খেতে যেতে পছন্দ করেন বিশ্বনাথ। বললেন, ‘‘পাতে চিংড়ি পেলে ভাল লাগবে। আমডাল আমার ভীষণ প্রিয়। কোথায় পাওয়া যাবে, সেটাও দেখতে হবে।’’
আরও পড়ুন:
সময়ের সঙ্গে নববর্ষের আমেজ বদলে গিয়েছে। তাই খাবারের প্রসঙ্গে অতীত হাতড়ালেন বিশ্বনাথ। তাঁর ছোটবেলা কেটেছে বসিরহাটের দেশের বাড়িতে। দেশের বাড়িতে নববর্ষে ভগবতী পুজোর স্মৃতি আজও তাঁর মনে টাটকা। পুজোর পর সকালের জলখাবারে থাকত লুচি আর আলুর তরকারি। দুপুরে পাতে থাকত ভাত, আমডাল, এঁচোড়ের তরকারি এবং মাছের ঝোল। বিশ্বনাথ স্মরণ করলেন, ‘‘কেনা মাছ নয়। বাড়ির পুকুর থেকে ধরা মাছের ঝোল। গরম ভাতে তার স্বাদ আজও আমার মুখে লেগে রয়েছে।’’
তন্বী এবং ফিটনেস ফ্রিক হিসাবে ইন্ডাস্ট্রিতে মনামী ঘোষের সুখ্যাতি রয়েছে। তবে পয়লা বৈশাখ বলে নয়, সারা বছর তিনি মূলত বাঙালি খাবারই পছন্দ করেন। মনামীর কথায়, ‘‘দেশের পাশাপাশি বিদেশের বহু জায়গায় ঘুরেছি। নানা ধরনের খাবার চেখে দেখেছি। কিন্তু বাঙালি খাবারের মজা অন্য কোথাও পাইনি।’’
পয়লা বৈশাখে দুপুরের মেনুতে অনেকেই আমিষ খাবার পছন্দ করেন। মনামী বাঙালিয়ানার প্রতি অনুগত থাকলেও ব্যতিক্রমী। জানালেন, দুপুরে তাঁর পাতে থাকবে গোবিন্দভোগ চালের ভাত, পাতলা মুসুর ডাল এবং ঘি। মনামী বললেন, ‘‘সারা বছর এই তিনটে পদ আমার চাই-ই চাই। তার পর মাছ বা মটন, আমের চাটনি— কী থাকল তা নিয়ে আমি বিন্দুমাত্র মাথা ঘামাই না। যেটাই দেওয়া হবে, তৃপ্তি করে খেয়ে নেব।’’
আরও পড়ুন:
উত্তর কলকাতায় বড় হয়েছেন অভিনেতা অম্বরীশ ভট্টাচার্য। নববর্ষের দিনটায় তাঁর কর্মসূচিতে কোনও পরবর্তন ঘটে না। নববর্ষে বাঙালি খাবার অনেকের কাছে ‘দেখনদারি’ তকমা পেয়েছে বলে মনে করেন অম্বরীশ। কিন্তু তাঁর কথায়, ‘‘বাঙালি হয়ে বছরের বিশেষ কয়েকটা দিনে এই বিশেষ দেখনদারিরও প্রয়োজন আছে বলে মনে করি।’’
প্রত্যেক বছর এখনও নববর্ষে পাড়ার প্রভাতফেরিতে অংশ নিয়ে তাঁর দিন শুরু হয়। বাড়ি ফিরেই তাঁর পাতে থাকে লুচি, সাদা আলুর তরকারি, বেগুনভাজা এবং বাড়িতে বানানো মিষ্টি। শহরে মিষ্টির দোকানের সংখ্যা বাড়লেও পরিবারের রীতি আজও অমলিন। অম্বরীশের কথায়, ‘‘ছানার কোনও সন্দেশ তৈরি করা হয়। খুব অসাধারণ খেতে।’’
নববর্ষে দুপুরে অম্বরীশের বাড়িতে ‘মেনু’তে কোনও পরিবর্তন হয়নি এত বছরেও। থাকে বাসন্তী পোলাও এবং পাঁঠার মাংস। অম্বরীশের কথায়, ‘‘মাছের কোনও পদ থাকলে তার সঙ্গে একটু সাদা ভাত চলতে পারে।’’ ভাতের সঙ্গেই থাকে তরকারি দেওয়া ডাল, বেগুনি। শেষ পাতে অভিনেতার পছন্দ লাল মিষ্টি দই।
বিকেলে বাড়িতে আত্মীয়স্বজনের আনাগোনা। তখন থাকে চা এবং মুড়ির সঙ্গে লক্ষ্মী নারায়ণ সাউয়ের (নেতাজির চপের দোকান) দোকানের চপ। সারা দিন গুরুপাকের পর রাতে একটু হালকা খেতে পছন্দ করেন অম্বরীশ। বললেন, ‘‘কালোজিরে দিয়ে আলু-পটলের ছেঁচকি গোছের একটা তরকারি এবং পরোটা। সঙ্গে একটা কোনও রসের মিষ্টি।’’ বাঙালি যে এখন ‘ডায়েট কনশাস’। প্রশ্ন শেষ হওয়ার আগেই রসিক মানুষটি যোগ করলেন, ‘‘যত দিন পর্যন্ত কোনও কঠিন রোগে আক্রান্ত হচ্ছি না, তত দিন পয়লা বৈশাখে আমার এই মেনুর কোনও পরিবর্তন হবে না।’’
অম্বরীশের বাড়ি উত্তর কলকাতায়। তিনি জানালেন, সে অঞ্চলে এখনও কিছু দোকানে হালখাতার রেওয়াজ রয়েছে। তাঁর বাড়িতেও আসে মিষ্টির প্যাকেট। বললেন, ‘‘মিষ্টিগুলো হয়তো খুব স্বাস্থ্যকর নয়। ঠান্ডা নিমকি। কিন্তু এখনও আমি নববর্ষে সে সব নিয়ে কোনও রকম বাছবিচার না করেই খাই। এই বাক্সগুলোয় আমার ছেলেবেলার নবববর্ষের আদর মাখানো থাকে।’’
ব্যস্ত অভিনেত্রী। বছরের অন্য সময়ে ডায়েট করলেও পয়লা বৈশাখ সন্দীপ্তা সেনের কাছে ‘চিট ডে’। বছরের অন্য সময়ে চললেও নববর্ষে বাঙালি বাদে অন্য কোনও ‘কুইজ়িন’ সন্দীপ্তার বাড়িতে প্রবেশ নিষেধ। জানালেন, পেশাগত কোনও কাজ থাকলে, সেখানে কোনও ‘না’ নেই তাঁর। কিন্তু বিয়ের পর থেকে স্বামী সৌম্য মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে পয়লা বৈশাখে মা-বাবার বাড়িতে একসঙ্গে দুপুরে খাওয়াদাওয়া করেন তিনি।
তবে সকলে একসঙ্গে সময় কাটাবেন বলে, বাড়িতে রান্নার কোনও ঝক্কি পোহাতে নারাজ সন্দীপ্তা। কোনও ভাল বাঙালি রেস্তরাঁ থেকে খাবার আনানো হয়। এই দিনে কী কী পদ পছন্দ তাঁর? সংখ্যায় কম হলেও, নামে ভারী সেই সব পদ। সন্দীপ্তার কথায়, ‘‘সাদা ভাতের সঙ্গে চিংড়ি মালাইকারি, ভেটকি মাছের পাতুরি এবং অবশ্যই কষা মাংস।’’ অভিনেত্রী জানালেন, বাকি পদ রেস্তরাঁ থেকে এলেও এ বার পাঁঠার মাংসটা বাড়িতেই রান্না করা হবে।
বাঙালি পদেই যে বর্ষবরণের সার্থকতা, তা প্রায় প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছে এ শহর। বিষয়টির সঙ্গে একমত টলিপাড়ার বিশিষ্টজনেরাও। বছরভর বাঙালি খাবারের সফরের সূত্রপাত তাই পয়লার মাধ্যমেই। ‘আত্মবিস্মৃত’ জাতি তকমা পেলেও, এক দিনের রীতিকে আপন করে নিতে পছন্দ করেন তারকাদের মতো অনেকেই।
- পয়লা বৈশাখ মানেই বাঙালির বাঙালিত্বের উদ্যাপন। সাদা-লাল শাড়ির ফ্যাশন, বাঙালি খাওয়া-দাওয়া, হালখাতা— এই সবই জাগিয়ে তোলে বাঙালির স্মৃতিমেদুরতাকে।
- বছর ঘুরে আবার আসছে বাংলার নববর্ষ। ১৪৩২ আরও অনেক নতুন কিছু নিয়ে আসবে। নববর্ষকে কী ভাবে স্বাগত জানাবে বাঙালি? তারই হাল হদিস।
-
মননে সাহিত্য-শিল্পের বাঙালিয়ানা, বল্লভপুরের রূপকথা শুনবে ক্যাম্পাস শহর
-
কেউ শাড়ি, কেউ সালোয়ার, সাবেক ও সাম্প্রতিকের যুগলবন্দি নববর্ষে, কেমন সাজলেন টলিসুন্দরীরা
-
কাঁধে এক কাঁদি কলা, চুলে হলুদ-বেগনি ফুল, সমুদ্রতটে আঁচল উড়িয়ে নতুন বছরকে স্বাগত স্বস্তিকার
-
বিশেষ দিনে ভিড় করে স্মৃতিমেদুরতা, বর্তমান প্রজন্মও অতীতে চোখ রাখে, নববর্ষে মনে করালেন সোহম
-
দিনের শেষে মেকআপ তুলে ফেলাও জরুরি, ফেসওয়াশ ফুরিয়ে গেলে কী করবেন?