ফাইল চিত্র।
নরেন্দ্র মোদীর প্রধানমন্ত্রিত্বের দ্বিতীয় দফার মধ্যবিন্দু স্পর্শ করতে আর মাত্র এক পক্ষকাল বাকি আছে। ২০১৯-এর ৩০ মে মোদী দ্বিতীয় বারের জন্য প্রধানমন্ত্রিত্বের শপথ নিয়েছিলেন। এবং ১০ বছরের যাত্রার তিন-চতুর্থাংশের মধ্যে তিনি ভারতকে বদলাতে চেয়েছিলেন।
কিন্তু কী ভাবে কেউ তাঁর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মূল্যায়ন করবেন? যেহেতু ২০২০-র মার্চ মাস থেকে কোভিড অতিমারি তার ডানা মেলতে শুরু করে, সে কারণে মোদীর প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রথম ছ’বছরকে একটি পর্যায় হিসেবে দেখা যেতে পারে। তার পরবর্তী সময়কালকে ভিন্ন পর্যায় হিসেবে গণ্য করা যায়। এমন হিসেবের মধ্যে গেলে একটি গোলমেলে সমাপতন নজরে আসে— মোদীর প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রথম ছ’বছরের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) বৃদ্ধির হার মনমোহন সিংহ সরকারের শেষ ছ’বছরের (২০০৮-২০১৪) হারের পরিসংখ্যানের প্রায় সমান। মোদীর ক্ষেত্রে এই পরিসংখ্যান ৪৮.৬ শতাংশ। মনমোহনের আমলে তা ছিল ৪৮.৪ শতাংশ।
সুতরাং, মোদী জমানার ২০১৯-’২০ পর্যন্ত অর্থনৈতিক হিসেবকে কোনও ভাবেই মনমোহনের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী ‘বিপর্যয়’ বলা যায় না। আবার নীতি-আয়োগ বা অন্যান্যরা যেমন একে দুই অঙ্কের বৃদ্ধির দিকে এক দৃঢ়নিশ্চিত যাত্রা বলে মহানন্দে বর্ণনা করেছিল, তেমনও ঘটেনি। যা ঘটেছে, তা হল বৃদ্ধির গতিছন্দে এক ক্রমাবনমন। প্রধানমন্ত্রীর ভক্তকুল সঠিক ভাবেই যুক্তি দেখিয়েছিল যে, যদি উত্তরাধিকার সূত্রে গোলমেলে ঋণের বোঝা মোদীর উপরে না বর্তাত, তবে বৃদ্ধির এমন হাল হত না। অন্য দিকে, কার্যভার গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে খনিজ তেলের দামে এক বিরাট পতন মোদীর সহায়ক হয়েছিল। এর ফলে মোদী জমানার প্রথম দু’বছরে জিডিপি-র বৃদ্ধি যথষ্ট ইতিবাচক ছিল এবং তা মূল্যবৃদ্ধিকে খানিক রুখতে সহায়ক হয়েছিল। সেই সঙ্গে বাণিজ্য-সমতারও স্বাস্থ্যোদ্ধার ঘটিয়েছিল।
মোদীর সমালোচকরা নোটবন্দি এবং ত্রুটিযুক্ত পণ্য ও পরিষেবা করের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে দেখান যে, এই দু’টি বিষয় করের আওতার বাইরে থাকা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রগুলির (ইনফর্মাল সেক্টর) এবং কর্মনিযুক্তির বিপুল ক্ষতি করেছে। যদি কেউ এ সবের ফলে সৃষ্ট বিপর্যয় ও বেকারত্বের মানবিক মূল্যকে সরিয়েও রাখেন আর অর্থনীতির বিশুদ্ধ বৃদ্ধিকে লক্ষ করেন, তবে দেখা যাবে, এর আগেও ভারত এ ধরনের বিপাকে পড়েছে। এ সব চাপা দিতেই সরকারি পরিসংখ্যানের বিকিকিনি চলে। যাঁরা ‘পরিসংখ্যান ক্রয়ে’ অংশ নেন না, তাঁরা রফতানি বাণিজ্যে স্থবিরতার দিকে ইঙ্গিত করেন এবং ঋণবৃদ্ধি, কর্পোরেট ক্ষেত্রের লাভের অঙ্ক এবং বিনিয়োগের মতো নড়বড়ে সূচকগুলিকে ২০১১ সাল থেকে দেখাতে থাকেন।
দু’টি ক্ষেত্রে মোদীর নিজস্ব উদ্যোগ লক্ষ্য করা গিয়েছে। প্রথমত, সরকারি কার্যক্রমকে অধিকতর স্বচ্ছন্দ এবং অভিমুখ-উপযোগী করে তুলতে প্রযুক্তির ব্যবহার। এবং দ্বিতীয়ত, চালু থাকা জনকল্যাণমুখী প্রকল্পগুলির বিস্তার সাধন। কোনও কোনও ক্ষেত্রে তা উল্লেখযোগ্য রকমের। এ সবের ‘ফল’ পরিসংখ্যানের দিক থেকে বেশ উৎসাহব্যঞ্জক। তার মধ্যে রয়েছে নতুন গৃহনির্মাণ, শৌচাগার তৈরি, নতুন ব্যাঙ্কের শাখা প্রতিষ্ঠা, রান্নার গ্যাসের সংযোগ বৃদ্ধি, পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি উৎপাদনের দ্রুত প্রসার, স্বাস্থ্যবিমা এবং পানীয় জল সংক্রান্ত সমস্যার মোকাবিলা ইত্যাদি।
কিন্তু, ‘ফল’-এর পরিসংখ্যান দিয়ে কিছুই বোঝা যায় না। তাদের বাস্তব তরঙ্গকে অনুভবের বৃত্তে নিয়ে আসতে হয়। বাস্তবে কিন্তু স্বাস্থ্য অথবা শিক্ষা ক্ষেত্রে তেমন উন্নতি পরিলক্ষিত হয়নি। দরিদ্রের সংখ্যা কমেনি। বায়ুদূষণও তেমন উল্লেখযোগ্য মাত্রায় হ্রাস পায়নি। বরং দেখা গিয়েছে, দরিদ্রের সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটেছে। সে ক্ষেত্রে ভোক্তাজগতে স্থবিরতা অথবা পতন এবং বেকারত্ব বৃদ্ধির মতো বিষয়গুলিকেও মাথায় রাখতে হবে। সুতরাং এর মধ্যে এক নতুন বৈপরীত্য দেখা যায়— লক্ষ লক্ষ মানুষ এমন জীবন যাপনের সুযোগ পেয়েছেন, যা তাঁদের কাছে অভূতপূর্ব। কিন্তু একই সঙ্গে তাঁরা প্রতিশ্রুত এক ‘অচ্ছে দিন’-এর অপেক্ষায় থেকে যাচ্ছেন। মোদ্দা কথায়, তাঁরা তাঁদের হাতে আরও বেশি কাজ এবং তার বিনিময়ে আরও বেশি পারিশ্রমিক আশা করে চলেছেন।
এর পরেই আসে অতিমারি-পর্ব। এক ওলটপালটের সময়। কিন্তু একই সঙ্গে তা ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়ার সময়ও বটে। জাতীয় স্তরে প্রথম লকডাউন ছিল এক মারাত্মক ভুল সিদ্ধান্ত (পরিযায়ী শ্রমিকদের কথা মনে রাখতে হবে), সেই শিক্ষা থেকেই দ্বিতীয় পর্যায় অন্য ভাবে সামলানো গিয়েছে। টিকাকরণ কর্মসূচি দেরিতে এবং ধীরগতিতে শুরু হয়েছে। কিন্তু পরে তার গতিবেগ বাড়ে। তার পর আবার তাতে শ্লথতা দেখা দেয়।
কোভিডের দ্বিতীয় তরঙ্গের জন্য দেশ প্রস্তুত ছিল না। তত দিনে অতিমারি বিজয়ের ডঙ্কাও বেজে গিয়েছে। কিন্তু সরকারের তরফে সেই দুরবস্থা কাটিয়ে উঠতে বিস্তর বেগ পেতে হয়েছে। অতিমারিতে প্রয়াত মানুষের পরিসংখ্যান সরকারি ভাবে কম-বেশি পাঁচ লক্ষ। কিন্তু বেসরকারি খতিয়ান থেকে জানা যায়, সেই সংখ্যা বহু গুণ বেশি। ২০২০-’২১ অর্থবর্ষে অর্থনীতি তীব্র ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু পাশাপাশি দ্রুত পুনরুজ্জীবনও তার মধ্যে দেখা গিয়েছে। বিশ্বের কোনও দেশ এই পরিস্থিতির মোকাবিলা খানিক ভাল ভাবে করতে পেরেছে, বাকিরা তা পারেনি।
ইতিমধ্যে মোদীর শাসনের ব্যাকরণ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তা হল, বিপুল বহ্বারম্ভ সহকারে প্রতিশ্রুতি জ্ঞাপন, উচ্চাভিলাষী প্রকল্প ও লক্ষ্যে কর্মকর্তাদের দৌড় করানো, সাফল্যের উপরে জোর দিয়ে ব্যর্থতাগুলিকে লোকচক্ষুর অন্তরালে নিয়ে যাওয়া আর সেই কাজ করতে আবার নতুন নতুন লক্ষ্য উপস্থাপন করা এবং অন্তহীন ভাবে ভাবমূর্তির বিবর্ধন।
এর পরেও যদি কার্য ও ফলের মধ্যে বিরাট ফারাক থেকে যায়, তবে তার পিছনে রয়েছে বিশেষ কিছু প্রকল্পের ক্ষেত্রে এই সরকারের অধিক গুরুত্ব প্রদান, কোনও কোনও ক্ষেত্রে জোড়াতালি দেওয়া সংস্কারের কাজ। এবং এর সব থেকে বড় দুর্বলতা হল, অর্থনীতির দ্রুত বৃদ্ধির বিষয়ে বৃহত্তর লক্ষ্য স্থির করায় খামতি। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কর্মনিযুক্তির সুযোগ বাড়ানো এবং অবশ্যই দারিদ্র সংকোচন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy