Advertisement
E-Paper

সংশোধন

গত অক্টোবরেই সুপ্রিম কোর্ট জেলে বন্দিদের শ্রমের ক্ষেত্রে জাতভিত্তিক বৈষম্যকে ‘অসাংবিধানিক’ ঘোষণা করেছিল।

—প্রতীকী চিত্র।

—প্রতীকী চিত্র।

শেষ আপডেট: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ০৭:১৭
Share
Save

আধুনিক চেতনায় কারাগার পরিবর্তিত হয়েছে সংশোধনাগারে। কারণ, সেখানে অপরাধী শুধুমাত্র শাস্তি ভোগই করেন না, হরেক কাজের মধ্য দিয়ে তাঁর আচরণ পরিবর্তনেরও প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হয়। কিন্তু সংশোধনাগার স্বয়ং যদি কুঅভ্যাসের বশবর্তী হয়ে থাকে, তার চৌহদ্দির মধ্যে প্রচলিত অন্যায্য নিয়মগুলিকে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পরিবর্তনের চেষ্টা না করে, তবে সেই স্থানে অন্যরা সংশোধিত হবেন কী উপায়ে? পশ্চিমবঙ্গের কারা-বিধিতে যেমন এত দিন যাবৎ বেশ কিছু প্রথার উল্লেখ ছিল, যা প্রাচীন আমলের বর্ণাশ্রম প্রথার কথা মনে পড়িয়ে দেয়। যেমন রুল ৭৪১ অনুযায়ী, আধিকারিকের তত্ত্বাবধানে ‘যোগ্য’ বর্ণের বন্দিকে দিয়ে খাবার রান্না ও পরিবেশন করাতে হবে। রুল ৭৯৩ অনুযায়ী, জেলে ক্ষৌরকারের কাজ করবেন ‘উচ্চ’ বর্ণভুক্ত বন্দি, পিছিয়ে পড়া বর্গের বন্দিরা করবেন সাফাইয়ের কাজ। সম্প্রতি এ-হেন অমানবিক এবং বৈষম্যমূলক বিধিগুলিকেই সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে রাজ্যের সমস্ত সংশোধনাগারে বাতিল করার কথা ঘোষণা করেছেন পশ্চিমবঙ্গের কারা দফতরের সচিব রাজেশ কুমার। পরিবর্তে কারা-বিধিতে যুক্ত হয়েছে রুল ১১১৭, যেখানে বলা হয়েছে— রান্নার কাজে বর্ণের ভিত্তিতে বৈষম্য যেন না হয়, তা নিশ্চিত করবেন সংশোধনাগারের সুপার।

এই পরিবর্তন অবশ্য আকস্মিক নয়, এবং এই বৈষম্য শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গের কারাগারগুলির নিজস্বও নয়। গত অক্টোবরেই সুপ্রিম কোর্ট জেলে বন্দিদের শ্রমের ক্ষেত্রে জাতভিত্তিক বৈষম্যকে ‘অসাংবিধানিক’ ঘোষণা করেছিল। ভারতের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড়ের নেতৃত্বে গঠিত এক বেঞ্চ রাজ্য কারা-বিধির রীতিগুলি বাতিলের পক্ষে সায় দিয়েছিলেন এই যুক্তিতে যে, সেগুলি মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী। উচ্চ বর্ণের বন্দিকে রান্নার দায়িত্ব দেওয়া বা বর্জ্য পরিষ্কার, ঝাড়ু দেওয়া, সাফাইয়ের কাজে পিছিয়ে পড়া বর্গের বন্দিদের নিযুক্ত করা সরাসরি বর্ণভিত্তিক বৈষম্যকে প্রশ্রয় দেয়, যখন সংবিধানে রাষ্ট্রকে এ-হেন বৈষম্য না করার নির্দেশ দেওয়া আছে। শুধু এইটুকুই নয়, আদালতের পর্যবেক্ষণে এ-ও উঠে এসেছে যে, সংশোধনাগারগুলির জাতভিত্তিক কাঠামোয় ‘স্বভাবগত ভাবে অপরাধী’-র ধারণাটি এখনও অস্পষ্ট ভাবে হলেও থেকে গিয়েছে, যে ধারণা কার্যত সমগ্র সম্প্রদায়টির অপরাধপ্রবণ মানসিকতার দিকে আঙুল তোলে।

এই অন্যায্যতাকে শুধুমাত্র কারাগারগুলির সমস্যা বলে ভাবলে তা অসত্য হবে। তুচ্ছতম অজুহাতে নিম্ন বর্ণের মানুষদের উপর নিয়মিত অত্যাচার, মারধর, এমনকি মৃত্যুর ঘটনাও এ দেশের বাস্তবচিত্র। এ দেশেই ভিন জাতে বিবাহের অপরাধে যুগলকে প্রকাশ্যে হত্যা করা হয়, গণধর্ষণের পর দলিত কিশোরীর মৃত্যু হলে পুলিশের উপস্থিতিতে দেহ রাতারাতি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। পুলিশ-প্রশাসন দেখেও নীরব থাকে, নয়তো সেই অন্যায়কেই পরোক্ষে সমর্থন জোগায়। আদালত যা-ই নির্দেশ দিক, ভারতের অন্তরে-অন্দরে জাতভিত্তিক বৈষম্য এখনও বহু দূর তার শিকড় বিস্তার করে রেখেছে। কারাগারের ক্ষুদ্র পরিসরে বৃহত্তর ভারতের সেই খণ্ডচিত্রটিই প্রতিফলিত। অন্যায্য কারাবিধিগুলিকে মুছে পশ্চিমবঙ্গ দীর্ঘ দিনের জঞ্জালমুক্তির পথে প্রথম পদক্ষেপটি করল। এখনও বহু পথ পেরোনো বাকি।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Rajesh Kumar Supreme Court of India

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}