Advertisement
Back to
Rahul Arunoday Banerjee

রাষ্ট্র ন্যূনতম সততা দিলেই সহজেরা ভোটের ছুটিতে আর মন্দারমণি দৌড়বে না

আমার পুত্র ‘সহজ’। এখনও অনেকটাই সহজ। অনেকটাই ছোট। যখন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের দিকে তাকাই, দেখতে পাই, ওদের অনেকেই ভাবনায়, মননে, চিন্তায় আমাদের থেকে এগিয়ে।

Bengali Actor Rahul Arunoday Banerjee writes on the upcoming Lok Sabha Election 2024
রাহুল অরুণোদয় বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ০৮:০০
Share: Save:

শুরুতেই একটা গল্প বলি। ভোটের বাজার। হঠাৎ চারিদিকে ছড়িয়ে গেল, দেশের প্রধানমন্ত্রী বুলবুলি গ্রামের উপর দিয়ে যাবেন। তাঁর কর্মসূচির যে যাত্রাপথ, তা এই বুলবুলি গ্রামকে স্পর্শ করেই যায়। বুলবুলি একটা আধোঘুমন্ত গ্রাম। এই গ্রামের বাসিন্দাদের জীবনে শেষ তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা, পাশের গ্রামে হওয়া মোরগ লড়াইয়ে আলতাফের মোরগের জয়লাভ। তাঁদের গ্রামের উপর দিয়ে প্রধানমন্ত্রী যাবেন, এর গুরুত্ব বুঝতে বুঝতেই দিন দুয়েক কেটে গেল! স্থানীয় নেতা সৌমেন মণ্ডল এসে গোটা বিষয়টা বোঝাতেই সবাই গা-ঝাড়া দিয়ে উঠলেন। সৌমেন বোঝালেন, আর কিছু না হোক, আশপাশের গ্রামের হাজারখানেক মানুষ তো জড়ো হবেন প্রধানমন্ত্রীকে দেখতে! মানুষ মানে কী? ব্যবসা। তা ব্যবসা আর কবে কার খারাপ লাগতে পারে? হাতে মাত্র দু’দিন। যে যা পারেন বানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর যাওয়ার রাস্তায় স্টল দিতে লাগলেন। আস্তে আস্তে বাইরের ব্যবসায়ীরাও চলে এলেন। লোকাল ক্লাব মওকা বুঝে দাঁও মেরে রাস্তার ধারের মাঠে বসার ব্যবস্থা করে দিল সকলের। কোথা থেকে একটা ইলেকট্রিক ছোট নাগরদোলা আর বেলুন ফাটানো বন্দুকের স্টল চলে এল। মাঠ জুড়ে একটা মেলার পরিবেশ!

প্রধানমন্ত্রী পর দিন ভোরবেলা এই অঞ্চল পার করবেন। গভীর রাত। মেলার বেশির ভাগ লোক ঘুমিয়ে পড়েছেন। এমন সময় সৌমেন দলবল নিয়ে হাজির। মেলায় সব ঠিক আছে কি না দেখবেন। বেশির ভাগই স্থানীয়ই রাতে একটু শুতে বাড়ি ফিরে গিয়েছেন। সৌমেন তখন দু’পাত্তর চড়িয়েছেন। মন খুশি-খুশি। তাঁর হাঁকডাকে ক্লাবের ছেলেপিলে-সহ আরও কয়েক জন জড়ো হলেন। ওই রাতে সৌমেন দেখবেন, নাগরদোলা ঠিক চলছে কি না। তবে উনি একা চড়বেন না। বাকিদেরও চড়তে হবে ওঁর সঙ্গে। সৌমেনদা বলেছেন! সকলে হইহই করে নাগরদোলায় চড়ে বসলেন। নাগরদোলা তখন সবে চলতে শুরু করেছে। সৌমেন দেখলেন, একটি ছেলে আসছে হেঁটে। সৌমেনের চোখে জল চলে এল। বললেন, ‘‘ও ভাই, তুমি চড়বে না?’’ ছেলেটা আগের মতোই মনমরা হয়ে সৌমেনকে বলল, ‘‘না দাদা উপায় নেই।’’ শুনে সৌমেনের চোখে অশ্রুর বান ডাকল। রক্তস্রোত হল চঞ্চল। তিনি বললেন, “আমি থাকতে উপায় নেই মানে! আমরা সবাই সমান। ওঠো। উঠে এসো নাগরদোলায়।’’

ছেলেটা মিনমিন করে কিছু একটা বলতে গিয়েছিল। সৌমেন এমন ধমক দিলেন, ছেলেটা ভয়ে শেষে খালি একটা ট্রে-তে উঠে পড়ল। তত ক্ষণে সৌমেনও অনেকটা উপরে উঠে গিয়েছেন। এই দৃশ্য দেখে চোখের জল মুছলেন। এইটুকু, মানুষের জন্য এইটুকু করতেই তো আসা! টানা মিনিট দশেক নাগরদোলায় চড়ার পর চিৎকার করে সৌমেন বললেন, ‘‘অনেক হয়েছে, এ বার থামাও।” বাকিরাও একমত হলেন। সত্যিই তো অনেক হয়েছে। কিন্তু কেউ থামাচ্ছে না। মাঝখান দিয়ে ওই গোবেচারা ছেলেটা হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। ওর কথা শুনে সকলের মাথায় হাত। ওই নাগরদোলার সুইচ ও-ই অন্-অফ করে। ও-ই পারে নাগরদোলা থামাতে। সৌমেন বকুনি দেওয়ায় ও ভয়ের চোটে নাগরদোলায় উঠে পড়েছে! এ বার কে বন্ধ করবে ও জানে না।

শোনা যায়, সে দিন সারা রাত ওই নাগরদোলা চলেছিল। পর দিন প্রধানমন্ত্রী বুলবুলি গ্রামের উপর দিয়ে গেলেও সৌমেন রাস্তায় থাকতে পারেননি।

ভাবছেন, ভোট নিয়ে লিখতে বসে হঠাৎ রোমানিয়ার এই ছোটগল্প আপনাদের কেন বলছি? এই গল্পটা রূপক। আমাদের খুব চেনা। প্রত্যেক বার ভোটের সময় প্রত্যাশার নাগরদোলায় চড়িয়ে নেতা-নেত্রীরা ওই ‘চাবি’ নিয়ে ধাঁ! এটা এখন আমাদের কেমন গা-সওয়াও হয়ে গিয়েছে। কোনও মন্ত্রীর খাটের তলায় বাগানের নারকেল আছে, এটা শুনলেই খাবি খেতে হয়। তা হলে টাকা কোথায় রাখেন? এমতাবস্থায় কী ভাবছে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম? তারা কি আদৌ ভোট দেবে? না কি আমাদের চুঁইয়ে পড়া হতাশা তাদের উদাসীন করে দেবে ভোটের প্রতি?

আমার পুত্র ‘সহজ’। এখনও অনেকটাই সহজ। অনেকটাই ছোট। যখন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের দিকে তাকাই, দেখতে পাই, ওদের অনেকেই ভাবনায়, মননে, চিন্তায় আমাদের থেকে এগিয়ে। পৃথিবী, প্রকৃতি, পরিবেশ, লিঙ্গের সমানাধিকার— সব কিছু নিয়ে অনেক বেশি স্পষ্ট, ভনিতাহীন। ওরা পৃথিবীকে সুন্দরতর দেখতে চায়। ওরা একেবারে ভোটবিমুখ হয়ে যাবে বলে আমার মনে হয় না। কিন্তু স্বাধীন মতামত গঠনের ক্ষেত্রে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসবে ‘অ্যালগরিদম’।

তা হলে খুলেই বলি। আমাদের প্রজন্ম পার্কে, নাটকের দলে, চায়ের দোকানে, বাসে-ট্রামে রাজনৈতিক তর্ক করে বড় হয়েছে। সেই তর্কে ‘ব্লক’ করে দেওয়ার কোনও ‘অপশন’ ছিল না। বিরুদ্ধ স্বর শুনতে হয়েছে আমাদের। কোনও দিন তা খণ্ডন করতে পেরেছি। কোনও দিন হেরে গিয়ে মনমেজাজ তেতো করে বাড়ি ফিরে এসেছি। সেই আমরাই এখন হাতে মোবাইল পেয়ে এক এক জন সাক্ষাৎ হিটলার। তালেবর খাঞ্জা খাঁ। বিরুদ্ধ মত দেখলেই ঘচাং ফু! ব্লকের তালিকায় মৃত সম্পর্কের ভিড়। তাই আমার মোবাইলও আর আমায় চটায় না। আমি দেখতে যা চাই, তা-ই দেখায়। কানহাইয়া কুমার কংগ্রেসে গেলেন। আমার মোবাইল ওঁকে দেখানো বন্ধ করে দিল।

এ এক আশ্চর্য বুদ্বুদ! যেখানে সব কিছুতে শেষ কথা আমিই। অ্যালগরিদমের এই বুদ্বুদ আরও সর্বগ্রাসী হয়ে স্বাধীন মতামতকে যাতে না গিলে খেতে পারে, সে দিকে খেয়াল রাখা দরকার। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বাইরের বড় পৃথিবীর খবর রাখে। তারা পাড়ার সেই প্রাণীটিকে নিয়েও ভাবে, যার লেজে কোনও এক প্রজন্ম মজার ছলে বাজি বেঁধে দিত। কিন্তু এই উর্বর জমিতে ক্ষতিকর নীলচাষ হচ্ছে। যা তাকে ক্রমশ বন্ধ্যাত্বের দিকে নিয়ে যাচ্ছে, না কি তাকে সুজলাং সুফলাং করে তোলা হচ্ছে, আলোচনা এবং বিশ্লেষণের মাধ্যমে তা ঠিক করবে সহজদের মনন। তাদের বহুমুখী জ্ঞানপিপাসা। যা কোনও দিন অ্যালগরিদমের শরণাপন্ন নয়। কিন্তু সে রাস্তা দুর্গম, তাই বেশির ভাগ মানুষ বিরুদ্ধ স্বর নিয়ে অসহিষ্ণু হয়ে পড়বে। আর সেই অসহিষ্ণুতার গর্ত দিয়ে ঢুকবে গোঁড়ামির কালনাগিনী। বিজ্ঞান আরও এগোবে। আর বিজ্ঞানের পিঠে চড়েই আরও বাড়বে উগ্রতার প্রচার।

তবু আমি হতাশায় ভুগতে রাজি নই। আমি বিশ্বাস করি, শুভবুদ্ধির কাছে দুর্বুদ্ধি চিরকাল হেরে এসেছে। এখন যদি না-ও হারে, সময়ের বিচারে সে দণ্ডিত হবেই। আর তার একমাত্র গণতান্ত্রিক পদ্ধতি হল ভোট। বিজ্ঞান যদি ভবিষ্যতে মানুষকে সম্পূর্ণ স্বচ্ছতার আশ্বাস দেয়, আর রাষ্ট্র দেয় ন্যূনতম সততা, তা হলে সহজেরা ভোটের ছুটিতে আর মন্দারমণি দৌড়বে না।

(লেখক অভিনেতা। মতামত নিজস্ব)

অন্য বিষয়গুলি:

Rahul Arunoday Banerjee Bengali Actor Lok Sabha Election 2024 Celeb Column
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy