প্রতীকী ছবি।
গাইঘাটা, বনগাঁ উত্তর ও দক্ষিণ এবং বাগদা— এই চার বিধানসভা কেন্দ্রে ‘দিদির অফিসিয়াল চোখ’ তিনিই। সেই চোখে লোকসভা ভোটে পিছিয়ে থাকা বনগাঁ মহকুমার চারটি সংরক্ষিত আসনে এ বারের বিধানসভা ভোটে জয়ই দেখছেন গোপাল শেঠ। সকাল থেকে মাঝরাত পর্যন্ত নিজের হিসেব সেই দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন।
লোকসভা ভোটে এই চারটি আসনে গড়ে ৩০ হাজার ভোটে পিছিয়ে ছিল তৃণমূল। সেখানে এই আশার আলোর উৎস কী?
বাংলাদেশ লাগোয়া এই অঞ্চলে নাগরিকত্বের প্রতিশ্রুতিকে সামনে রেখে লড়াইয়ের একটা ভিন্ন ধরন আগেই তৈরি করে দিয়েছে বিজেপি। তাদের সেই প্রতিশ্রুতিকে কেন্দ্র করে এই বৃত্তের চারপাশেই ঘুরছে তৃণমূল। সভা-সমিতিতে তৃণমূলের নেতারা বলে বেড়াচ্ছেন নাগরিকত্ব নিয়ে অসমের পরিস্থিতির কথা। সেই অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বিজেপির বিপদ ব্যাখ্যা করছেন তাঁরা। নাগরিকত্বের প্রশ্নে জনসমর্থন নিজেদের দিকে রাখতে না-পেরে বারবার এই অঞ্চলে এসেছেন এবং সভা করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে।
তৃণমূলের বনগাঁ মহকুমার দলীয় কোঅর্ডিনেটর গোপাল বলছেন, ‘‘উদ্বাস্তু ও মতুয়াদের ভুল বুঝিয়ে লোকসভা ভোটে জিতেছিল বিজেপি। কিন্তু এনআরসি-এনপিআর নিয়ে অসমের অভিজ্ঞতা তাঁরা জানেন। এখানকার উদ্বাস্তু মানুষ তাই বিজেপিকে ভয় পাচ্ছেন। আমরা বলছি, অসমের মতো এখানেও ডিটেনশন ক্যাম্পে রাখা হবে।’’ এ ছাড়া, তৃণমূল সরকারের জনমুখী প্রকল্পগুলির কথা বলছেন তাঁরা। সেই সঙ্গে, আর এক প্রতিপক্ষ সিপিএমের কাছে দলের ‘প্রত্যাশা’— এই সব মিলিয়েই সীমান্তের এই চারটি আসনে জয়ের সম্ভাবনা দেখছে তৃণমূল।
এই রকম পথ-পরিকল্পনায় তৃণমূলের জয়ের সম্ভাবনা দাবি করলে, তাকে বাহ্যিক ভাবে খুব একটা অস্বাভাবিক মনে হবে না। কিন্তু এনআরসি-এনপিআর নিয়ে তৃণমূলের যে বিজেপি-বিরোধী প্রচার, তা অনেকটা ঘুরিয়ে দিয়ে এগোতে চাইছে বিজেপি। অসমের ঘটনাবলি এবং তা নিয়ে সারা দেশে বিরোধীরা যে প্রচার করেছেন, তার সামনে কৌশল বদল করতে হয়েছে তাদের। প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থেকে শুরু করে বিজেপির পাড়ার নেতারা পর্যন্ত এখন বলছেন, কেন্দ্রীয় সরকার এখন নাগরিকত্ব দেওয়ার আইন বা সিএএ বলবৎ করতে চাইছে।
পরস্পরের দিকে আক্রমণের তির শানাতে তৃণমূল ও বিজেপি দুই তরফে মতুয়া সম্প্রদায় বা উদ্বাস্তুদের বিশ্বাস অর্জনে চেষ্টায় ত্রুটি নেই। তৃণমূল যেমন ঠাকুরবাড়ির পুত্রবধূ মমতা ঠাকুরকে সামনে রেখেছে, তেমনই বিজেপির তরফে এই অংশের জন্য আছেন গত লোকসভা নির্বাচনে বনগাঁ কেন্দ্রে বিজয়ী ঠাকুরবাড়ির ছেলে শান্তনু ঠাকুর। এ বার গাইঘাটায় তাঁর আর এক ভাই সুব্রতকেও প্রার্থী করেছে বিজেপি।
নাগরিকত্ব দেওয়া বা কেড়ে নেওয়ার এই চাপানউতোর সীমান্ত মহকুমা বনগাঁর চারটি কেন্দ্রে গুরুত্বপূর্ণ। তা নিয়ে নির্বাচনী তরজায় যে দল এগিয়ে যেতে পারবে, তার এক দিক থেকে সুবিধা হবে। কারণ, নাগরিকত্বের নতুন আইন নিয়ে মানুষের সংশয় দূর করতে বারবার ঠাকুরবাড়িকে সাক্ষী রেখে প্রতিশ্রুতি দিতে হয়েছে প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে।
এ ছাড়া, তৃণমূল সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প দলকে সুবিধা দেবে বলেই মনে করছেন তৃণমূলের প্রার্থীরা। স্থানীয় কলাসীমা বাজারে সে কথাই বলছিলেন এক দোকানি। তাঁর কথায়, ‘‘ক্ষমতায় এসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বহু প্রকল্পে মানুষ সরাসরি সুবিধা পেয়েছে। এলাকারও বেশি কিছু কাজ হয়েছে।’’ যশোর রোডের সম্প্রসারণ আর ইছামতীর সংস্কার নিয়ে অসন্তোষ থাকলেও, এই পাওয়া, না-পাওয়া তৃণমূলের জন্য খুব বেশি অস্বস্তি তৈরি করেনি। তৃণমূলকে এ সব নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে আমপানের পরে। স্বজনপোষণ ও দুর্নীতির পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্তদের বড় সংখ্যক মানুষ সরকারি সাহায্য না-পাওয়ায় অসন্তুষ্ট।
সেই অভিযোগই করছেন সিপিএমের বনগাঁ মহকুমার দায়িত্বে থাকা নেতা, প্রাক্তন বিধায়ক পঙ্কজ ঘোষ। তাঁর কথায়, ‘‘তৃণমূল যে দুর্নীতি করেছে, তা খুঁজে বার করার দরকার হবে না। প্রতিটি ক্ষেত্রে মানুষ তা প্রত্যক্ষ করেছেন।’’ একই কথা বলছেন সদ্য তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যাওয়া বনগাঁর বিধায়ক বিশ্বজিৎ দাস। এ বার তিনি বাগদার বিজেপি প্রার্থী। তিনি বলেন, ‘‘শুধু আমপান নয়, ক্ষমতায় আসার পর থেকে ধারাবাহিক ভাবে দুর্নীতি প্রশ্রয় পেয়েছে। তার মূল্য দিতে হচ্ছে তৃণমূলকে।’’ তা স্বীকার করে গোপাল বলেন, ‘‘আমপানের সময়ে অনিয়ম হয়নি, তা নয়। কিন্তু পরে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তরাও সাহায্য পেয়েছেন।’’ কিন্তু তাতে শাসকদলের ভাবমূর্তির ক্ষতপূরণ হয়নি, তা পরিষ্কার। তৃণমূলের বিভিন্ন জনপ্রতিনিধি ও নেতাদের অনেকে সরকারি সাহায্য নিয়েছেন। তাঁদের পরিচিতদের ঘরে ঢুকেছে সাহায্য। গাইঘাটা, বাগদার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে নানা ভাবে তা প্রচারে এনেছে সিপিএম ও বিজেপি।
এ ছাড়াও বনগাঁ, বাগদার বহু জায়গায় পঞ্চায়েত ভোটে তৃণমূলের গাজোয়ারির ‘দাগ’ এখনও স্পষ্ট। হেলেঞ্চা বাজারের এক ব্যবসায়ীর কথায়, ‘‘পঞ্চায়েত ভোটে তৃণমূল জোর করে দখলে নেমে নিজেদের সব থেকে বড় ক্ষতি করেছে। বাইরে থেকে লোকজন এনে যে পরিস্থিতি তৈরি করেছিল, তা এখানকার মানুষ কল্পনাও করতে পারেননি। তার ফল তো হবেই।’’ বনগাঁ-বাগদা রোডের দু’এক জায়গায় দেওয়ালে ‘খালি পেটে রামের নাম, বেড়ে চলেছে গ্যাসের দাম’ গোছের ছড়া কাটা হলেও, সে কথা খুব একটা চর্চায় নেই।
পথসভা-জনসভায় তৃণমূলের নেতারা বলছেন বটে, কিন্তু পাল্লা এখনও তাঁদের পক্ষে— এমন দাবি নিশ্চিত ভাবে করছেন তাঁরা। তাই এ সব অঙ্কের ফাঁকে সিপিএম তথা বামেদের ভোট নিয়েও কথা উঠছে তাঁদের আড্ডায়। ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটে বামেরা পেয়েছিল ২৬ শতাংশ ভোট। গত লোকসভায় তা নেমে এসেছে ৬.৪১ শতাংশ ভোটে। সাদা চোখে সেই বামেদের থেকে সরে যাওয়া সেই ভোটের প্রায় পুরোটাই গিয়েছে বিজেপির ঘরে। এ বার সেই ভোট তারা ফিরিয়ে আনতে পারবে, এমন আশা বেশি তৃণমূলেরই। সিপিএম নেতা পঙ্কজবাবু অবশ্য বলছেন, ‘‘আমাদের ভোট বেকারের কাজ, আইনশৃঙ্খলা এ সব নিয়ে। কিন্তু এ বারের ভোটটা একেবারে অন্য জায়গায় নিয়ে গিয়েছে বিজেপি আর তৃণমূল। মেরুকরণের এই দৌড়ে আমরা নেই।’’ আসলে সিপিএম মেনেই নিচ্ছে, পঞ্চায়েত ভোটের গাজোয়ারির সময় থেকে তৃণমূলের বিরোধিতায় যা করা প্রয়োজন ছিল, তা তারা করতে পারেনি। সে কাজটা করে বিজেপি লোকসভা ভোটে সামনে চলে এসেছিল। এখনও সেই ধারা তারা ঘুরিয়ে নিজেদের দিকে নিতে পারেনি।
এক পাল্লায় তৃণমূল সরকারের কন্যাশ্রী, রূপশ্রী, স্বাস্থ্যসাথীর মতো সরাসরি সুবিধা দেওয়ার প্রকল্প আর অন্যটিতে বিরোধীদের তোলা আর্থিক অনিয়ম, পঞ্চায়েত ভোটে গাজোয়ারি এবং নাগরিকত্ব নিয়ে প্রচার। বনগাঁয় শেষমেশ পাল্লা কার দিকে ঝোঁকে, এখন তা-ই দেখার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy