আমেরিকায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলির বিরুদ্ধে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের জেহাদ অব্যাহত। এ বার আক্রমণের মুখে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি— গোটা দুনিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সরকার গত ১৫ এপ্রিল হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির জন্য নির্ধারিত ২০০ কোটি ডলারেরও বেশি সরকারি অনুদান স্থগিত করে এবং প্রতিষ্ঠানটির ‘কর-মুক্ত’ মর্যাদা বাতিল করার হুমকি দিয়ে ফের এক বার খবরের শিরোনামে। নিয়োগ, ভর্তি ও শিক্ষাদান সংক্রান্ত বিষয়ে হার্ভার্ডের কাছে হোয়াইট হাউস যে দাবিদাওয়া পেশ করেছিল, সেগুলো না মানার কারণেই প্রায় চার শতাব্দী-প্রাচীন এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে এই পদক্ষেপ করা হয়েছে, তা নিয়ে সংশয়ের তিলমাত্র অবকাশ নেই।
গত ৩ ও ১১ এপ্রিল হার্ভার্ডকে পাঠানো দু’টি চিঠিতে সরকারি টাস্ক ফোর্স জানিয়েছিল যে, সরকারি অনুদান পেতে হলে হার্ভার্ডকে বেশ কিছু ক্ষেত্রে প্রভূত সংস্কার করতে হবে। যেমন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘পক্ষপাতমূলক’ প্রোগ্রামগুলো পুনর্গঠন করতে হবে; প্রতিবাদসভায় মুখোশ পরা নিষিদ্ধ করতে হবে। এ ছাড়াও আরও কিছু দাবি করা হয়েছে চিঠিগুলোতে— যেমন, বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ্যতা-ভিত্তিক ভর্তি নীতি কার্যকর করতে হবে (যেখানে কোনও জাতি, ধর্ম, বর্ণের অগ্রাধিকার থাকবে না, অর্থাৎ অ্যাফার্মেটিভ অ্যাকশন-কেন্দ্রিক ভর্তি ব্যবস্থা বাতিল করতে হবে); ‘আমেরিকান মূল্যবোধ’-এর প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল নয়, এমন ছাত্রছাত্রীদের চিহ্নিত করে সরকারকে জানাতে হবে; এবং বৈচিত্র, সমতা ও অন্তর্ভুক্তি সম্পর্কিত সমস্ত কর্মসূচি বাতিল করতে হবে। গত দেড় বছরে ‘অ্যান্টিসেমিটিক রুল’ (বা ইহুদি-বিদ্বেষবিরোধী নিয়ম) যারা লঙ্ঘন করেছে, তাদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় কী কী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা করেছে, লিখিত ভাবে জানাতে হবে সে সব কথাও। বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্ত চিন্তা এবং প্রতিবাদী প্রবণতা সব দেশেই সর্বাধিপত্যকামী শাসকের চক্ষুশূল— তাকে দমন করার আগ্রহও তাই সব স্বৈরশাসকেরই প্রবল।
চিঠিগুলোর উত্তরে ১৪ এপ্রিল হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি ঘোষণা করে যে, তারা কোনও রাজনৈতিক চাপের কাছে মাথা নত করবে না। বিশ্ববিদ্যালয় কী পড়াবে, কী বিষয়ে গবেষণা করবে বা ক্যাম্পাসে কী সহ্য করা হবে— কোনও প্রশাসন তা নির্ধারণ করতে পারে না। দ্ব্যর্থহীন ভাষায় এই ঘোষণার ঠিক পরের দিনই অনুদান স্থগিতের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয় ট্রাম্প সরকারের পক্ষ থেকে। টাকা বন্ধ করে বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘাড় ধরে পথে আনার প্রবণতাটিও— ডোনাল্ড ট্রাম্প দেখিয়ে দিচ্ছেন— উন্নত এবং উন্নয়নশীল দুনিয়ায় একই রকম।
কিছু দিন আগে আমেরিকার আর এক স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয় কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটিকেও ট্রাম্প সরকার হুমকি দেয়, নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে তাদের দেওয়া শর্ত পূরণ না হলে ৪০ কোটি ডলার অনুদান বন্ধ করে দেওয়া হবে। তবে হার্ভার্ডের মতো ট্রাম্প সরকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারেনি কলাম্বিয়া। অনুদান যাতে বন্ধ না হয়ে যায়, সেটা নিশ্চিত করতে প্রশাসনের বেঁধে দেওয়া সময়সীমার আগেই ট্রাম্প সরকারের একাধিক অযৌক্তিক এবং হাস্যকর দাবি মেনে নেয় তারা। গত দু’মাস সে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে চলছে নির্বিকল্প ত্রাসের রাজত্ব। বিপুল পরিমাণ তহবিল, আন্তর্জাতিক খ্যাতি এবং যথেষ্ট আইনি সুরক্ষা থাকা সত্ত্বেও হার্ভার্ড এবং কলাম্বিয়াই যদি রাষ্ট্রের রোষের শিকার হয়, তা হলে আমেরিকায় ছড়িয়ে থাকা শয়ে শয়ে ছোট এবং মাঝারি বিশ্ববিদ্যালয় বা গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলির এই মুহূর্তে অবস্থা যে কী, তা সহজেই অনুমেয়। সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক বিরোধে লিপ্ত হওয়ার মতো রসদ কিংবা শক্তি কোনওটাই তাদের নেই। প্রশাসনের বশ্যতা স্বীকার না করলে তাদের অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে উঠবে, এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে কি?
সোজা কথা সোজা ভাবে বলাই ভাল— বিশ্ববিদ্যালয়গুলির বিরুদ্ধে এই আক্রমণ ট্রাম্প সরকারের হঠাৎ করে নেওয়া কোনও সিদ্ধান্ত নয়। এটি বহু দিনের একটি পরিকল্পনার অংশমাত্র। ট্রাম্প সরকারের প্রথম মেয়াদকালেই এই পরিকল্পনার প্রাথমিক রূপায়ণ দেখা গিয়েছিল। সেই সময় সরকারের ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিস হার্ভার্ডের ‘অ্যাফার্মেটিভ অ্যাকশন’ নীতির বিরুদ্ধে মামলা করে, বৈচিত্রমূলক প্রশিক্ষণ এবং বিদেশি পড়ুয়াদের ভিসার উপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয় এবং যে সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয় তাদের পঠনপাঠন ও গবেষণায় সামাজিক ন্যায়বিচার, বৈচিত্র এবং অন্তর্ভুক্তিকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়, তাদের উপর ধারাবাহিক আক্রমণ চালানো হয়।
এই পরিকল্পনা যে দর্শনের উপর দাঁড়িয়ে সেটা হল— বিশ্ববিদ্যালয় যদি রাষ্ট্রের অনুগত না হয়, তা হলে অবশ্যই রাষ্ট্রের শত্রু। স্বায়ত্তশাসন, বহুত্ববাদ বা ভিন্নমতের স্থান নেই। এই দর্শনে শিক্ষা ও জ্ঞানকে সত্যের সন্ধান হিসাবে দেখা হয় না। বরং ভাবা হয়, শিক্ষা ও জ্ঞানের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে রাজনৈতিক হাতিয়ার হয়ে ওঠার, যা ব্যবহার করে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা যায়। এই দর্শন অনুযায়ী সরকারি অনুদান বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগ্যতা, প্রয়োজন বা জনস্বার্থের উপরে নির্ভর করে না। বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সরকারের আদর্শগত মিল আছে কি না, সেটাই বিবেচ্য হয়ে ওঠে। এই দর্শনে গভীর ভাবে বিশ্বাসী বলেই ট্রাম্প প্রশাসন চাইছে, হুমকি দিয়ে আমেরিকার গোটা উচ্চ শিক্ষাক্ষেত্রটাকে পুরোপুরি রাষ্ট্রের অনুগত করে তুলতে, যেখানে কেবল সম্মতিকেই পুরস্কৃত করা হবে।
এই পরিস্থিতিতে হার্ভার্ডের অনমনীয় অবস্থান তাৎপর্যপূর্ণ। এটি এই ইঙ্গিত দেয় যে, অন্তত কিছু প্রতিষ্ঠান নীতিগত অবস্থানে অনড় থেকে বস্তুগত ক্ষতির ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত। মনে করিয়ে দেয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতা— ঠিক বিচারব্যবস্থা বা সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার মতোই— টিকে থাকে তখনই, যখন তা অনুশীলিত হয়। লেনদেনের ভিত্তিতে এই স্বাধীনতা নির্ধারিত হয় না, হতে পারে না। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, হার্ভার্ডের পক্ষে সরকারের রক্তচক্ষুকে অবজ্ঞা করা তুলনায় সহজ— সে বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট সম্পদের পরিমাণ প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি ডলার। কিন্তু, সে তহবিল বিপুল হলেও সীমাহীন নয়। ফলে, হার্ভার্ডের এই অবস্থানের স্থায়িত্ব কত দিন, সে প্রশ্ন থেকেই যায়। এবং আরও গুরুত্বপূর্ণ হল, হার্ভার্ড যদি একা রুখে দাঁড়ায়, আর অন্যরা— বিশেষ করে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো— চুপ করে থাকে, তবে তাদের এই অবস্থানের বিশেষ তাৎপর্য থাকবে না।
বিশ্ববিদ্যালয় নিঃসন্দেহে ত্রুটিহীন কোনও প্রতিষ্ঠান নয়। ক্ষমতা, বৈষম্য, রাজনীতি— সবই এর গঠন ও নীতিকে প্রভাবিত করে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও ছাত্র-অন্তর্ভুক্তি নিয়ে নিজেদের অস্বচ্ছ ও অসমান অবস্থানের জন্য হার্ভার্ডও বিভিন্ন সময়ে সমালোচিত হয়েছে। কিন্তু হার্ভার্ড এবং তাদের মতো অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় আজ যে বৃহত্তর বিপদের সামনে দাঁড়িয়ে, এই দোষত্রুটিগুলো যেন সে সত্যটাকে আড়াল না করে। আসল ভয় হচ্ছে সেই পরিবেশের অবলুপ্তি, যা বিশ্ববিদ্যালয়কে নিজের ভুল সংশোধন করার মতো স্বায়ত্তশাসিত পরিসর দেয়। আর সেটা সম্ভব কেবল তখনই, যখন তাদের বৌদ্ধিক, রাজনৈতিক ও আর্থিক স্বাধীনতা থাকে।
এই মুহূর্তে শুধু প্রতীকী প্রতিরোধ যথেষ্ট নয়। যদি অভিজাত প্রতিষ্ঠানগুলো কেবল নিজেদের জন্য লড়াই করে, তবে তারা সেই নৈতিক জমি হারাবে, যার উপরে দাঁড়িয়ে তারা কথা বলে। হার্ভার্ডকে কেবল নিজের স্বায়ত্তশাসনের জন্য নয়, সেই বৃহৎ শিক্ষা ও গবেষণা ব্যবস্থার পক্ষে দাঁড়িয়ে কথা বলতে হবে, যা নিরপেক্ষতার নীতির উপর দাঁড়িয়ে আছে। যুক্তি দিতে হবে যে, সরকারি অনুদান জাতীয় স্বার্থে দেওয়া হয়— এবং তা কখনওই রাষ্ট্রের অনুগত করে তোলার অস্ত্র হয়ে উঠতে পারে না। হার্ভার্ডের মতো বড় এবং শক্তিশালী বিশ্ববিদ্যালয়গুলির দায়িত্ব সাধারণ মানুষকে বোঝানো যে, শিক্ষা এবং গবেষণায় স্বাধীনতা সবার জন্যই মঙ্গলজনক— বিজ্ঞানীদের জন্য, ইতিহাসবিদদের জন্য, অর্থনীতিবিদদের জন্য, এমনকি সেই ছাত্রছাত্রীদের জন্যও, যাঁরা সাহস করে অস্বস্তিকর প্রশ্ন তোলেন।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নীরবতা— বা আরও খারাপ, আপস— এই হুমকির সামনে তাঁদের রক্ষা করবে না। বরং তা আরও বড় আঘাতের পথ সুগম করবে। কলাম্বিয়ার প্রাথমিক পদক্ষেপ হয়তো তাৎক্ষণিক সঙ্কট এড়াতে সাহায্য করেছে তাঁদের, কিন্তু এর ফলে এক বিপজ্জনক নজির স্থাপিত হয়েছে, যেখানে দমননীতি মেনে নেওয়াই টিকে থাকার প্রধান শর্ত হয়ে দাঁড়ায়। এক বার সেটা হলে প্রতিটি ছাত্র আন্দোলন, বিতর্ক সভা বা গবেষণাই শাস্তির সম্ভাব্য কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
হার্ভার্ডের সঙ্কট এক সতর্কবার্তা দেয়। এখানে প্রশ্ন শুধুমাত্র একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুদান বন্ধ হওয়া নিয়ে নয়, বরং বৃহত্তর অর্থে এই যে— উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলো কি আদৌ মুক্ত চিন্তা, মতপার্থক্য ও গণতান্ত্রিক বিতর্কের ক্ষেত্র হিসেবে গণ্য হতে পারবে আর? যদি আমরা অনুদানকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপরে সরকারের আদর্শ চাপিয়ে দেওয়া হাতিয়ার হয়ে উঠতে দিই, শুধু হার্ভার্ড কিংবা কলাম্বিয়া নয়— উচ্চশিক্ষার সমগ্র ক্ষেত্রটাই অচিরেই ভেঙে পড়বে তাসের ঘরের মতো। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা কী ভাবে ধ্বংস করে দিতে পারে একটা বিশ্বমানের প্রতিষ্ঠানকে, ভারতবাসী গত এগারো বছরে কি সে কথাটি টের পায়নি?
অর্থনীতি বিভাগ, শিব নাদার বিশ্ববিদ্যালয়
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)