চন্দ্রনাথ সিংহ, অনির্বাণ গঙ্গোপাধ্যায়, তপন হোড়
বোলপুর-শান্তিনিকেতন রোডের ঠিক যেখান থেকে কবিগুরু হস্তশিল্প মার্কেটের শুরু, তার আগেই লোহার বড় নতুন গেটটা দেখে এখন বোঝার জো নেই, গত বছর অগস্টে জনরোষে এটাই ভেঙে গুঁড়িয়ে গিয়েছিল!
নতুন করে তৈরি হওয়ার পরে একটা নাম পেয়েছে সেই গেট—‘চিত্রা’। স্থানীয় ভাবে অবশ্য ‘সেকেন্ড গেট’ হিসেবেই বেশি পরিচিত বিশ্বভারতীর পৌষমেলা মাঠের এই দ্বিতীয় তোরণদ্বার। মেলামাঠ পাঁচিল দিয়ে ঘিরে ফেলার প্রতিবাদেই গত বছর অগস্টে এই গেট ভেঙেছিল জনতা। তাতে নাম জড়িয়েছিল তৃণমূলের বিধায়ক থেকে নেতাদের। ওই ঘটনার ছ’মাস পেরিয়ে বীরভূমের বিধানসভা নির্বাচনেও এই গেট এবং বিশ্বভারতী ভীষণ রকম প্রাসঙ্গিক। এতটাই যে, বিজেপি, তৃণমূল, সংযুক্ত মোর্চা—যুযুধান সব পক্ষের প্রচারেই বিশ্বভারতী।
এই ভোটে ‘খেলা হবে’ স্লোগান আছে, উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি আছে, রান্নার গ্যাস ও পেট্রোল-ডিজেল নিয়ে কেন্দ্রকে বেঁধা আছে, পাল্টা কাটমানি ও দুর্নীতি নিয়ে রাজ্যের শাসকদলকে আক্রমণও আছে। কিন্তু, সে-সব ছাপিয়ে বোলপুর শহরের ভোট-প্রচার জুড়ে রয়েছে এ রাজ্যের একমাত্র কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়। এক প্রবীণ আশ্রমিক আক্ষেপ করছিলেন, ‘‘বিজেপি, তৃণমূল দু’দলই গ্রাস করেছে কবিগুরুর সাধের বিশ্বভারতীকে।’’
২০১৯-এর লোকসভা ভোটের ফলের নিরিখে বোলপুর বিধানসভা কেন্দ্রে এগিয়ে থাকলেও শহর বোলপুরে বিজেপি-র চেয়ে অনেকটাই পিছিয়ে (প্রায় ১১ হাজার ভোটে) তৃণমূল। বীরভূম জেলা তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের পক্ষে যা ‘অগৌরবের’ বটেই। এ শহর যে তাঁর খাসতালুক! সেখানেই ভোটে পিছিয়ে থাকাটা যেমন মুদ্রার এক দিক, তেমনই এটাও ঠিক যে, লোকসভা ভোটের পরবর্তী দু’বছরে বিশ্বভারতীর বর্তমান কর্তৃপক্ষের একাধিক ‘হঠকারী’ সিদ্ধান্তকে হাতিয়ার করে আন্দোলন করে এই তল্লাটে নিজেদের পায়ের জমি কিছুটা পোক্তও করেছে শাসকদল।
তৃণমূলের ভোট-প্রচার জুড়েও তাই বিশ্বভারতী। তারা সরাসরি অভিযোগ তুলছে, বিশ্বভারতীর বর্তমান উপাচার্য বিজেপি-র ঘনিষ্ঠ। এবং তাঁর পরের পর সিদ্ধান্ত বোলপুরের মানুষকে, পর্যটন ব্যবসাকে অপূরণীয় ক্ষতির সামনে দাঁড় করিয়েছে। তৃণমূল বলছে, টোটো চালক থেকে হস্তশিল্প ব্যবসায়ী, হস্তশিল্পর মার্কেটে শাড়ির পসরা সাজিয়ে বসা দোকানি থেকে ছোট-বড় হোটেল—সব পক্ষের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে বিশ্বভারতীর জন্য। শহরের নিচুপট্টি এলাকায় দলীয় কার্যালয়ের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে বসে বিদায়ী মন্ত্রী, এ বারেও তৃণমূল প্রার্থী চন্দ্রনাথ সিংহ বলে দিচ্ছেন, ‘‘রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন বিশ্বভারতীকে কেন্দ্র করে আশেপাশের গ্রাম ও শহরগুলির অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াক। বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ সেই স্বপ্নের ভিত্তিটাকেই ধ্বংস করে দিচ্ছেন!’’
বিশ্বভারতীরই প্রাক্তনী চন্দ্রনাথবাবু যে খুব ভুল বলছেন না, শহরটা চক্কর মারলেই বোঝা যাবে। বিশ্বভারতীর বিভিন্ন খামখেয়ালি সিদ্ধান্তে তাঁরা অসন্তুষ্ট, সে কথা কেউই গোপন করছেন না। যেমন পৌষমেলা বন্ধ করা। স্রেফ এই মেলাকে কেন্দ্র করে ডিসেম্বর মাস জুড়ে বোলপুর শহরে ১০০ কোটি টাকারও বেশি আর্থিক লেনদেন হয় বলে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানালেন। ‘‘এত বড় ব্যবসা বিশ্বভারতীর খামখেয়ালি সিদ্ধান্তের জন্য পুরোপুরি মার খাচ্ছে। এর ফলে, পর্যটক আসাও কমে গিয়েছে। পাল্লা দিয়ে কমেছে ব্যবসায়ীদের বিক্রিবাটা।”—দাবি করলেন কবিগুরু হস্তশিল্প উন্নয়ন সমিতির সম্পাদক আমিনুল হুদা। ব্যবসায়ীদের বড় অংশের অভিযোগ, গত দু’বছরে এমন অনেক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ, যা সরাসরি তাঁদের রুটি-রুজিতে প্রভাব ফেলেছে।
আর রুজির প্রশ্ন যেখানে, সেখানে বিজেপি, তৃণমূলও এক হয়ে যাচ্ছে। সাধে কী আর বোলপুরের হেভিওয়েট বিজেপি প্রার্থী অনির্বাণ গঙ্গোপাধ্যায়কে ভোটের প্রচারে নেমে বিশ্বভারতীর বিরুদ্ধেই পাল্টা অভিযোগ তুলতে হচ্ছে! নির্বাচনের কাজে বোলপুর লজের একটা বড় অংশ নিয়েছে বিজেপি। সেখানে দিবারাত্র কাজ করে চলেছে দলের আইটি সেল। তৃণমূলের অভিযোগের কথা জেনে তাঁর স্পষ্ট কথা, ‘‘বোলপুর শহরের সামান্য বাইরে যান, দেখবেন বিশ্বভারতীর নামগন্ধও পাবেন না!’’ একই সঙ্গে দাবি করলেন, ‘‘শহর লাগোয়া আদিবাসী গ্রামে পানীয় জল, শৌচালয়ের মতো ন্যূনতম সুযোগসুবিধা থেকে আজও মানুষ বঞ্চিত। কিন্তু, শাসকদলের ভয়ে তাঁরা কিছু বলতে পারেন না। এখন বলছেন। আমাকে শুনতে হচ্ছে।’’
সেই অনির্বাণবাবুকেও কিন্তু সাংবাদিক বৈঠক করে বিশ্বভারতীর উপাচার্যের সঙ্গে তৃণমূলের ‘আঁতাঁত’-এর দাবি তুলতে হচ্ছে। একই সঙ্গে তৃণমূলের ‘খেলা হবে’ স্লোগানকে কটাক্ষ করে তিনি বলে চলেছেন, “খেলা হবে না, এখানে আবার পৌষ মেলা হবে। আবার বসন্ত উৎসব হবে।” বস্তুত, সচেতন ভাবেই বিশ্বভারতীর নানা সিদ্ধান্ত থেকে নিজেকে ‘আলাদা’ করার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছেন শ্যামপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় রিসার্চ ফাউন্ডেশনের এই অধিকর্তা। অন্য দিকে, এই কেন্দ্রের প্রাক্তন বিধায়ক, সংযুক্ত মোর্চার হয়ে আরএসপি প্রার্থী তপন হোড় বিশ্বভারতীর বর্তমান ‘অবনমন’-এর জন্য কেন্দ্র ও রাজ্য, দুই সরকারের শাসকদলকেই বিঁধছেন।
ভোটের বোলপুরে ঠিক এতটাই প্রভাব বিশ্বভারতীর!
এমন পরিস্থিতিতে, শহর বোলপুরে লোকসভার ‘লিড’ কিছুটা স্বস্তিতে রাখলেও বিজেপি-র ‘কাঁটা’ ইলামবাজার। বোলপুর বিধানসভার অন্তর্গত যে তল্লাট পুরোটাই গ্রামীণ। সেখানেও অনির্বাণবাবুর ‘কঠিন লড়াই’। কারণ, লোকসভা নির্বাচনে ইলামবাজার ব্লক থেকে তৃণমূল ‘লিড’ পেয়েছিল সাড়ে ২৭ হাজার ভোটেরও বেশি। ২০১৬-র তুলনায় তা প্রায় অর্ধেক হলেও শাসকদলের ভিত এখনও যথেষ্ট মজবুত সেখানে। বস্তুত, ইলামবাজারের সৌজন্যেই বোলপুর আসনে জিততে পেরেছিলেন চন্দ্রনাথবাবু। এ বারও তৃণমূলকে এগিয়ে রাখছে এই ইলামবাজারই। বিজেপি প্রার্থী নিজেও বিলক্ষণ বুঝছেন, শুধু বোলপুর শহর দিয়ে হবে না, এ যুদ্ধে জিততে ইলামবাজারকেও পাশে চাই। তাই তাঁকে বারবার ছুটতে হচ্ছে সেখানে।
এটা ঘটনা যে, লোকসভার পর থেকে সেখানে প্রভাব বাড়িয়েছে বিজেপি। বেশ কিছু অঞ্চল এখন বিজেপি প্রভাবিত। সঙ্গে কাটমানি ও দুর্নীতি নিয়ে সাধারণ মানুষের বিস্তর অভিযোগ। ধরমপুর অঞ্চলের উপর দেলোড়া গ্রামে ঢুকতেই চোখে পড়বে এক পেল্লায় আড়াই তলা বাড়ি। গ্রামবাসীরাই জানালেন, সে বাড়ি তৃণমূলের এক ‘বড়’ নেতার। ৮-১০ কাঠা জমি নিয়ে বিশাল সীমানা পাঁচিল তুলেছেন সেই নেতা। নাম না দেওয়ার শর্তে গ্রামের এক বাসিন্দা বললেন, ‘‘এই নেতার এক সময় এমন অবস্থা ছিল যে, তাঁর মেয়েকে আমি নিখরচায় টিউশন পড়িয়েছি। তখন ওঁর চালাঘর। আর আজ দেখুন!’’ এমন ক্ষোভ ইলামবাজারের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তৃণমূলের দুশ্চিন্তার আর এক কারণ, দলের দ্বন্দ্ব। ফলে, সারা দিনের প্রচার সেরে প্রায়ই রাতে ইলামবাজার ছুটছেন চন্দ্রনাথবাবু। মিটিং করছেন দলের ব্লক সভাপতি-সহ অন্য নেতাদের সঙ্গে। বারবার বার্তা দিচ্ছেন, সকলকে একসঙ্গে হয়ে কাজ করার।
আসলে এই আসনে সরাসরি লড়াইটা যতটা বিজেপি ও তৃণমূলের, ঠিক ততটাই শহর ও গ্রামের। শহর-গ্রামের ভোটের অঙ্কেই বোধহয় লুকিয়ে বোলপুর জয়ের চাবিকাঠি!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy