‘জন গণ মন’-তে উল্লেখ নেই ভারতের সব প্রদেশ বা রাজ্যের। আপত্তি অমূলক নয়। কিন্তু কী আর করা যাবে?
সারমর্ম দিয়েই শুরু করা যাক। রবীন্দ্রনাথের জাতীয়তাবোধ কিংবা দেশপ্রেম বিজেপি-আরএসএস এর জাতীয়তাবাদের সঙ্গে মেলে না। রবীন্দ্রনাথ সাজা সহজ, বোঝা কঠিন। যে কোনও উদারবাদী বুদ্ধিজীবীর মতই কবির ভাবনা একমাত্রিক নয়। ফলে যেমন তিনি দেশকে কখনও ভাল বলেছেন, তেমনই সমালোচনাও করেছেন। আর দেশকে সমালোচনা করা মানে তো মাটি, গাছ, পাহাড়, নদীর গুণ বিচার নয়, যে মানুষগুলো দেশ চালাচ্ছেন তাঁদের মত এবং পথের বিশ্লেষণ। সে সব জেনে, বুঝে, পড়ে কিংবা পারিষদবর্গের থেকে অনেক বেশি শুনে বিরক্ত হতেই পারেন রাষ্ট্রনায়ক। সেই প্রেক্ষিতে শক্তিশালী কোনও দেশনেতা যদি জাতীয় সঙ্গীতে সিন্ধু বদলে বিন্দু বসাতে চান, অমিত বিক্রম শাসক যদি গোটা জাতীয় সঙ্গীতটাই বদলে দিতে চান, তা অবশ্যই সম্ভব। তবে খ্যাতনামা কবি কিংবা সাহিত্যিকদের সুবিধে হল তাঁরা না থাকলেও তাঁদের কাজ থেকে যায়। আর পছন্দ না হলেও সুযোগমত তা কাজে লাগান রাজনীতির কারবারিরা। বঙ্গমননে সুড়সুড়ি দিতে তাই যে কোনও দলের কাছে আড়াই মন রবীন্দ্রনাথ আজ বহুমূল্য সম্পদ।
এখন প্রশ্ন হল কবির কতটুকু নেবে কোন রাজনৈতিক দল? আলোচনা যেহেতু জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে, তাই আপাতত বামেদের বুর্জোয়া কবি সংক্রান্ত চুলচেরা বিশ্লেষণ কিংবা তৃণমূলের ল্যাম্পপোস্টে মাইক টাঙানো রবীন্দ্রসঙ্গীত এই লেখায় সরিয়ে রাখা যাক। প্রধান প্রশ্ন এখন বিজেপি কিংবা আরএসএস কী ভাবে ব্যবহার করবে রবীন্দ্রনাথকে? রাজনীতির বাইনারির মত রবীন্দ্রনাথ জাতীয়তাবাদী ছিলেন কি ছিলেন না তা এক কথায় বলা অসম্ভব। তবে আরএসএস-বিজেপির উগ্র সামরিক জাতীয়তাবাদ থেকে তাঁর অবস্থান যে কয়েক যোজন দূরে তা নিয়ে বিশেষ সন্দেহ নেই। মানসী কাব্যগ্রন্থে ‘দেশের উন্নতি’ কবিতায় তিনি লিখছেন— অন্ধকারে ওই রে শোন ভারতমাতা করেন ‘গ্রোন’। অর্থাৎ ব্যাঙ্গার্থে দেশমাতৃকার কোঁকানোর কথা বলতে পারেন এই কবি। সুতরাং দক্ষিণপন্থী একটি দল দেশমাতাকে যে গুরুগম্ভীর দৃষ্টিতে দেখেন, তাতে কিন্তু রসিক এবং বুদ্ধিমান রবীন্দ্রনাথের ফচকেমির স্থান নেই। এদিকে বাংলায় সামনে বিধানসভা নির্বাচন। সেখানে রবীন্দ্রের দক্ষিণায়ন কিংবা বিজেপির রবীন্দ্রায়ন কী ভাবে সম্পন্ন হয় তা আগামীর গর্ভে। ভাবের দ্বন্দ্ব থেকে রাজনীতির স্বার্থে বিপরীতমুখী ভাবনাকে আত্মস্থ করাটাই কৌশল। সাংগাঠনিক শক্তিতে বলীয়ান বিজেপি এই মুহূর্তে দেশের সব থেকে এগিয়ে থাকা রাজনৈতিক দল, এবং এটা মানতেই হবে যে তাঁদের দলে অনেক বিদ্বান মানুষ আছেন। ফলে নির্বাচনী রবীন্দ্র ভাবনায় তাঁরা হয়তো ভবিষ্যৎ রচনা করবেন, কিন্তু অতীত ইতিহাস তাতে বদলাবে না। এবার সেই দিকেই চোখ রাখা যাক।
একশ দশ বছর আগে শীতের ডিসেম্বর মাস। কলকাতায় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের বার্ষিক সম্মেলন। রবীন্দ্রনাথকে অনুরোধ করা হল সভায় পাঠ করা হবে এমন একটা কবিতা লেখার জন্য। দিনটি ২৭ ডিসেম্বর, ১৯১১ কংগ্রেসের অধিবেশনের দ্বিতীয় দিন। পড়া হল ‘ভারত ভাগ্য বিধাতা’। এর পর কবির নিজের সম্পাদনায় প্রকাশিত ব্রাহ্ম সমাজের মুখপত্র তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় কবিতাটি মুদ্রিত হল ১৯১২ সালে জানুয়ারি মাসে। কবিতায় সুরারোপ করলেন গুরুদেব, গাইলেন কবির ভাইঝি সরলা দেবী চৌধুরানী। পরবর্তী সময়ে কবি যে শুধু নিজের কন্ঠে এই গান গাইলেন তা নয়, ইংরেজিতে অনুবাদ করলেন ১৯১৯ সালে। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু সুদূর জার্মানিতে প্রবাসে থাকার সময় হামবুর্গে ১১ সেপ্টেম্বর ১৯৪২ সালে জার্মান ইন্ডিয়ান সোসাইটির প্রথম সভায় ভারতের জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে অর্কেস্ট্রায় পরিবেশিত হল সেই গান। অবশেষে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগষ্ট ইন্ডিয়ান কন্স্টিটিউয়েন্ট আ্যসেম্বলিতে মধ্যরাতের বিশেষ অধিবেশনে ব্রিটিশদের থেকে ক্ষমতা হস্তান্তরের সেই ঐতিহাসিক মূহুর্তে সাক্ষী থাকল ‘জন গন মন’। স্বাধীনতার পরে ১৯৫০ সালের ২৪ জানুয়ারি সংবিধান স্বীকৃতি দিল জাতীয় সঙ্গীত রূপে। সে তো হল, কিন্তু একই সঙ্গে শুরু থেকেই পিছু নিলো নানা বিতর্ক - কখনও অভিযোগ, কখনও বা অপপ্রচার। কয়েকটি ক্ষেত্রে আবার বিরোধী যুক্তিকে একেবারে অবজ্ঞা করা যায় না। সেগুলোর কয়েকটাকে তালিকাভুক্ত করা হল এখানে। সাহিত্যের ইতিহাস অঙ্ক নয়। ফলে বিধিসম্মত সতর্কীকরণ রইল এই তালিকা এবং তার ব্যাখ্যার বহুমত নিয়ে।
এক
১৯৮৬-তে বিজো ইমানুয়েল বনাম কেরল সরকার মামলার ইতিহাস বলছে, সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুযায়ী রাষ্ট্র কাউকে জাতীয় সঙ্গীত গাইতে বাধ্য করতে পারে না।
ইংল্যান্ডের রাজা জর্জকে অভ্যর্থনার নিমিত্ত নাকি এই কবিতাটি লেখা। খোদ কবিগুরুকেই এর জবাবদিহি করতে হয়েছে। ইংলিশম্যান, স্টেটসম্যান এইরকম কয়েকটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে (২৮ ডিসেম্বর ১৯১১) এই বিভ্রান্তির অবতারণা। ইতিহাস বলছে, সেটি যে সঠিক তার কোনও সুনিশ্চিত প্রমাণ নেই। সেই সময়ের জাতীয়তাবাদী সংবাদমাধ্যম যেমন অমৃতবাজার পত্রিকা বা দি বেঙ্গলি দার্শনিকতার সঠিক অর্থে কবিগুরুর গানের কথা জানিয়েছিল। সম্ভবত কবি সরাসরি চাননি রাজার প্রশস্তি সূচক কোনও রচনা। তবে সবটাই তো ব্যাখ্যা। সেই পরম্পরায় আজও ছেদ নেই। প্রবল পরাক্রান্ত কোনও সংগঠনের মতাদর্শ 'অধিনায়ক' শব্দটির ব্যবহারের ঘোরতর বিরোধী হলে তাই সেই শক্তি মেনে নিয়ে ভিন্ন শব্দসন্ধান চলতেই পারে।
দুই
‘জন গণ মন’-তে উল্লেখ নেই ভারতের সব প্রদেশ বা রাজ্যের। আপত্তি অমূলক নয়। কিন্তু কী আর করা যাবে? রাজ্যসংখ্যা বা আঞ্চলিকতা রাষ্ট্রের চরিত্র বদলে দিচ্ছে নিয়মিত। বড় রাজ্য ভাঙছে ছোট ছোট অংশে, কখনও ভাষা, কখনও কৃষ্টি, কখনও বা নিজস্ব সংস্কৃতির স্বকীয়তায়। কখনও বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে। উদাহরণ প্রচুর। যেমন বিহার থেকে এসেছে ঝাড়খণ্ড, অন্ধ্রপ্রদেশ ভেঙে তেলেঙ্গানা, উত্তরপ্রদেশের থেকে উত্তরাখন্ড। দাবি আছে বোড়োল্যান্ড কিংবা গোর্খাল্যান্ডের। অর্থাৎ সব সামলাতে গেলে জাতীয় সঙ্গীতে আঞ্চলিক কৃষ্টির সমাদর ক্রমপরিবর্তনশীল হতে হবে। মনে রাখতে হবে, আশির দশকে অসমেও এমন দাবি উঠেছিল যে কবিতার মূল খসড়ায় নাকি ‘কামরূপ’ শব্দটি ছিল। পরে দেখা যায়, তার সারবত্তা নেই। তবে শব্দজব্দে সরকার বাৎসরিক কবি সম্মেলনের কথা ভাবতেই পারেন। রাষ্ট্রের দাক্ষিণ্য জুটলে অনেক কবিই কবিগুরুর কবিতার ওপর কলম চালাতে রাজি হয়ে যাবেন।
তিন
‘সিন্ধু’ শব্দটি একান্ত আপত্তিকর। কারণ এটি এখন চিরবৈরী পাকিস্তানে। বিশেষজ্ঞরা যে ভাবেই ব্যাখ্যা করুন সিন্ধু সংক্রান্ত ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার, রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা বড় বালাই। তবে রাজনীতিতে স্ববিরোধিতা থাকেই। আর তার সঙ্গে মনে রাখতে হবে জনগণের স্মৃতি বেশিদিন টেকে না। তাই সামনের বিধানসভা নির্বাচনটুকু বোলপুরে মিছিল করে সামলে নিতে পারলেই হল। ভোট মিটলে শব্দটা সুযোগমত বদলে নেওয়া যাবে।
চার
জনসমক্ষে জাতীয় সঙ্গীত বাজলে সেখানে উঠে না দাঁড়ানো কিংবা একটু গলা না মেলানোর মধ্যে যে অতি-বাম ভাবনা কাজ করে, তা উগ্র জাতীয়তাবাদের থেকে তীব্রতায় কিছু কম নয়।
জাতীয় সঙ্গীতে কণ্ঠ মেলানোয় গুরুতর আপত্তি আছে কিছু নাগরিকদের। যুক্তি হিসাবে ধর্মীয় রীতি বা নিষেধাজ্ঞার উল্লেখ করা হয় থাকে মাঝে মাঝে। ১৯৮৬-তে বিজো ইমানুয়েল বনাম কেরল সরকার মামলার ইতিহাস বলছে, সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুযায়ী রাষ্ট্র কাউকে জাতীয় সঙ্গীত গাইতে বাধ্য করতে পারে না। শুধু উঠে দাঁড়ানোর মধ্যে দিয়েই নাকি যথেষ্ট সম্মান জ্ঞাপন করা যায়। তবে এখানে বলতেই হয় যে জনসমক্ষে জাতীয় সঙ্গীত বাজলে সেখানে উঠে না দাঁড়ানো কিংবা একটু গলা না মেলানোর মধ্যে যে অতি-বাম ভাবনা কাজ করে, তা উগ্র জাতীয়তাবাদের থেকে তীব্রতায় কিছু কম নয়। দক্ষিণপন্থা, উগ্র জাতীয়তাবাদ, কিংবা ধর্মীয় মৌলবাদের হাত শক্ত করার জন্যে অতিবামদের অনন্ত প্রচেষ্টাকে তাই চট করে ভুলে যাওয়া শক্ত।
পাঁচ
সম্প্রতি আবার মাথা চাড়া দিয়েছে একটি দাবি— আমাদের জাতীয় সঙ্গীত শুধু সংশোধন নয় একেবারে পরিবর্তন করতে হবে। পরিবর্ত হিসাবে নেতাজি সুভাষচন্দ্রের আইএনএ-র জাতীয় সঙ্গীতের কথা আসছে। সুস্থ গণতন্ত্রে দেশের নাগরিক যে কোনও প্রশ্ন তুলতেই পারেন। সে অধিকার আমার আপনার সকলের। এমন উদাহরণ সব দেশেই আছে। তা ছাড়া বিশ্ব জুড়ে জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে বিতর্ক নতুন কিছু নয়। বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রূপে জাতীয় সঙ্গীতের রূপায়ণ তথা বিবর্তন, পরিমার্জন ও সংশোধন সম্ভব হচ্ছে নিয়মিত ভাবে। রুশ বিপ্লবের পরে স্টালিনের নেতৃত্বে ১৯৪৪ সালে যেটি জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে প্রচলিত হয়েছিল, প্রজাতন্ত্র ভেঙে রাশিয়া গঠনের সময় সেটিতেই কিছু পরিবর্তন করে গৃহীত হয় নতুন রূপ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফসল দু-টুকরো জার্মানির পুনর্মিলনের সময় বাধা হয়নি জাতীয় সঙ্গীত। সেই হিসেবে কোনও ধর্মনিরপেক্ষ দেশ যদি ধর্মরাষ্ট্রে উত্তীর্ণ হয়, সেক্ষেত্রে জাতীয় সঙ্গীতের ‘রঘুপতি রাঘব রাজা রাম’ এর আশীর্বাদধন্য হতে ক্ষতি কি?
এ প্রসঙ্গে একটা কথা বলতেই হয়, রবীন্দ্রনাথ দেশের সীমানা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে পৌঁছেছেন অনেক দিন আগেই। শুধু ইংরিজি নয়, ইউরোপের বিভিন্ন উন্নত দেশেও তিনি পঠিত হয়েছেন বিভিন্ন ভাষায়। ফলে কোনও দেশে বিশ্বকবির জাতীয় সঙ্গীত লাগু না থাকলেও লেখনীর মর্যাদা বিশেষ হ্রাস পাবে না। তাঁর লিখে যাওয়া অক্ষররাশির আকর্ষণ কমবে না এতটুকু। মুশকিল অন্য জায়গায়। তাঁর লেখা বদলে কিংবা মুছে দিয়ে যে শাসকগোষ্ঠী পরম পরিতৃপ্তি পাবেন, রবীন্দ্রনাথের আত্মা হয়তো বিষম বিষণ্ণ হবেন তাদের কথা ভেবে। ‘ঘরে বাইরে’ উঁকিঝুঁকি দিয়ে হয়তো ফিসফিস করে বলবেন নিখিলের সেই কথাগুলি, “আমি তোমাকে সত্য বলছি সন্দীপ, দেশকে দেবতা বলিয়ে যখন তোমরা অন্যায়কে কর্তব্য, অধর্মকে পুণ্য বলে চালাতে চাও তখন আমার হৃদয়ে লাগে বলেই আমি স্থির থাকতে পারি নে।” তবে রবীন্দ্রনাথের অস্থিরতা তো আর শাসকের ক্ষমতার অধিক নয়। তাই তাঁর রচনাকে রাজনীতির বাহন হওয়া থেকে আটকানো কঠিন। তবে রাজনীতি যা কাড়তে পারে না তা হল পাঠক পাঠিকার মননশীলতা। আজ রবিবার শীতের রোদ্দুরে পিঠ পুড়িয়ে অপরিবর্তিত ‘জন গণ মন’ গাইলে রুখবে কোন সরকার? ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির’, সেখানে শিরদাঁড়া সোজা রেখে রবীন্দ্রসঙ্গীতে সুর বাঁধলে আদালতের সমন ধরাবে কে?
(শুভঙ্কর ঘোষ সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের এবং শুভময় মৈত্র ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক)
—ফাইল চিত্র।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy