‘আয়রে মোরা গরীব যতো
বাঁধব জবর জোট,
একসুরে আয় বলবো তেড়ে
ভোট মারানি ফোট।’
নবারুণ ভট্টাচার্যের গল্পের কবি ফ্যাতাড়ু পুরন্দর ভাট এ ভাবেই ভোট সম্পর্কে তার ভাবনার কথা জানিয়েছিল কবিতায়। ফ্যাতাড়ুরা বাংলা মদ চার্জ করে আকাশে ওড়ে আর আমোদগেঁড়ে বাঙালির মাথায় পচা আলুর দম, পাঁঠার মাথা, ঝাঁটা, তোলা উনুন ভাঙা ফেলে অথবা হিসিও করে— এ আমাদের অনেকেরই জানা। তারা ‘ফ্যাঁত ফ্যাঁত সাঁই সাঁই’ মন্ত্র উচ্চারণ করে ‘ড্যামেজ’ করতে থাকে গোপনে বা প্রকাশ্যে।
কিন্তু ফ্যাতাড়ুদের আদৌ কি কোনও রাজনীতি আছে? একদা ফ্যাতাড়ু ‘ডিএস’ আর এক ফ্যাতাড়ু মদনকে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘‘আচ্ছা ফ্যাতাড়ুদের মধ্যে সিপিএম, বিজেপি, তৃণমূল হয়?’’ মদন উত্তরে বলেছিল, ‘‘আকছার হয়। কিন্তু ফ্যাতাডুদের প্রোগ্রামের সময় জয়েন্ট অ্যাকশন।’’ ফ্যাতাড়ুরা কোনও রাজনৈতিক দলের ইজম্-এর তোয়াক্কা না করেই একজোট হয়। বাজার করা বা ভাইফোঁটা নেওয়ার মতো করে ভোট দিতে যাওয়া তাদের প্রাত্যহিক ক্রিয়াকর্মের মধ্যেই পড়ে। নবারুণদা বলেছিলেন, ‘‘ফ্যাতাড়ু শুধু একটা রাজনীতির ব্যাপার নয়। ফ্যাতাড়ু একটা দৃষ্টিভঙ্গি টুওয়ার্ডস রাজনীতি। আর ফ্যাতাড়ুরা ব্যর্থতা বা সার্থকতার কোনও তোয়াক্বাই করে না। তাদের কাজ হল উড়ে বেড়ানো আর যেখানে-সেখানে ঝামেলা পাকানো।’’
মদন, ডিএস, পুরন্দরেরা কি শুধু গল্পেরই চরিত্র? না কি আমাদের চারপাশে আরও অসংখ্য ফ্যাতাড়ু আছে যারা গাড়ির হর্ন ঝেড়ে, বাংলা মদ খেয়ে, ফ্লোটেলে গিয়ে ঝামেলা পাকায়? আমার মনে হয়, আমাদের চারদিকে ফ্যাতাড়ুরা আড়চোখে আমাদের মেপে যায়। যদি সুযোগ পায় এক লাথিতে তারা আমাদের কচুবনে ফেলবেই। পার্টি নিয়ে ফ্যাতাড়ুরা তোয়াক্কা করে না। বাম আমলে সিপিএমের দৈনিক মুখপত্রের স্ট্যান্ডের সামনে দাঁড়িয়ে তারা যেমন বলত— ‘সলিড! সলিড’, ‘বল, কী বলবি বল’, ‘ওয়া, পারবি’, ‘হেব্বি, হেব্বি’, এখন তৃণমূলের মুখপত্রের সামনে দাঁড়িয়েও একই কথা বলে। দিদির গভর্নমেন্টের ঘর থেকে টাকা কামানোর জন্য বিভিন্ন প্ল্যান করে। যেমন চোলাই খেয়ে মরে। ক্লাব খুলে, এমনকি, মাওবাদী হয়ে আত্মসমর্পণ করে। ফ্যাতাড়ুরা টাকা কামানোর জন্য সাধু সাজতেও রাজি।
২০১১-র ভোটের ফল বেরোনোর সকালে লেকটাউন অটোস্ট্যান্ডে লাইনে দাঁড়িয়েছি। দেখি সব অটোয় লাল পতাকা লাগানো। রাতে ফেরার সময় দেখলাম পতাকার রং বদলে গিয়েছে। ঘাসফুলে ছেয়ে গিয়েছে চারিদিক। পরিচিত কালুদার অটোতে উঠলাম। গন্ধে বুঝলাম কালুদা ‘চার্জড’। নিজেই বলতে শুরু করল, ‘‘৫০০ টাকা আর একটা বোতল দিয়েছে, বুঝলে। কিন্তু আমরা সিপিএমও না, তৃণমূলও না। তা হলে আমরা কী?’’ কালুদা একই প্রশ্ন পাশের অটোচালককে করল। তার পরে দু’জনে রাস্তায় নেমে, ‘ম্যায় হুঁ ডন’ গানের সঙ্গে নাচতে শুরু করে দিল। পাশের উল্টোডাঙার বস্তির মানুষজনও যোগ দিলেন সেই কার্নিভ্যালে। আকাশে উড়ছে সবুজ আবির। হলদে হ্যালোজেনের আলোয় তার রং কালো। আমার মনে হচ্ছিল, সবাই যেন কোনও গোপন অন্তর্ঘাতের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে।
কয়েক বছর আগে আমার ‘ইয়ে’ ছবির শুটিং চলছিল গঙ্গার পাশের একটা ঘাটে। দৃশ্যটা ছিল, একটা বহুজাতিক জুতোর কোম্পানির লোগোর উপর কয়েকটা ছোট বাচ্চা প্রস্রাব করবে। প্রোডাকশন রেললাইনের পাশের বস্তির কয়েকটা ছেলেকে এনেছে। ওদের বোঝালাম দৃশ্যটা। একটা ছোট বাচ্চা বুঝতে পারছিল না। ওদের মধ্যে তুলনায় বয়সে একটু বড় ছেলেটা আমাদের জুতো দেখিয়ে ওকে বলেছিল, ‘‘বুঝতে পারছিস না! এই জুতো (ছাপার অযোগ্য) কোনও দিনও পরতে পারবি? তা হলে চল মুতে দিই!’’ আমার মনে হয়েছিল, দেওয়ালে ওই লোগোর বদলে প্রস্রাব আমার পায়ে এসেই পড়ছে!
কুড়ি বছর আগে যখন ‘ফ্যাতাড়ু’ নাটকটা নির্মিত হয়েছিল, তখন ‘সাব অলটার্ন’ মানুষদের এই রাগ, এই অ্যানার্কি, এই অন্তর্ঘাত কী ভাবে নাটকের ভাষায় উঠে আসবে, সেটা অজানা ছিল আমার কাছে। বাস্তবতার ঊর্ধ্বে গিয়ে একটা সহজ স্পেসের অন্বেষণ চলছিল সেই সময়। যেমন ফ্যাতাড়ুদের আকাশে ওড়া, দ্বিতীয় হুগলি সেতু, মদের ঠেক, কবি সম্মেলনের অফিস, পার্ক, ট্রেন, বঙ্গভবন— এমন অসংখ্য টুকরো ‘স্পেস’ গোটা নাটক জুড়ে আছে। প্রথাগত প্রসেনিয়ামের সেট ডিজ়াইনে যে এটা সম্ভব নয়, সেটা বুঝতে পারছিলাম। আমাকে এর হদিস দিয়েছিলেন বাবুঘাটের গঙ্গার পাশের এক জলবিক্রেতা। নামটা আর মনে নেই এখন। তবে লুকিয়েচুরিয়ে মদও বেচতেন তিনি। সেই সময় কলকাতার রাস্তায় রাত্তিরে রাত্তিরে ঘুরে বেড়াতাম। এক রাতে পরিচয় হয়েছিল ওঁর সঙ্গে। এক দিন ঘাটের পাশে বসে আছি। দ্বিতীয় হুগলি সেতুর দিকে তাকিয়ে। উনি পাশে এসে বসলেন। তার পরে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘‘আপনি কি কিছু খুঁজছেন?’’ দ্বিতীয় হুগলি সেতুর দিকে তাকাতেই আমায় বলেছিলেন, ‘‘সো যাও ইঁয়াহা।’’ আমি ওঁর কথা শুনে শুয়েও পড়েছিলাম ঘাটের চাতালে। তার পর মাথা উল্টো করে সেতুর দিকে তাকাতেই দেখলাম ইংরেজি ‘ভি’ অক্ষরের মতো দুটো লাইন উঠে যাচ্ছে আকাশের দিকে। আমি আমার ডিজ়াইনের খোঁজ পেয়ে গেলাম। যাঁরা দেখেছেন ওই নাটক তাঁরা জানেন, দুটো স্ট্রেচার, দুটো ট্রলি, তিনটে খাট আর একটা বেঞ্চ দিয়ে গোটা নাটকটা নির্মিত হয়েছিল।
‘ফ্যাতাড়ু’ হওয়ার ‘ফুল কোয়ালিফিকেশন’ আমার নেই। আমি চাইলেও অনেক কিছু ঘটাতে পারি না আমার সামাজিক অবস্থানের জন্য। কিন্তু ওই সমাজটার অস্তিত্ব আছে। শুধু আছে নয়, সংখ্যায় তারাই বেশি। এবং তারা ভোট দেয়। আর তাদের কবি পুরন্দর ভাট অমর কবিতা লেখে—
‘সবাই বাগায়, সবাই ***
সকলেরই হবে অন্ত
আজ ওই শিশু করিতেছে ***
কালই *** দন্ত।’
(লেখক নাট্য নির্দেশক ও অভিনেতা। মতামত নিজস্ব)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy