ফেলুদা! ছোটবেলা থেকে এই ভদ্রলোকই আমার কাছে একমাত্র হিরো। প্রদোষ সি মিটারকে আমি সারা জীবন নায়ক বলেই মেনেছি। এখনও তা-ই মানি। ভবিষ্যতেও মানব। নির্বাচন এলে প্রতি বারই আমার মনে হয়, যাবতীয় রাজনৈতিক হিরোর চেয়ে ফেলুদা অনেক অনেক কদম এগিয়ে।
এই ভোটটা প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের। অতএব, আনন্দবাজার অনলাইনের তরফে যখন আমার কাছে ‘ফেলুদা যদি প্রধানমন্ত্রী হতেন’ লেখার প্রস্তাব এল, এক কথায় লুফে নিয়েছিলাম। হিরোকে নিয়ে লিখতে কে না চায়!
কী জানেন, আমার সঙ্গে ফেলুদার একটা অনুষঙ্গ জড়িয়ে রয়েছে। ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ মনে আছে? সেখানে উমানাথ ঘোষালের ছেলের নাম ছিল রুক্মিণীকুমার। যার ডাকনাম ‘রুকু’। ফেলুদার ওই উপন্যাস পড়েই পিসি আমার ডাকনাম রেখেছিলেন ‘রুকু’। সেই নামে এখনও বাড়ির লোকজন আমাকে ডাকেন। এর পর আমার ১০ বছরের জন্মদিনে বাবা ফেলু-কাহিনি ‘বাদশাহী আংটি’ উপহার দিয়েছিলেন। তখন চন্দননগরে থাকি। সেই প্রথম ফেলুদার সঙ্গে পরিচয়। পড়ে চমকে গিয়েছিলাম। একসঙ্গে একটা লোক এত কিছুতে কী ভাবে পারদর্শী হতে পারে! তার উপরে আবার বাঙালি। খেলাধুলো, শরীরচর্চা, তুখোড় বুদ্ধি, শান দেওয়া ব্যক্তিত্ব— কিসে যে দক্ষ নয়!
এর পর জীবনের নানা পর্বেই ফেলুদা ঘুরেফিরে এসেছেন আমার মননে। আমার পাঠে। আমার খেলাতেও। অনেক পরে যখন লখনউ গিয়েছি ক্রিকেট খেলতে, তখনও মাথায় ছিল, ফেলুদাও এই নবাব-শহরে ক্রিকেট খেলে গিয়েছেন। ভুলভুলাইয়ায় ঘুরে বেড়িয়েছেন। বারাণসীতে ঘুরতে গিয়ে খুঁজেছি রুকু অর্থাৎ ‘ক্যাপ্টেন স্পার্ক’দের সেই ঘোষালবাড়ি। ওদের সেই দুর্গামণ্ডপ।
মনে আছে, ফেলুদা রুকুকে বলেছিলেন, “আমার আর একটা অস্ত্র আছে। সেটা চোখে দেখা যায় না।”
রুকু প্রশ্ন করেছিল, “কী?”
ফেলুদার জবাব ছিল, “মগজাস্ত্র।”
এখনকার দিনে ফেলুদার ওই অস্ত্রটাই তো দেশের জন্য সবচেয়ে জরুরি। ফেলুদা প্রধানমন্ত্রী হলে ওই অস্ত্রেই সমাধান করতেন বাঘা বাঘা সব ‘কেস’।
জানি, ফেলুদার সঙ্গে রাজনীতির কোনও যোগ কোনও দিন ছিল না। তিনি যে রাজনীতি ভালবাসতেন, এমনও নয়। একেবারেই ব্যক্তিগত কাজকম্মে বিশ্বাসী। খুশিও। কিন্তু ফেলুদার মতো তুখোড় ব্যক্তিত্ব এখনকার দুনিয়ায় নেতা হিসাবে বড্ড জরুরি। ফেলুদার ‘অবজ়ার্ভেশন’ নিয়ে তো কোনও কথাই হবে না। তার পর সেই সব পর্যবেক্ষণকে নানা ভাবে জারিয়ে হয় ‘সমাধান’। ফেলুদা কখনও কোনও কাজে অসফল হননি। সব কাজেই তাঁর ‘ডেটা’ অর্থাৎ তথ্য সংগ্রহ করার কাজটা অত্যন্ত নিখুঁত। সব কিছু নখদর্পণে রাখার চেষ্টা করতেন। আমার মনে হয় দেশের প্রধানমন্ত্রীর চারিত্রিক কাঠামোর জন্য ফেলুদার এ সব গুণ অত্যন্ত কার্যকরী এবং জরুরি হত।
ফেলুদার এত রহস্য উপন্যাস পড়েছি। কিন্তু কোথাও ধর্ম বা জাতপাত নিয়ে তাঁর কোনও মন্তব্য পড়িনি। মতামতও শুনিনি। মন্দির-মসজিদ বা গোরস্থানের উল্লেখ ওই সব কাহিনিতে রয়েছে। কিন্তু ধর্ম নিয়ে একটি শব্দও নেই। এখনকার দিনে দাঁড়িয়ে এটা আমার খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। ছোটবেলায় মনে হয়নি। বড়বেলায় এসে বুঝেছি, এটা এক জন নায়কের চরিত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক। তাঁকে সকলের হয়ে উঠতে হয়। সকলের আস্থা অর্জন করতে হয়। ফেলুদা প্রধানমন্ত্রী হলে আমার এই ইচ্ছেটা পূরণ হত। উনি কখনওই ধর্মকে প্রাধান্য দিতেন না। জাতপাত নিয়েও ফেলুদার কোনও মাথাব্যথা ছিল না। কে কোন জাত, এটা ওঁর কাছে কখনও প্রাধান্য পায়নি। এমন মানসিকতার এক জন নায়ক যদি দেশ পেত, তা হলে তো আমরা খুব শান্তিতে থাকতে পারতাম। ফেলুদা প্রধানমন্ত্রী হলে রাজনীতিতে কখনও ধর্মের আগ্রাসন হত না। জাতপাতও ঢুকত না। এটা থেকে উনি দেশবাসীকে বিরত রাখতেনই।
আমাদের ছোটবেলায় মানুষের এত মনের সমস্যা ছিল না। ছোটবেলা কেন, বড়বেলাতেও স্কুলে কখনও ‘কাউন্সেলিং’-এর ব্যাপার শুনিনি। এখন কিন্তু বেশির ভাগ স্কুলেই দেখি ‘কাউন্সেলর’ রয়েছেন। কোনও সমস্যা তৈরি হওয়ার উপক্রম হলেই রয়েছে তাঁর পরামর্শ। ইদানীং মনে হয়, আমরা বড্ড বেশি মনের সমস্যায় ভুগছি। সব সময় কথাগুলো কাছের কাউকেও বলে ওঠা যায় না।
ফেলুদা কিন্তু মানুষের মন পড়তে পারতেন। ওই যে রুকুকে বলেছিলেন, ‘মগজাস্ত্র’ দিয়ে তিনি মনের ভিতরটা পড়ে ফেলতে পারতেন। ফেলুদা প্রধানমন্ত্রী হলে আমাদের মনের সমস্যাও অনেকটা কমে যেত। উনিই তো ভিতরটা পড়ে ফেলে সমাধান বাতলে দিতেন! ফলে কাউন্সেলরের প্রয়োজনীয়তাই থাকত না।
ফেলুদার যে রকম মেধা, তেমনটা যে সকলের হবে, তা নয়। ওঁর কত-কত বিষয়ে জ্ঞান! নিজে না-জানলে সেটা নিয়ে দ্বারস্থ হতেন সিধুজ্যাঠার। জেনে নিতেন। শুনে নিতেন। বুঝে নিতেন। পাশাপাশি, তোপসে আর লালমোহনবাবুকে যে ভাবে ফেলুদা সাধারণ জ্ঞান থেকে অতি জটিল-কঠিন বিষয়ে ‘শিক্ষিত’ করতেন, তা-ও উল্লেখযোগ্য। ফেলুদা প্রধানমন্ত্রী হলে আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ এ ভাবে শিক্ষিত হতে পারত। এত জটিলতার ভাঁজ থাকত না সেখানে। সবটাই হত সহজ-সরল ভাবে। ঘরোয়া পদ্ধতিতে। সেই শিক্ষায় থাকত না কোনও খামতি। যেমনটা তোপসের হয়েছিল। লালমোহনবাবুরও।
শরীরচর্চার অভ্যাস ফেলুদার দীর্ঘ দিনের। প্রচণ্ড স্বাস্থ্য সচেতন। ঘরোয়া ভাবেই রোজকার যাপনে তিনি যোগচর্চাকে রেখেছেন। ফেলুদা প্রধানমন্ত্রী হলে সাধারণ নাগরিকের মধ্যেও এই স্বাস্থ্যসচেতনতার প্রভাব পড়ত। শিক্ষার মতো স্বাস্থ্যক্ষেত্রেও নিজের মতো করে ফেলুদা ছড়িয়ে দিতেন নিজের ভাবনা। নিজের বোধ। তাতে আম আদমির সুবিধাই হত।
একই সঙ্গে খেলাধুলোর প্রতিও মানুষটার তুমুল আগ্রহ ছিল। নিজে একটা সময়ে তুখোড় ক্রিকেটার ছিলেন। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনে ‘স্লো স্পিন’ করতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে ভারতের নানা প্রান্তে ক্রিকেট খেলে বেড়িয়েছেন। সেই মানুষটা প্রধানমন্ত্রী হলে ক্রীড়া মহলও বিশেষ ভাবে উপকৃত হত। খেলা নিয়ে তাঁর যে ব্যুৎপত্তি, তা ছড়িয়ে যেত দেশের নানা প্রান্তে।
আর একটা বিষয় এই ভোট এলেই দেখি— সকলে শুধু প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। দিয়েই যাচ্ছেন। ফেলুদা কিন্তু প্রতিশ্রুতি দিতেন ইতিবাচক অর্থে। এবং সেই প্রতিশ্রুতি রাখতেন। সময়সীমা মেনেই। তাঁর সময়ানুবর্তিতা নিয়ে আমাদের অর্থাৎ ভক্তদের কোনও প্রশ্ন কোনও কালেই ছিল না। ফলে ফেলুদা প্রধানমন্ত্রী হলে দেশবাসী তাঁর কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি পেতেন এবং সময়ের মধ্যে সেই প্রতিশ্রুতি যে তিনি পূরণও করতেন— তা নিয়ে আমার মনে কোনও সংশয় নেই।
আসলে দেশের প্রধানমন্ত্রীকে তো সব ব্যাপারে দক্ষ হতে হয়। দড় হতে হয়। তাঁকে সবটা নিজের নখদর্পণে রাখতে হয়। তথ্য রাখতে হয়। সমস্যার সমাধান বাতলাতে হয়। রাজধর্ম পালন করতে হয়। জাতির শিক্ষা-স্বাস্থ্য-খেলাধুলো-মনন-ভাল থাকা-উন্নয়ন নিয়ে নিজস্ব দর্শন থাকতে হয়। পরিকল্পনা করতে হয়। সেটা কার্যকর করতে হয়। সেই জায়গা থেকে আমার মনে হয়, ফেলুদার মতো দক্ষ এক জন বাঙালি চরিত্র যদি প্রধানমন্ত্রী হতেন, তা হলে আমাদের মতো সাধারণ নাগরিক খুবই স্বস্তিতে, শান্তিতে এবং নির্ভাবনায় থাকতেন।
(লেখক পেশাদার ক্রিকেটার। মতামত নিজস্ব)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy