Advertisement
Back to
Devlina Kumar

আমাদের অদ্ভুত বাড়ি! ভোট এলেই দেবলীনাদের বাড়ি ‘অদ্ভুত’ হয়ে যায়

মনোজদের বাড়িতে অনেক লোক থাকতেন। মনোজের ভাই সরোজ, ঠাকুমা, বাবার এক বুড়ি পিসি, মা, বাবা, দুই কাকা, দিদি, দাদা, দুটো ডলপুতুলের মতো ছোট ভাইবোন। থাকতেন এক জন নিরাশ্রয় বুড়োমানুষ।

Bengali Actress Devlina Kumar writes on the upcoming Lok Sabha Election 2024
দেবলীনা কুমার
শেষ আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ০৮:০০
Share: Save:

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের কিশোর উপন্যাস ‘মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি’ মনে পড়ে? উপন্যাসের সেই বাড়ির সঙ্গে মিল নেই খুব একটা। কিন্তু ভোট এলে আমাদের বাড়িটাও খানিক ‘অদ্ভুত’ হয়ে যায় বইকি! আমার চেনাজানা বাড়িগুলোর থেকে অনেক আলাদা।

মনোজদের বাড়িতে অনেক লোক থাকতেন। মনোজের ভাই সরোজ, ঠাকুমা, বাবার এক বুড়ি পিসি, মা, বাবা, দুই কাকা, দিদি, দাদা, দুটো ডলপুতুলের মতো ছোট ভাইবোন। থাকতেন এক জন নিরাশ্রয় বুড়োমানুষ। তাঁর বাড়ি ছিল বিহারে। এক জন বাচ্চা চাকর, এক রান্নার ঠাকুর, এক বুড়ি ঝি। তা ছাড়া বিস্তর বাইরের লোকজনের রোজ আসা-যাওয়া তো ছিলই। পুরুতমশাই সতীশ ভরদ্বাজ, মাস্টারমশাই দুঃখহরণবাবু, মনোজের দিদির গানের মাস্টারমশাই গণেশ ঘোষাল, এমনি আরও কত কে! আমাদের বাড়িতে এত লোকলশকর থাকেন না। থাকি তিন জন— বাবা, মা আর আমি।

আমার বাবা দেবাশিস কুমার প্রথম যে বার ভোটে দাঁড়ান, তখন আমি ক্লাস থ্রি-তে। বাবার ছোটবেলা থেকেই বাড়ির পরিবেশ রাজনীতি ঘেঁষা। আমাদের পরিবার বরাবরই অবামপন্থী। সকলেই। মায়ের কাছে শুনেছি, বাবা কলেজজীবনেই সরাসরি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। পরে বাবা আমাকেও বলেছেন, রাজনীতি তাঁর কাছে একটা ভাল লাগার জায়গা। ফলে যে বয়সে অন্য বাচ্চারা ‘রাজনীতি’ শব্দটাও শোনেনি, সেখানে আমি সাত-আট বছর বয়সেই ভোট, পদযাত্রা, বক্তৃতা, নেতা, দল— ইত্যাদি শব্দ শিখে ফেলেছিলাম। সেগুলো শুনতে শুনতেই বড় হয়েছি। শুধু শুনিনি, যত বয়স বেড়েছে, সে সব শব্দের অর্থও বুঝেছি। কখন যে আপনা থেকেই আমার মনে রাজনীতি সম্পর্কে আগ্রহ এবং কৌতূহল তৈরি হয়েছে, তা এখন আর মনে নেই।

তবে বাবার রাজনীতির কারণে আমাদের পরিবার তিন সদস্যে থেমে থাকেনি। সকাল থেকেই বাড়িতে বহু লোকের আনাগোনা। বাইরে বেরোলেও কত-কত মানুষ! তাঁরা আমাদের বৃহত্তর পরিবারের অংশ। সে ভাবেই বাবা ছোটবেলা থেকে ‘পরিবার’ বোধটা তৈরি করে দিয়েছেন। আর ভোটের সময় এলে তো আমাদের বাড়িতে মনোজদের বাড়ির চেয়েও বেশি চরিত্রের ভিড়। তাদের নানা কীর্তিকলাপ। সে সত্যিই এক অদ্ভুত ব্যাপার। ছোটবেলা থেকে কত চরিত্রের নাম জুড়ে গিয়েছে আমার উপন্যাসে। তাঁরা এখনও ঘুরে বেড়ান সেই উপন্যাসের পাতার পর পাতায়।

বাবা যে বার প্রথম কাউন্সিলর প্রার্থী হলেন, সে বার ‘ববিকাকু’ (কলকাতার মেয়র আর রাজ্যের মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম নন) বলে এক জন ওঁর হয়ে খুব খেটেছিলেন। বাড়িতে তাঁর রোজ যাতায়াত। বাবার সঙ্গে প্রায় সর্ব ক্ষণ থাকতেন। বাবা ব্যস্ত থাকতেন বলে ববিকাকু আমাকে স্কুলে দিয়ে আসতেন। নাচের ক্লাসে নিয়ে যেতেন। তার পর ববিকাকু কোথায় যে হারিয়ে গেলেন! তবে ওঁর মুখটা ভুলিনি আমি। স্পষ্ট মনে আছে। এ রকম হাজারো চরিত্র আমাদের পরিবারের সঙ্গে জুড়ে গিয়েছে। অতীতে। বর্তমানেও।

সুযোগ পেলে বাবার মতো আমিও ভোটে প্রচার করি। দল বা দলের প্রার্থী সম্পর্কে যতটা বুঝি, মঞ্চ থেকে সেটা বলার চেষ্টা করি। রাজনৈতিক মিছিলে হাঁটতে ভাল লাগে। ভোটের সময় পেশাগত ব্যস্ততা না-থাকলে আমি এখনও মিছিলে থাকি। খুব বড় পরিসরে না হলেও ঘরোয়া রাজনৈতিক আলোচনা আমার শুনতে ভাল লাগে। খারাপও লাগে, যখন দেখি, আমার বয়সি অনেকেই ‘রাজনীতি’ মানে শুধু ভোট দেওয়া বোঝে। তার বাইরে তাদের রাজনীতি সম্পর্কে কোনও সম্যক ধারণা নেই।

ছোট থেকে বাবাকে অনেকগুলো নির্বাচন পার করতে দেখেছি। এখন তো বাবা ৮৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর। পাশাপাশি উদ্যান বিভাগের মেয়র ইন কাউন্সিল। গত বিধানসভা নির্বাচনে বাবা রাসবিহারী কেন্দ্রের বিধায়কও হয়েছেন। এত ভোট পেরিয়ে বাবা এই জায়গায় পৌঁছেছেন। কিন্তু ওঁর মনের ভিতরে কী হয়, তা বলতে পারব না। বাবা কখনও শেয়ারও করেন না। তবে বাইরে থেকে দেখলে বাবাকে খুব আত্মবিশ্বাসী মনে হয়। তবে তা কোনও ভাবেই অতি আত্মবিশ্বাস নয়। ভোটের ফলাফল বাবা আগাম অনুমান করতে পারেন খুব ভাল। যে যে জায়গার ফলাফল সম্পর্কে বাবা বলেছেন, ফল বেরোলে দেখেছি অনেকটাই মিলে গিয়েছে। বাবা রাজনীতিকে হালকা ভাবে নেন না। খুব গভীর ভাবে চিন্তাভাবনা, পড়াশোনা করেন। বাবার পর্যবেক্ষণও খুব ভাল।

তবে ভোট এলেই বাবা কেমন যেন পাল্টে যান। ব্যস্ততা তুঙ্গে। সেই ব্যস্ততার মধ্যেই মা আর আমি গুঁজে থাকি। ওটা আমাদের একটা দারুণ ভাল লাগা। বাড়ির চেহারাও বদলে যায়। সারা দিনে বাবা খেতে আসেন মাত্র এক বার। বাকিটা বাইরেই থাকেন। বাবা বলেন, ভোট কখনও তুড়ি মেরে জেতা যায় না। রাজনীতি করতে গেলে পুরো সময়টা জনতার জন্য রাখতে হয়। নিজের জন্য কোনও সময় রাখা যায় না। রাখলে চলেও না। বাবা মনে করেন, সে সব বুঝেসুজেই কারও রাজনীতিতে আসা উচিত। ছোট থেকে বাবার মুখে শুনে এসেছি, ‘‘ভোটে দাঁড়ালে দায়িত্ব বেড়ে যায়। জেতার পর জিতে গিয়েছি বলে মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে গেলে হবে না। আরও বেশি সময় দিতে হবে। যাঁরা জিতিয়েছেন, তাঁদের জন্যই কাজ করে যেতে হবে। তা হলেই সাধারণ মানুষ মনে রাখবেন।’’ তবে বাবা শুধু মুখে কথাগুলো বলেন না, অক্ষরে অক্ষরে মেনেও চলেন। নিজে ভোটে দাঁড়ান বা অন্য কেউ, বাবা সব ক্ষেত্রেই সমান গুরুত্ব দিয়ে পথে নামেন।

এই লোকসভা ভোটে আমাদের এখানে শেষ দফায় ভোট। আমাদের কেন্দ্র দক্ষিণ কলকাতা। তৃণমূলের প্রার্থী মালা রায়। বাবা কিন্তু কয়েক মাস আগে থেকেই মাঠে নেমে পড়েছেন। সকাল থেকে নিজের ওয়ার্ড, যেটা বালিগঞ্জ বিধানসভার মধ্যে পড়ে, সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। একই সঙ্গে নিজের রাসবিহারী কেন্দ্রের সমস্ত ওয়ার্ডেও মানুষের দরজায় দরজায় যাচ্ছেন। বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েন সকাল সাড়ে ৮টায়। তার পর পার্টি অফিসে বসেন। দুপুরে কোনও রকমে বাড়ি ফিরে কিছু খেয়ে আবার বেরোনো। এরই মধ্যে কোনও দিন পুরসভা, কোনও দিন বিধানসভা। সেখানে কাজকম্মো সেরে আবার বিকেল ৪টে থেকে শুরু করেন কর্মিসভা।

ভোট যত এগোবে, তত বেড়ে যাবে বাবার মিটিং-মিছিলের সংখ্যা। বাড়ি ফিরতে ফিরতে সেই রাত সাড়ে ১১টা বা ১২টা। ফিরেই খেয়ে নেন। সারা দিন মোবাইলে খবরাখবর দেখে নেন। রাতে ফিরে কিন্তু চার-পাঁচটা খবরের কাগজ পড়তেই হবে বাবাকে। কারণ, ওঁর কথায়, ‘‘নইলে আপডেটেড থাকা যায় না।’’

ভোট এলেই বাবার খুব অনিয়ম হয়ে যায়। মা আর আমার এত বছর ধরে বাবার এ সব ‘কীর্তি’ দেখে দেখে অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। আমরা আর বারণ করি না। করলেই বা শুনছে কে! লাভ হয় না। কথাই শোনেন না মোটে। তাই অনেক বছর ধরে আমরা চুপ করে গিয়েছি। তবে বাবা বাড়ি ফিরলে মা আর আমি ঘিরে ধরি। বাইরে সারা দিন কী হল শুনতে চাই। শুনতে ভালবাসি।

ভোট যত এগিয়ে আসে, আমাদের বাড়িতে উত্তেজনার পারদ তত চড়তে থাকে। বাড়িটা আরও ‘অদ্ভুত’ হয়ে উঠতে থাকে। মনোজদের বাড়ির চেয়েও।

(লেখক অভিনেত্রী। মতামত নিজস্ব)

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy