Advertisement
E-Paper

তেলের বাজারে ধাক্কা

ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই অপরিশোধিত খনিজ তেল, তৈলজাত সামগ্রী ও প্রাকৃতিক গ্যাস রফতানি রাশিয়ার যুদ্ধ ও অন্যান্য খরচ সামলানোর প্রধান উপায়।

শাশ্বত চৌধুরী

শেষ আপডেট: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ০৭:১১
Share
Save

বেশির ভাগ নেতাই ভোটে জিতে গেলে আর প্রতিশ্রুতি পূরণের কথা মনে রাখেন না। দেখা যাচ্ছে, ডোনাল্ড ট্রাম্প মোটেও সেই দলে পড়েন না। দ্বিতীয় দফায় প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি নিজের প্রাক্‌-নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি রক্ষায় নেমে পড়েছেন। তাঁর ‘বাণিজ্য-যুদ্ধ’ নিয়ে বিস্তর হইচই হচ্ছে। তেল ও জ্বালানিসংক্রান্ত নীতি নিয়ে তুলনায় কম আলোচনা হচ্ছে বটে, কিন্তু গুরুত্বে সেটা খুব পিছিয়ে নেই।

নির্বাচনের আগে যেমনটা বলেছিলেন, সেই অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আমেরিকার খনিজ তেল উৎপাদকদের আহ্বান করলেন আরও বেশি পরিমাণে অপরিশোধিত খনিজ তেল উত্তোলন করে নিজেদের ও আমেরিকার অর্থব্যবস্থার সমৃদ্ধি বাড়ানোর জন্য। তাঁর এই ‘উদার’ আহ্বানের পিছনে লুকিয়ে আছে আন্তর্জাতিক তেল-বাজার তথা বিশ্বের ভবিষ্যৎ নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা। অপরিশোধিত খনিজ তেলের মোট আন্তর্জাতিক উৎপাদনের এক-পঞ্চমাংশ আসে আমেরিকা থেকে— একক দেশ হিসাবে ভূগর্ভস্থ তেল উৎপাদনে আমেরিকা দুনিয়ায় বৃহত্তম। উৎপাদন আরও বাড়িয়ে রাশিয়াকে বিপাকে ফেলার পরিকল্পনা রয়েছে ট্রাম্পের।

ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই অপরিশোধিত খনিজ তেল, তৈলজাত সামগ্রী ও প্রাকৃতিক গ্যাস রফতানি রাশিয়ার যুদ্ধ ও অন্যান্য খরচ সামলানোর প্রধান উপায়। কিন্তু যুদ্ধজনিত কারণে বিভিন্ন ইউরোপীয় দেশ ও আমেরিকা রাশিয়ার উপরে বিভিন্ন নির্দেশিকা জারি করেছে, যার অন্যতম হল রাশিয়া থেকে আমদানিকৃত খনিজ তেলের উপরে নিষেধাজ্ঞা। রাশিয়া নিজের জেদ বজায় রাখতে অভ্যন্তরীণ মুনাফা কমিয়ে নিজেদের উৎপাদিত অপরিশোধিত খনিজ তেল আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায় কম দামে বিক্রি করছে। আমেরিকা তেলের উৎপাদন বাড়ালে বিশ্ব বাজারে তেলের জোগান আরও বাড়বে, ফলে তার দাম আরও কমবে— সেই দামের সঙ্গে পাল্লা দিতে গেলেও রাশিয়ার বিপদ, আবার পাল্লা না দিলেও বিপদ। তেলের উৎপাদন বৃদ্ধি, অতএব, রাশিয়ার বিরুদ্ধে কিস্তিমাতের চাল।

কিন্তু নিজেদের উৎপাদন বাড়িয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম নিয়ন্ত্রণ করার এই আমেরিকান প্রচেষ্টা কি আদৌ সফল হবে? আন্তর্জাতিক অপরিশোধিত খনিজ তেলের উৎপাদনের ৩৫ শতাংশ দখলে রয়েছে ১২টি তেল রফতানিকারক দেশের সংগঠন অর্গানাইজ়েশন অব দ্য পেট্রলিয়াম এক্সপোর্টিং কান্ট্রিজ় বা ওপেক-এর। তার সঙ্গে রাশিয়া এবং আরও কয়েকটি দেশ নিয়ে ওপেক-প্লাস’এর দখলে রয়েছে বাজারের ৫৪ শতাংশ। ১৯৬০ সালে ওপেক তৈরি হওয়ার পর থেকেই তারা বিভিন্ন সময় নিজেদের উৎপাদনের পরিমাণ কমিয়ে-বাড়িয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম স্থিতিশীল রাখার চেষ্টা করেছে। আমেরিকা উৎপাদন বাড়ালেও ওপেক এই নীতি থেকে সরে আসবে বলে মনে করার কোনও কারণ নেই। অনুমান যে, আমেরিকা অপরিশোধিত খনিজ তেলের উৎপাদন বাড়ালে তার প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম যাতে না কমে, তা নিশ্চিত করতে ওপেক দেশগুলি, বিশেষত সৌদি আরব, নিজেদের উৎপাদন সাময়িক ভাবে কমাবে। অন্য দিকে, আমেরিকার তেল সংস্থা এক্সন জানাচ্ছে, ট্রাম্পের তেলের উৎপাদন বাড়ানোর ঘোষণাকে সে দেশের সংস্থাগুলিই কতটা গুরুত্ব দেবে, এবং প্রেসিডেন্টের ইচ্ছা পূরণ করতে কতটা সক্রিয়তা দেখাবে, তা নিশ্চিত নয়।

এই সিদ্ধান্তের কতখানি প্রভাব ভারতের উপরে পড়তে পারে? ভারতীয় অর্থব্যবস্থা মূলত জীবাশ্ম জ্বালানির আমদানির উপরে নির্ভরশীল। ভারতের বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রধানত কয়লা-নির্ভর, পরিবহণ ক্ষেত্র খনিজ তেল-নির্ভর। ভারতের খনিজ তেল ব্যবহারের ৮৮ শতাংশ আমদানি করতে হয়। তবে এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, ভারতের অপরিশোধিত খনিজ তেল আমদানির একটি বড় অংশ ভারত ব্যবহার করে পরিশোধিত তেল রফতানির উদ্দেশ্যে। যেখানে ভারতের মোট আমদানির ২১ শতাংশ অপরিশোধিত খনিজ তেল, সেখানে এই পরিশোধিত তেল রফতানি ভারতের মোট রফতানির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।অন্যান্য জীবাশ্ম জ্বালানির মতোই অপরিশোধিত খনিজ তেলের বাজারে অনেকগুলি উৎপাদক দেশের উপস্থিতি থাকায় ভারতের বিপুল আমদানি-নির্ভরতা সত্ত্বেও শক্তি-নিরাপত্তার ক্ষেত্রে আর্থ-রাজনৈতিক পরিস্থিতির খুব বেশি প্রভাব পড়ে না।

ভারত অনেকগুলি দেশ থেকে অপরিশোধিত খনিজ তেল আমদানি করে, পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলি তার মধ্যে প্রধান। তবে ইউক্রেন-যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে রাশিয়া তুলনায় কম দামে তেল বেচতে আরম্ভ করার পর ভারতের আমদানির একটা বড় অংশ এখন সে দেশ থেকে আসে। ২০২১-২২ অর্থবর্ষে ভারতের অপরিশোধিত তেল আমদানির মধ্যে রাশিয়ার স্থান ছিল নবম। সেখানে রাশিয়া ব্যারেলপ্রতি ১৫-২০ ডলার ছাড় দিতে আরম্ভ করার পর সে দেশ থেকে ভারতের আমদানি এতটাই বাড়ে যে, ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে ভারতের অপরিশোধিত খনিজ তেল আমদানির তালিকায় রাশিয়া রয়েছে একেবারে প্রথম স্থানে।

ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে খনিজ তেলের দাম কমলে যে দেশগুলি তেল আমদানি করে, তাদের নিশ্চিত ভাবেই লাভ হবে। ভারতেরও। ডলারের দাম যে-হেতু ঊর্ধ্বমুখী, ফলে তেল আমদানি বাবদ খরচ কমলে ভারতের উপরে বৈদেশিক মুদ্রার চাপও খানিক কমবে। কিন্তু, বিশ্ব উষ্ণায়নের মোকাবিলা করার অন্যতম অস্ত্র হিসাবে পেট্রলিয়াম জ্বালানির ব্যবহার কমানোর নীতিটি আন্তর্জাতিক স্তরে গৃহীত হয়েছে। জলবায়ু-পরিবর্তন ও বিশ্ব-উষ্ণায়নের পরিপ্রেক্ষিতে ভারত ২০৭০ সালের মধ্যে নেট কার্বন-নিঃসরণ শূন্য করার লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করেছে। এই লক্ষ্যমাত্রা সফল করার জন্য বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এই পরিকল্পনার অংশ হল পরিবহণের জ্বালানি হিসেবে খনিজ তেলের বদলে বিদ্যুৎ, হাইড্রোজেন ও জৈব-জ্বালানি ব্যবহার; এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনে পুনর্ব্যবহারযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি। সম্প্রতি ভারতে বিদ্যুৎচালিত যানবাহনের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে ভারতে বিদ্যুৎচালিত গাড়ির সংখ্যা ছিল ১৫ লক্ষের সামান্য বেশি; ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে সাড়ে উনিশ লক্ষ। এ বছর ভারতে মোট যত গাড়ি বিক্রি হয়েছে, তার সাত শতাংশ ছিল বিদ্যুৎচালিত গাড়ি। হাইড্রোজেনচালিত যানের পরীক্ষামূলক ব্যবহার ও খনিজ তেলের সঙ্গে জৈব-জ্বালানি মিশ্রণসংক্রান্ত গবেষণা ও পরীক্ষানিরীক্ষা বেশ উৎসাহজনক অবস্থায় রয়েছে। ফলে, খনিজ তেলের বাজারে দামের চলন অতীতে ভারতীয় অর্থব্যবস্থায় যতখানি প্রভাব ফেলত, এখন খানিক হলেও তার তুলনায় কম প্রভাব পড়বে; ভবিষ্যতে সম্ভবত প্রভাব হবে আরও কম।

কিন্তু বিদ্যুৎ উৎপাদনে পুনর্ব্যবহারযোগ্য জ্বালানির ব্যবহারে কয়েকটি সমস্যা আছে— যেমন, ভারতে বিদ্যুতের বিপুল চাহিদা; পুনর্ব্যবহারযোগ্য শক্তির উৎপাদনে অনিশ্চয়তা এবং পরিবর্তনশীলতা; এবং কার্বন-নিঃসরণ শূন্য, এমন পুনর্ব্যবহারযোগ্য শক্তি-প্রযুক্তিতে যে রেয়ার আর্থ মেটেরিয়াল ব্যবহৃত হয়, তার জোগানজনিত সমস্যা। ভারতে এই বিরল উপাদানগুলি প্রায় পাওয়া যায় না বললেই চলে; এবং এর আন্তর্জাতিক বাজারও যথেষ্ট বিস্তৃত নয়। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, এই বাজারটি প্রধানত চিন নিয়ন্ত্রণ করে। ভারত-চিনের আর্থ-রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে এই কেন্দ্রীভূত বাজারের উপরে নির্ভরশীলতা ভারতের শক্তি-নিরাপত্তা ব্যাহত করতে পারে। বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে পারমাণবিক শক্তির ব্যবহার উপরোক্ত সব ক’টি সমস্যার একক সমাধান হতে পারে যদি উপযুক্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা যায়। এ বারের কেন্দ্রীয় সরকারি বাজেটে ঘোষণা করা হয়েছে যে, ‘বিকশিত ভারত’-এর লক্ষ্য অর্জনের জন্য পারমাণবিক শক্তির ব্যবহারে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হবে।

ভবিষ্যতে কী হবে, সে কথা ভবিষ্যৎই বলবে— কিন্তু প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের খনিজ তেল-নীতি যে গোটা দুনিয়ায় অর্থব্যবস্থার গায়ে ধাক্কা দেবেই, তা প্রায় অনিবার্য। কোন দেশ কী ভাবে সেই ধাক্কা সামলায়, সেটাই দেখার।

দি এনার্জি অ্যান্ড রিসোর্সেস ইনস্টিটিউট, নয়াদিল্লি

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Donald Trump Fossil Fuel

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}