বাঘডুংরি, বেলডুংরি, বামনডুংরি...
ছোট ছোট টিলার সারি। পিছনের ক্যানভাসের রং সবুজ। শালের জঙ্গলে নতুন পাতার কচি কলাপাতা রং সেই ক্যানভাসের সবুজকে বেশি গাঢ় হতে দেয়নি। রোদের তেজ ততটা না হলেও দাঁড়ে বসা টিয়ার মতোই যেন ঝিমোচ্ছে বেঠুয়ালা শবরপাড়া।
কিন্তু খাতড়া, রানিবাঁধ হয়ে জঙ্গলের কোলঘেঁষা এই গ্রামে পা দেওয়া ইস্তক বৈসাদৃশ্যটা বড্ড চোখে প়ড়ছে!
গেরুয়া রঙের মাটির ঘরের সারির ফাঁকে ফাঁকে এক একটা ঘরের রং সাদা আর তাতে নীল রঙের বর্ডার। ঘর না বলে ‘ঘরের মতো’ বলাটাই সুপ্রযুক্ত। কুঞ্চিত বলিরেখার মতো সে ঘরের দেওয়াল। মাথার উপর অ্যাসবেস্টসের ছাদ। এলোমেলো আঁকাবাঁকা কাঠের ভরসায় রয়েছে সেই অ্যাসবেস্টস। কোনও কোনও ঘরের দরজা ইতিমধ্যেই ভেঙে পড়েছে। ‘গীতাঞ্জলী’ প্রকল্পের টাকায় শবরদের এই গ্রামে তৈরি হয়েছে এই সব ঘর। প্রতিটির জন্য বরাদ্দ ৭৫ হাজার টাকা। তৈরির সময়কাল ২০১৫-’১৬। অনিল শবরের ঘরের দরজা ভেঙে পড়েছে এর মধ্যেই। আব্রু রাখতে সে ঘরের দরজায় ছেঁড়া মশারি টাঙানো। তাঁর স্ত্রী বলেন, ‘‘দেখে যাও, কী ভাবে থাকি। জঙ্গলের জানোয়ারদের ভয় পাওয়ার অধিকার নেই আমাদের? লাজলজ্জাও নেই?’’
লাজলজ্জা? কার? প্রশ্নটা বেঠুয়ালা শবরপাড়ার। মুখ্যমন্ত্রীর পছন্দের নীল-সাদায় যে ঘর মুড়ে দেওয়া হয়েছে, সে ঘরের প্রকৃত ব্যয় নিয়ে চুপিসাড়ে প্রশ্ন তোলে বেঠুয়ালা। গ্রামেরই এক যুবক বলে, ‘‘পয়সা থাকলে ওই রং মুছে দিয়ে নিজেদের পছন্দের রং লাগাতাম।’’ তাঁর নিজের মাটির বাড়ির দেওয়ালে যে অপূর্ব আলপনা দেওয়া আছে, তা দেখলেও অবশ্য এই হতদরিদ্র গ্রামের প্রান্তিক মানুষগুলোর শৈল্পিক বোধ সম্পর্কে শ্রদ্ধা জাগে।
একশো দিনের কাজ নিয়ে এখানেও বিস্তর অভিযোগ। গ্রামের বাসিন্দা সুনীল শবরের কথায়: ‘‘গত বছর ১৪-১৫ দিনের কাজ পেয়েছিলাম। কিন্তু সে পয়সাও এখনও পাইনি।’’ চলছে কী ভাবে? এ বারের খরার মধ্যে চাষবাস ঠিকমতো হয়েছে? সুনীল বলেন, ‘‘কাজ নেই নিয়মিত। ফরেস্টের কাজ করি ঠিকায়। জঙ্গলের কাঠ বেচে সংসার চালাই।’’ ধীরে ধীরে সুনীলের পাশে এসে দাঁড়ান অনেকেই। ভিড়ের মুখ হয়ে বৃদ্ধা বুলি শবর বলেন, ‘‘বিধবাভাতা পাই না, বার্ধক্যভাতা পাই না, ভোট দিয়ে কী হবে?’’ তবুও ভিড়ের অন্য মুখগুলো বলে, ‘‘তা হলেও ভোট তো দিতে হবে?’’ ফুলমণির অভিযোগ, ‘‘২ টাকা কেজি দরে চাল দিচ্ছে। আমাদের চারটে কার্ড, চাল পাওয়ার কথা আট কেজি। অথচ, দিচ্ছে ৬ কেজি।’’ নেতারা এলে বলবেন এ কথা। ‘‘নেতারা? তাঁরা কোথায়?’’ ভোটের প্রচারেরও আকাল পড়েছে এই তল্লাটে। বিভিন্ন গ্রামের বাড়ির দেওয়ালই অকলঙ্কিত। বরং, জেলা নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে ভোট দেওয়ার প্রচারসম্বলিত কয়েকটি পোস্টার মারা আছে সেখানে।
গণতান্ত্রিক কুচকাওয়াজের আড়ালে কেমন আছে জঙ্গলমহল? যে রানিবাঁধকে আগে দেখেছি আতঙ্কের ঘেরাটোপে থাকতে, সেই রানিবাঁধ এখন অবশ্য অনেকটাই পাল্টেছে। রাস্তা হয়েছে ঝাঁ চকচকে। প্রত্যন্ত বেশ কিছু গ্রামে বিদ্যুৎ এসেছে।
তা সত্ত্বেও অস্বস্তি কাটে না কেন সুতানের? জঙ্গলমহলের এই সুতান গ্রামটি বিখ্যাত বা কুখ্যাত অন্য কারণে। বেশ কয়েকটি পাড়া নিয়ে এই সুতান। নীচপাড়া, উপরপাড়া, আমডাঙা, মহুলডাঙা। উপরপাড়ার বাসিন্দা মানিক সর্দার জানালেন, উপরপাড়ায় তিনটে নলকূপ আছে বটে, তবে সেগুলির গভীরতা মেরেকেটে ১৮০ ফুট। জলস্তরের যা অবস্থা তাতে অন্তত ৩০০ ফুট খোঁড়ার দরকার ছিল বলে মনে করেন মানিকবাবুর মতো আরও অনেকেই। কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে ৯ কিলোমিটার দূরে রানিবাঁধ ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যেতে হয়।
সুতানের পরিত্যক্ত সেই ক্যাম্প। ছবি: দেবব্রত দাস।
গ্রাম থেকে বেরিয়ে জঙ্গলের পথে বেশ কিছুটা গেলে সুতান ক্যাম্প। ছিল। এখন আর নেই। একসময় এটা ছিল রাজ্য পুলিশের ‘স্ট্র্যাটো ফোর্স’-এর ক্যাম্প। এখন পড়ে আছে ক্যাম্পের কঙ্কাল। শিলদার ইএফআর ক্যাম্পে মাওবাদী হামলার পরে রাজ্য সরকার সিদ্ধান্ত নেয়, সুতানের এই ক্যাম্পটিও তুলে দেওয়া হবে। যে মাওবাদীদের গতিবিধি রোধে এই ক্যাম্প বসানো হয়েছিল, তুলে নেওয়ার ঠিক পরে সেই মাওবাদীরাই এই ফাঁকা ক্যাম্পে ভাঙচুর চালিয়ে আগুন লাগিয়ে দেয়।
চতুর্দিকে শাল-পিয়াল-পলাশ-মহুল-আমের জঙ্গলের মধ্যে প্রায় মুখ থুবড়ে পড়ে আছে ফাঁকা ক্যাম্প। ফুল অনেকটাই ঝরে গিয়েছে পলাশের, তবু কয়েকটি রুদ্রপলাশের ফুল যেন মশালের মতো আকাশমুখী। পিছনে রান্নাঘর, বাথরুম, অফিসার্স মেস পরিত্যক্ত অবস্থায় দাঁড়িয়ে। কাঁটাতারের নিরর্থক বেড়া থেকে গিয়েছে এখনও। মাথা উঁচু করে রয়েছে মরচে পড়া লোহার ওয়াচ টাওয়ার। সেই নিঝুম, খণ্ডহর হয়ে যাওয়া জনমানবহীন ক্যাম্পের খোলা চত্বরে দাঁড়িয়ে মনে হল, অপার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যেরও বুঝি আর একটা ভয়াল রূপ থাকে!
গণতান্ত্রিক কুচকাওয়াজের আড়ালেও কি থাকে এ রকমই কোনও ভয়াল রূপ? সুতান গ্রাম ফিসফিস করে জানায়, তার মনে হয় কেউ যেন আড়াল থেকে নজর রাখছে। রাতের অন্ধকারে শালের জঙ্গলের আড়াল নিয়ে কেউ বা কারা যেন চলে যাচ্ছে এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত!
তা হলে কি এখনও বিষাদে আছে জঙ্গল?
ছবি: দেবব্রত দাস।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy