বাংলায় আমরা রাজনৈতিক ভাবে উত্তপ্ত একটা সমাজে বাস করি। বাঙালির ধমনীতে ছোট থেকেই রাজনীতি ঢুকে রয়েছে। দেশের অন্যান্য প্রান্তের থেকে সেটা হয়তো কিছু গুণ বেশি। আমি তো এই সমাজেই বড় হয়েছি। ফলে রাজনীতি নিয়ে চেতনা এবং আগ্রহ দুই-ই আমার মধ্যে কৈশোর থেকেই বাসা বেঁধেছে। সচেতন বলতে ঠিক যা বোঝায়, আমিও তা-ই। প্রথমেই স্পষ্ট করে দিই যে, রাজনীতি মানে আমার কাছে শুধু কিছু দল, নির্বাচন, কে কত ভোট পেল, ক্ষমতার মসনদ— এ সব নয়। আমার কাছে রাজনীতি ব্যক্তিগত বিশ্বাস বা দর্শনও বটে। বাংলায় রাজনীতি শব্দটার মধ্যেই একটা রাজা-প্রজা-রাজ্যপাট গোছের গন্ধ আছে। তাই এই ব্যক্তিগত বিশ্বাসের ক্ষেত্রে কষ্ট হলেও বাংলা শব্দটি ছেড়ে ইংরেজি ‘পলিটিক্স’ শব্দটিকে বেশি উপযুক্ত মনে করি। এই ব্যক্তিগত পলিটিক্স জীবনে বন্ধু নির্বাচনের ক্ষেত্রে আমাকে চালনা করে কি না সেটাই ভাবতে ভাবতে বলার বা বলতে বলতে ভাবার চেষ্টা করব আনন্দবাজার অনলাইনের এই লেখায়।
প্রায় আড়াই দশক ধরে সিনেমার সঙ্গে যুক্ত থাকাকালীন সময়ে বহু সাক্ষাৎকার বা লেখায় জানিয়েছি, আমি মোটের উপর বামপন্থী পরিবেশে বড় হয়েছি। আমার মামার বাড়ির কিছু মানুষ বেশ পরিচিত পার্টিকর্মীও ছিলেন। আমার মা-বাবা অল্প বয়সে দেশ-বিদেশের সিনেমা, সাহিত্য, দীপক মজুমদার বা গ্রোটোস্কির মতো মানুষের সঙ্গ করার ফলে সৌভাগ্যক্রমে বামপন্থী ভাবনার প্রগতিশীল, মননশীল ও মানবিক দিকটা ছেঁকে নিতে পেরেছিলেন। তবে সেটা বজ্রআঁটুনি আঁটা, জগদ্দল, ডগম্যাটিক দিকটির থেকে আলাদা করে। মুক্তমনা মানুষ ছিলেন দু’জনেই। কিন্তু প্রয়োজনে তথাকথিত বামপন্থী পার্টির কড়া সমালোচনা করতেও ছাড়তেন না। একই সঙ্গে বামপন্থা যে আসলে এক বৃহৎ আন্তর্জাতিক দর্শন, কোনও একটি পার্টি যে তার একচ্ছত্র ইজারা নিতে পারে না, সে কথাও মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন। আমার মনে হয়, আমিও সেটা উত্তরাধিকার সূত্রে একটু হলেও পেয়েছি। এ হেন পরিবেশে বড় হওয়ার সময়ে মাঝেমধ্যে কিছু প্রবাদপ্রতিম বন্ধুত্বের কথা শুনেছি। যা রাজনৈতিক পরিসরে মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে অটুট থেকেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মনে আছে জ্যোতি বসু আর সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের সম্পর্কের কথা। ক্রিকেট, আইন, বিলেত, সিঙ্গল মল্ট স্কচ ইত্যাদি লোকগাথা হয়ে গিয়েছিল তখনই।
যদিও তখন আমি বেশ ছোট। কিন্তু রাজীব গান্ধীর আকস্মিক মৃত্যুর পরে পাড়ার কিছু কংগ্রেসি কর্মীকে আমার মামাবাড়ির লোকেদের নিরাপত্তার জন্য চিন্তা করতেও দেখেছি। কোনও এক পত্রিকায় জ্যোতি বসু স্মৃতিচারণা করেছিলেন সদ্যপ্রয়াত রাজীবের। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়া সত্ত্বেও তাঁদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক নিয়ে সেই মর্মস্পর্শী লেখার কথাও বিলক্ষণ মনে আছে।
আমি বলার চেষ্টা করছি যে, রাজনৈতিক দূরত্ব অথচ ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতা, এই ‘বৈপরীত্য’টি খুব অচেনা নয়। শৈশব থেকেই দেখছি, শুনছি। এখনকার দিনে দাঁড়িয়ে এই জাতীয় ‘ইয়ার-দোস্তি’র কথা বলতে গেলে দু’টি সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ করতে হবে। এর মধ্যে একটি আবার অতটাও সূক্ষ্ম নয়। সেটা দিয়েই শুরু করি।
গত তিন দশকে বিরাট পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে এই দেশে। মুক্ত খোলাবাজারি অর্থনীতির হাত ধরে বিশ্বায়নের কথা বলছি না। সে তো আছেই। আমি বলছি অতি দক্ষিণপন্থী রাজনীতির প্রথমে প্রসার, পরে জনপ্রিয়তা এবং শেষে ক্ষমতা অধিকার করার কথা। এখন এই দুইয়ের মধ্যে কোনও যোগাযোগ আছে কি না, থাকলে কতটা, সেটা আলোচনার চেষ্টা আমাকে মানায় না। এই লেখা তার উপযুক্ত ক্ষেত্রও নয়। এটি অর্থনীতিবিদদের কাজ।
অতি দক্ষিণপন্থী রাজনীতির একটি বৈশিষ্ট্য হল, এটি মানুষের মৌলিক ভাবনা এবং বিশ্বাসের কাঠামোয় আঘাত হানে। তাকে আমূল বদলে ফেলতে চায়। সংখ্যাগরিষ্ঠবাদের যে ভাবধারায় অতি দক্ষিণপন্থীরা বিশ্বাস করেন, যে ইতিহাস তাঁরা মানুষকে শেখাতে চান, যেটি তাঁদের নানান মুখপত্র বা গণমাধ্যম বা এখন সমাজমাধ্যমের মধ্যে দিয়ে বলিয়ে বলিয়ে তাঁদের রচনাটাই যে ইতিহাস, তাঁদের ভাবধারাটাই সর্বজনীন, এইটা বিশ্বাস করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন— ইতিহাস বহু বার তার সাক্ষী থেকেছে। গত এক শতকে অন্তত পাঁচ-ছ’বার পৃথিবীর নানা প্রান্তে সেটা আমরা দেখেছি। এতে একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে, সেটা কখনও একটি দেশ, কখনও একটি উপমহাদেশ, কোনও কোনও ক্ষেত্রে একটি মহাদেশকে (অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেশ, কারণ, দেশের ভাবনাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়) আস্তে আস্তে স্বৈরাচার বা একনায়কতন্ত্রের দিকে নিয়ে যাওয়া যায়।
আধুনিক স্বৈরাচার পদ্ধতি হল, আপাতদৃষ্টিতে গণতন্ত্র বহাল থাকবে। পোশাকি গণতন্ত্রের আড়ালে সব ক’টি গণতান্ত্রিক স্তম্ভকে, গণতন্ত্রের সব ক’টি শর্তকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে এবং তলে তলে স্বৈরাচার বা একনায়কতন্ত্রের দিকে দেশ বা মানুষকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। এর জন্য সব ধরনের মেরুকরণের আশ্রয় নেওয়া হবে। ধর্মীয়, জাতীয়, প্রদেশীয়, ভাষাগত, বিত্তগত— সব। কিছু ক্ষেত্রে অবশ্য অতি বামপন্থীরাও এই জিনিস করার চেষ্টা করেছেন। অস্বীকার করার কিচ্ছু নেই। ইতিহাস তারও সাক্ষী।
আসলে পৃথিবীটা দেখতে মানচিত্রের পাতায় সমতল। পূর্ব এবং পশ্চিম একে অন্যের থেকে অনেক দূর বলে মনে হয়। কিন্তু আসলে তো পৃথিবীটা গোলাকার। অতি পূর্বের সাইবেরিয়া থেকে অতি পশ্চিমের আমেরিকার অধীনে থাকা আলাস্কা কিন্তু আসলে একেবারেই দূরের নয়। প্রশান্ত মহাসাগরের দিক থেকে দেখতে গেলে আমরা বুঝতে পারব, খুব একটা দূরত্ব নেই। যে সময়ে আমি বড় হয়েছি, সেই সময়ের কথা বলছি। তখন অনেক সমস্যা ছিল। এখনকার মতোই। তখনও দুর্নীতি ছিল। রাজনৈতিক হিংসা ছিল। বাদানুবাদ ছিল। কিন্তু এই মগজধোলাইয়ের পরিবেশটা ছিল না। তাই ‘শত ফুল বিকশিত’ হওয়ার জমিটা এখনকার তুলনায় আর একটু সমান ছিল। ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ ছিল একটু। আর সেই ফুলের মালিরা, তাঁদের ফুলচাষের পদ্ধতি আলাদা আলাদা হলেও একে অপরের বন্ধু হতে পারতেন।
এ বার আসি ‘বন্ধু’ শব্দটির বিশ্লেষণে। এত দিন ধরে সিনেমার পরিসরে কাজ করছি। অধিকাংশটাই বাংলায়। ইদানীং সময়ে কিছুটা হিন্দিতে। কত মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে! রোজ দেখা হয়। কাজ করি। হাসি, ঠাট্টা, ইয়ার্কি, পাশাপাশি বসে একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া চলে। কারও কারও সঙ্গে দু’দশকেরও বেশি সময় ধরে পরিচয়। অনেক দিন পর কোনও কাজ করতে গিয়ে দেখা হলে ভাল লাগাও থাকে। থাকে সৌজন্যও। ঈশ্বর না করুন, এঁদের কেউ যদি কখনও বিপদে পড়েন বা শরীর খারাপ হয়, তখন কুশল বিনিময় থাকে। খোঁজ নেওয়া থাকে। সম্ভব হলে গিয়ে সাহায্য করা থাকে। একটা টান থাকে। এই সব ক’টি যোগাযোগ বা সম্পর্কের নিজস্ব ভূমিকা আছে আমার জীবনে। নিজস্ব গুরুত্ব আছে। নিজস্ব মাত্রা আছে। সব আছে। কিন্তু এঁদের সবাইকে কি আমি ‘বন্ধু’ বলতে পারব? ‘ইয়ার’ বলতে পারব? ‘বন্ধু’ শব্দটির মাহাত্ম্য বা মানে আমার কাছে বিরাট। সেটা কিন্তু সকলের সঙ্গে হয় না। সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব হওয়া সম্ভবও নয়।
যে ধরনের সম্পর্কগুলোর কথা বললাম, এর মধ্যে কে কোন রাজনৈতিক বিশ্বাসে বিশ্বাস করছেন, ব্যক্তিগত ভাবে কী দর্শনে বিশ্বাস করেন, এটা সব সময়ে জানা সম্ভব হয় না। জানার জন্য আমি আলাদা করে হয়তো উৎসুকও থাকি না। যখন জানতে পারি, যদি মনে হয় যে, হ্যাঁ আমার সঙ্গে মিলছে ব্যাপারটা, তা হলে ভাল। আবার যদি মনে হয়, মিলছে না, তা হলে সেটাও ঠিক আছে। এটা তো একটা বড় কাজ করার পরিসর। এখানে সকলে তো একমত হবেন না। তা নিয়ে আমার আলাদা করে কোনও মাথাব্যথা থাকে না তেমন। যদি দেখি, খুবই ভিন্নমত পোষণকারী এক জন মানুষের সঙ্গে আমি কাজ করছি, তাতেও কি সৌজন্য থাকে না? ১০০ বার থাকে। একটু আগে যে টানের কথা বললাম, যে পরিচিতির কথা বললাম, সেখান থেকে একটা ভাল লাগা থাকে তো বটেই। আবারও বলছি, সব কিছুরই নিজস্ব দাম আছে জীবনে। কিন্তু বন্ধু বা ইয়ার হতে গেলে সেখানে কোথাও একটা সমমনস্কতার প্রয়োজন আছে। আমার কাছে আছে।
‘সমমনস্কতা’ মানে কিন্তু এক রকম হওয়া নয়। ধরা যাক, এক রকম দেখতে ছ’টা লোক বন্ধু। এক রকম ভাবে তাঁরা হাঁটেন, চলেন, কথা বলেন। না, আমি সেটার কথা বলতে চাইছি না। বরং সেটারই উল্টো কথাটা বলতে চাইছি। উল্টো বলছি তার কারণ আছে। এই যে রোবট তৈরি করা বা মগজধোলাই করে এক ধরনের, একই কথা বলা কিছু মানুষ বা অনেকটা বড় জনগোষ্ঠী তৈরি করা— এটাই কিন্তু অতি দক্ষিণপন্থার রীতি। আমি সেটার কথা বলছি না। আমি বলছি যে, কিছু ভাবনা, সেটা যদি একটা বড় ছাতা হয়, তার তলায় একসঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন দেখতে কিছু মানুষ, ভিন্ন ভিন্ন রকম ভাবে কথা বলেন, ভিন্ন ভিন্ন জায়গা থেকে উঠে এসেছেন— এই জায়গা থেকে। আমার কাছে সেটাই সমমনস্কতা। আমার কাছে বন্ধু হওয়ার জন্য সেটাও জরুরি।
একটু কথা বললে, একসঙ্গে কাজ করলেই তো আমরা বুঝতে পারি যে, কে কী ধরনের ভাবনা ভাবেন। তার থেকে সকলে তো বন্ধু হন না। দু’এক জনই তো বন্ধু হন। সচেতন ভাবে নয়, হয়তো অবচেতনে কোথাও আমরা নিজেদের মাথায় কতগুলো মাপকাঠি ঠিক করে রাখি। হয়তো ৯, ১০ বা ১১-১২টা মাপকাঠি আছে। এর মধ্যে যদি সাতটায় কারও সঙ্গে মিলে যায়, তখনই কিন্তু আমাদের ভিতর থেকে একটা সিগন্যাল আসে, এই মানুষটা আমার বন্ধু। এঁর সঙ্গে আমি বন্ধুত্বটা রাখতে চাইব। যাঁদের ক্ষেত্রে দেখলাম ১২টার মধ্যে তিনটেয় সমমনস্ক হয়েছি, তাঁদের নিয়েও কোনও সমস্যা নেই। তাঁদের সঙ্গেও সৌজন্য সমান পরিমাণেই বজায় থাকে। কিন্তু হয়তো সেই বন্ধুত্বটা তৈরি হয় না।
আমার ক্ষেত্রে এ রকম ঘটেছে কি? এক সময়ে যাঁকে আমার নিজের সংজ্ঞা অনুযায়ী বন্ধু ভাবতাম, তাঁর হৃদয় পরিবর্তন হয়েছে? তাঁকে পাল্টে যেতে দেখেছি কি? তাঁর ব্যক্তিগত দর্শন, ব্যক্তিগত রাজনীতির জায়গা থেকে ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ, যেগুলো আমি ভাবতাম এক রকম ছিল, তার পরিবর্তন হয়ে যেতে দেখেছি কি?
জবাব, হ্যাঁ। এটা হয়। এটা হয়েছে। অনেক সময় মানুষ তো বদলায়। বিশেষত রাজনীতিগত ভাবে ভয়ানক মেরুকরণের সময় যখন আসে, এখন যে রকম সময়ে আমরা বাস করছি, সে রকম সময়ে এটা ভীষণ রকম দেখা যায়। ইতিহাসেও দেখা যায়। শুধু বন্ধুত্ব কেন, আত্মীয়তার মধ্যেও দেখা যায়। দেখা গিয়েছে। দেখা যাচ্ছে। আর বন্ধুত্বের মধ্যেও তো দেখা যায়। দেখা যাচ্ছে।
সে ক্ষেত্রে কী করণীয়? সৌজন্য কোথাও চটকে যাবে কি? কোথাও ক্ষুণ্ণ হবে কি? একদম না। নিশ্চয়ই না। কেন হবে? কত পরিচিত মানুষের সঙ্গে দেখা হয়। তাঁদের সঙ্গে তো ভীষণ ভাল সৌজন্যও থাকে। নানা ধরনের যে সম্পর্কের কথা লিখলাম, সেগুলো তো বজায় থাকে। তবে যাঁকে বন্ধু ভাবতাম, তেমন এক জনকে ওই ‘ক্যাটেগরি’তে ফেলে দিতে কি খারাপ লাগে না? নিশ্চয়ই লাগে। ১০০ বার লাগে! কিন্তু আমার মনে হয়, কোথাও একটা ব্যক্তিগত রাজনীতি, ব্যক্তিগত দর্শন খুব গুরুত্বপূর্ণ। বন্ধুত্ব যদি কোনও সময়ে থেকে থাকে, তার তো একটা কারণ ছিল। সেই কারণগুলো তো এক দিনে হঠাৎ করে মুছে যায় না। বন্ধুত্ব থাকে। কিন্তু বন্ধুত্বের মাত্রাটার রকমফের হয়। এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। হয়তো তাঁরা শুধুই সৌজন্যমূলক পরিচিতির আওতায় দুম করে চলে যান না। তার থেকে একটু বেশি থাকেন। সেটা অস্বীকার করার কোনও জায়গা নেই। কিন্তু কোথাও একটা মাত্রার পরিবর্তন হয়। সেই পরিবর্তনের জন্য আমার খারাপ লাগা থাকলেও সেটা নিয়ে আমি চলতে প্রস্তুত। কোনও অসুবিধে নেই। কেন না আমার কাছে ব্যক্তিগত দর্শন এবং রাজনীতিটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। ওটাকে ত্যাগ করতে পারব না। তা-ও হয়তো নিজেকে বোঝাই, ওঁরা কোনও বিকল্প খোঁজার চেষ্টা করতে গিয়ে ওই পথ বেছেছেন। হয়তো জোর করে নিজেদের বুঝিয়েছেন। সেই বিশ্বাসে জোর করে নিজেদের বিশ্বাস করিয়েছেন। মানুষ মাত্রই প্রয়োজনের দাস। হয়তো কোনও প্রয়োজন পড়েছে। সেই কারণেই হয়তো। কিংবা হয়তো ওঁদের উপরে জোর খাটানো হয়েছে। কিন্তু আসলে মানুষগুলো বদলে যাননি।
ওঁদের এই হৃদয় পরিবর্তন, ভাবনা পরিবর্তন, রাজনীতির পরিবর্তন, দর্শন পরিবর্তন, ব্যক্তিচিন্তার পরিবর্তন বা কোনও রকমের দায়বদ্ধতা, কোনও রকমের চাপ— এই সবের প্রতি আমার সম্পূর্ণ সম্মান থাকতে পারে। কিন্তু ভাল লাগা বা ভালবাসা থাকতে পারে না। যাঁদের মত পরিবর্তন হয়েছে বা যাঁদের পরিবর্তিত হতে দেখেছি, ধরে নিচ্ছি, তাঁদের মধ্যে অনেকে এক পক্ষের উপরে বিরক্ত হয়ে একটি বিকল্পের খোঁজে ওই ভাবনায় নিজেদের রাজি করিয়েছেন। এই যে অবস্থাটা, সেটার জন্যই হয়তো আমি সক্রিয় রাজনীতিতে কোনও দিন প্রবেশ করতে চাইব না। অন্তত এই মুহূর্তে তো একেবারেই চাই না। তার কারণ, যে পরিস্থিতিতে এক পক্ষের উপর বিরক্ত হয়ে আমাকে অতি দক্ষিণপন্থী, একনায়কতন্ত্রকে সমর্থন করতে হয়, সেই পরিবেশে আমার রাজনীতি করার কোনও বাসনা নেই। ভারতের বর্তমান রাজনৈতিক পটভূমিতে সক্রিয় রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার পক্ষে আমার রাজনৈতিক সচেতনতা হয়তো বা একটু বেশি। সেই কারণেই।
আর একটি সঙ্কট হচ্ছে, কোনও একটি দল করলে তার ‘পার্টি লাইন’ মেনে চলতে হয়। আমি সেই ব্যক্তি স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি, যেখানে যদি কোনও দল করি, সেখানকার কিছু জিনিস যদি আমার ভাল না লাগে, তা হলে সেটা যেন মুখ ফুটে বলতে পারি। এমন বহু উদাহরণ আছে। বিশেষত বিদেশে। একটি দলের সদস্য হয়েও অনেকে তাঁদের ব্যক্তিমতটা খুব স্পষ্ট করে বলেন। আমাদের দেশের রাজনীতিতে ভীষণ ভাবে ‘পার্টি লাইন’ মেনে চলা হয়। সকলকে একই কথা বলতে বলা হয়। জোর করে সেটা করলে তার সঙ্গে আমি মানিয়ে নিতে পারব বলে মনে হয় না।
আমার মনে হয়, আমি একাই ভাল। এই মুহূর্তে অন্তত গোষ্ঠী বা সঙ্ঘে বিশ্বাস রাখতে পারছি না। আমি একা এক জন করদাতা নাগরিক হিসেবে, এক জন সচেতন নাগরিক হিসেবে আমার ভূমিকাটুকু পালন করতে চাই। এবং এটাও চাই যে, আমাদের দেশে এই এক জন সাধারণ, সচেতন, করদাতা নাগরিকের ভূমিকাটাকে আর একটু গ্রাহ্য করা হোক। কারণ, এটাই গণতন্ত্রের মূল কথা। সচেতন হওয়ার জন্য সেই নাগরিকের প্রয়োজন তাঁর কাছে সব ক’টি জানলা খুলে রাখা। তাঁর সামনে একটি সমান ‘খেলা’র, সমান ‘জমি’ খুলে রাখা হোক। যেখান থেকে তিনি বেছে নিতে পারেন। সেই ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’, যেখান থেকে তিনি সব দিক বিচার-বিবেচনা করে তাঁর চেতনাকে শান দিতে পারেন। সেটা তিনি যেমন চাইবেন তেমন। আমি এক রকম চাইব। অন্য জন আর এক রকম চাইবেন। কিন্তু তাঁর সামনে সমস্ত জানলা এবং সুযোগ যেন স্পষ্ট ভাবে খোলা থাকে। কয়েকটা জানলা জোর করে বন্ধ রেখে শুধু কয়েকটাই খোলা রইল— এমনটা যেন না হয়।
আমি যে ভাবে বন্ধুত্বের সংজ্ঞাকে এত ক্ষণ ধরে বিশ্লেষণ করলাম, আমি নিশ্চিত, ব্যক্তিবিশেষ তাঁর মতো করে আলাদা আলাদা ভাবে এই বিষয়টি দেখেন। আমার মতো করে অনেকে এটা দেখেন। আবার আমার মতো করে অনেকে হয়তো দেখেন না। বন্ধুত্ব এবং অন্য সম্পর্কগুলোর মধ্যে আমি কোথাও একটা লাইন টানি। বন্ধুত্বের মাত্রা কখন বদল হবে, কখন মাত্রা বদল করে বন্ধুত্ব পরিণত হবে সৌজন্যে— এ সবের মধ্যে আমি কী ভাবে লাইন টানি, সেটাই এত ক্ষণ ধরে লেখার চেষ্টা করলাম। যাঁরা এর সঙ্গে নিজেকে মেলাতে পারবেন, আমি নিশ্চিত, লেখাটা তাঁদের ভাল লাগবে। যাঁরা মেলাতে পারবেন না, তাঁদের হাতে নিশ্চয়ই এই জটিল ও কঠিন বিষয়গুলি নির্ধারণ করার জন্য অন্য কোনও পদ্ধতি বা পন্থা আছে।
(লেখক পরিচালক ও অভিনেতা। মতামত নিজস্ব)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy