কলকাতা থেকে পূর্ব বর্ধমানের আউশগ্রামের উত্তর রামনগর গ্রামের বারাসতীডাঙার দূরত্ব প্রায় ১২০ কিলোমিটার। সেই রাস্তা ধরে প্রান্তিক এই অঞ্চলে বইমেলার পৌঁছতে সময় লাগল প্রায় চার যুগ!
১৯৭৬ সালে পথচলা শুরু কলকাতা বইমেলার। ১৯৮৪ সালে তা লাভ করেছিল আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। এই সময়ের পর থেকে বীরভূমে যে বইমেলা হয়নি তা নয়। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে বইমেলা হয়েছে। বর্তমানে তো প্রতি বছরই হয়। তবে তা যেন থমকে ছিল শহরাঞ্চলেই। প্রত্যন্ত অঞ্চলে বইয়ের মেলার আয়োজন হল এত দিন পরে। এই আয়োজনে প্রকৃতি ও মানুষের মেলবন্ধনের যোগসূত্র বই। অজয়নদের ধারে ঘন জঙ্গলের মাঝে বইমেলা। এই অঞ্চলে কোনও মেলাই যে হত না, এমনটা নয়। চড়ক, ধর্মরাজ, মাজারের মেলা হত। তবে এখানে যে বইমেলার আয়োজন হতে পারে তা যেন এক প্রকার অসম্ভব ছিল। আর সেই ‘অসাধ্য’ সাধন করে দেখিয়েছেন রাধামাধব মণ্ডল, শেখ আব্দুল লালনের মতো কয়েক জন বইপাগল মানুষ।
সকাল হলেই এখানের বাসিন্দারা যে যার মতো রুজিরোজগারের জন্য বেরিয়ে পড়েন। কেউ জঙ্গলে পাতা কুড়োতে যান, কেউ বা শ্রমিকের কাজ করেন। এমন জায়গাতেই আয়োজন বইমেলার। মালিয়ারি, মল্লিকপুর, গোপালপুরের আদিম নিবাসীদের মহল্লার মাঝেই বারাসতীডাঙায় ভাষা দিবসের আগে ২০ ফেব্রুয়ারি আউশগ্রামে এই মেলা শুরু হয়েছিল। প্রান্তিক এলাকা হলেও ঐতিহাসিক দিক থেকে এই জায়গার গুরুত্ব অনেকটাই। এখানে রয়েছে পাণ্ডু রাজাদের ঢিবি। তার পাশেই বইমেলার আয়োজন। প্রথম বছরের এই আয়োজনে অতিথি ছিলেন সাহিত্যিক মনোরঞ্জন ব্য়াপারী প্রমুখ।
আরও পড়ুন:
আয়োজকরা জানাচ্ছেন, ক্ষুদ্র চারাগাছ এক দিন মহীরুহে পরিণত হবে। এই নিয়ে তাঁরা যথেষ্ট আশাবাদী। একেবারে নব্য মেলায় বইয়ের স্টলের সংখ্যা অবশ্য নিতান্ত কম নয়। ৪২টি বইয়ের স্টল নিয়ে পথ চলা শুরু হয়েছে। প্রতি দিন মেলায় ভিড়ও হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি খুশি স্কুল পড়ুয়ারা। হাজারও বইয়ের মাঝখান থেকে তাঁরা নিজেদের পছন্দের বই খুঁজছে।
বারাসতীডাঙার পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে কোনও ব্যাঙ্ক নেই। নেই কোনও স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা দমকলকেন্দ্র। আছে শুধু ঘন জঙ্গল। হায়না, শিয়াল থেকে শুরু করে সাপের ভয় যেমন আছে তেমনই আছে ময়ূর আর অনেক পাখির কুজন। তার মাঝেই এই আয়োজন।
আয়োজক রাধামাধব আক্ষেপ করে বলেন, ‘‘প্রশাসনের সব রকম সাহায্য পেলেও যে বনের মাঝে বইমেলা সেই বন দফতরেরই কোনও সাহায্য পাওয়া যায়নি।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘কাছেই পাণ্ডু রাজার ঢিবি। বেশ কয়েকবার কেন্দ্রীয় প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগের কাছে পরিদর্শনের আবেদন করলেও কর্তৃপক্ষ এগিয়ে আসেননি।’’ লালন বলেন, ‘‘রুক্ষ মাটিতে বইয়ের চাষ হচ্ছে। জঙ্গলের বাসিন্দারা সকলে এগিয়ে এসেছেন বলেই এই আযোজন সম্ভব হয়েছে। পুলিশ প্রশাসনের সাহায্য না পেলে এই পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করা সম্ভব ছিল না।’’ বই বিক্রেতারা জানাচ্ছেন, ব্যাপক হারে বইয়ের বিক্রি না হলেও কিছু কিছু বই বিক্রি হচ্ছে। তাঁরাও আশাবাদী।