আরব সাগরের ধারে, কোঙ্কণ উপকূলের মরাঠাদের কোনও রণতরী ছিল না। সবাই রাতের অন্ধকারে, গাছের ডালে উল্টো ভাবে জিমন্যাস্টিক্সের মতো ঝুলত, তার পর ওই ভাবে ঝুলতে ঝুলতে কয়েক কিলোমিটার জঙ্গুলে রাস্তা অক্লেশে পাড়ি দিত। মহাত্মা গান্ধী যতই হিন্দ স্বরাজ লিখুন, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন স্বরাজ্য পার্টি তৈরি করুন, ‘স্বরাজ’ শব্দটার কপিরাইট আসলে খোদ ছত্রপতি শিবাজির। স্বরাজ মানে কী, সেটা সাম্প্রতিক ছাওয়া ছবিতে শিবাজির সুযোগ্য পুত্র, বীর সম্ভাজি (অভিনয়ে ভিকি কৌশল, সঙ্গের ছবিতে) লম্বা লেকচারে বুঝিয়ে দিয়েছেন। চাষিদের গোলাভরা ফসল থাকবে, জাতপাতের হানাহানি থাকবে না, সব আপাত-শান্তিকল্যাণ হয়ে যাবে। গান্ধীর স্বরাজের সঙ্গে শিবাজির ‘শিব স্বরাজ’কে প্রায় গুলিয়ে ঘেঁটে ঘ করে দেওয়া হল। তবু দক্ষিণ কলকাতার এক মাল্টিপ্লেক্সে সেই দৃশ্যে প্রবল হাততালি। মরাঠা অস্মিতাকে সম্মান না জানিয়ে থাকা যায় নাকি!
এই অস্মিতা অবশ্য মাঝে মাঝেই উঠে আসে সিনেমার পর্দায়। তনহাজি ছবিতে ছত্রপতি শিবাজির মা জিজাবাই রোদ্দুরে খালি পায়ে হেঁটে প্রাসাদের শিবমন্দিরে যান। মোগল সৈন্যরা কারণ জিজ্ঞাসা করলে মুখতোড় জবাব, যত দিন না রায়গড় উদ্ধার হচ্ছে, তিনি পায়ে জুতো পরবেন না। তার পাশে রাজপুত চন্দ্রভান? মোগলদের সেনাপতি, ফলে অত্যাচারী ও অসভ্য। আস্ত কুমির রোস্ট করে খায়। শেষে, শিবাজির অন্যতম সেনাপতি মরাঠা বীর তনহাজি মালুশ্রী তাকে কামানের পিঠে বেঁধে, কামান-সহ খাদে ফেলে দেবেন। মরাঠা মানে বীর হিন্দু। আর রাজপুত মানে মুসলমান সম্রাটের সহযোগী খারাপ হিন্দু।
ভাল-খারাপ অবশ্য বদলে গিয়েছে আগেই। সঙ্গমেশ্বরের প্রাসাদ মোগল সেনারা ঘিরে ফেলেছে, তার পর সম্ভাজি ও তাঁর সঙ্গী, বয়স্য কবি কলসের সঙ্গে মোগলদের ব্যাপক লড়াই। কখন হল? যদুনাথ সরকার তাঁর বইয়ে সম্ভাজিকে বীর বলতে নারাজ। উল্টে হিংস্র, অব্যবস্থিতচিত্ত, ন্যায়নীতির বালাইহীন অপদার্থ ইত্যাদি হরেক বিশেষণে বিশেষিত করেছেন। পরিষ্কার জানিয়েছেন, সঙ্গমেশ্বরের ওই যুদ্ধের সময় সম্ভাজি ও কলস কবি প্রাসাদে পানভোজনের আনন্দে মত্ত ছিলেন। আর এক মরাঠাকুলপ্রদীপ বিনায়ক দামোদর সাভারকরও তাঁর বইয়ে সম্ভাজিকে বদরাগী, মদ্যপ, নারীলোলুপ, দুশ্চরিত্র এবং সিংহাসনের অনুপযুক্ত বলেছেন। বদরাগীরাই উত্তর-সত্য জমানায় বীরত্বব্যঞ্জক অভিধায় ভূষিত হন কি না, সেই বিপজ্জনক প্রশ্নে আমরা ঢুকব না।
ছাওয়া ছবির শেষে প্রকাশ্য মৃত্যুমঞ্চে ঝুলতে ঝুলতে, চাবুকের ঘায়ে আহত সম্ভাজি ও কবি কলস মুখে মুখে পরস্পরকে চটজলদি শায়েরি শোনাচ্ছেন। ইতিহাস অন্য রকম। ১৬৮৯ সালের পয়লা ফেব্রুয়ারি মাত্র ৩০০ মোগল সেনা সঙ্গমেশ্বরের প্রাসাদ ঘিরে ফেলে, কবি কলস হাতে তিরবিদ্ধ হন। সম্ভাজি ও তাঁর পঁচিশ জন মন্ত্রী স্ত্রী-পরিজন’সহ প্রাসাদের নীচে গুপ্তকক্ষে লুকিয়ে ছিলেন। তাঁদের চুল ধরে টেনেহিঁচড়ে বার করে মোগল সেনা। ভয়ের চোটে লুক্কায়িত এই অপদার্থকেও আজ বীর এবং ‘ছাওয়া’ বা সিংহশিশু ভাবতে হবে?
যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পিঠটান দেওয়া অবশ্য শুধু সঙ্গমেশ্বর নয়, ‘বাপের আমল’ থেকেই সম্ভাজির অভ্যাস। বাবাকে ‘টাইট’ দিতে শত্রুপক্ষে যোগদান? সে-ও আছে। একুশ বছর বয়সেই এক সধবা ব্রাহ্মণীকে ধর্ষণের অপরাধে পানহালা দুর্গে উচ্ছৃঙ্খল ছেলেকে বন্দি রেখেছিলেন শিবাজি। সম্ভাজি স্ত্রী বেসুবাইকে নিয়ে সেখান থেকে পালিয়ে ১৬৭৮ সালের ১৩ ডিসেম্বর মোগল সেনাপতি দিলির খাঁর শিবিরে যোগ দিলেন। ঔরঙ্গজেবও দিল্লি থেকে তাঁকে ‘রাজা’ উপাধি, সাতহাজারি মনসবদার দিয়ে সম্মানিত করলেন। সম্ভাজিকে নিয়েই দিলির খাঁ শিবাজির ভূপালগড় দুর্গ ফের মোগল অধিকারে নিয়ে আসেন।
মোগল সেনার হাতে ধৃত এ-হেন সম্ভাজি ও কবি কলস ১৫ ফেব্রুয়ারি বাহাদুরগড় পৌঁছলে, সম্রাটের আদেশে দুই বন্দির গলায় ঘণ্টা বেঁধে, মাথায় গাধার টুপি পরিয়ে, উটের পিঠে চাপিয়ে শহর ঘুরিয়ে দরবারে নিয়ে আসা হয়। ঔরঙ্গজেব সিংহাসন থেকে নেমে, উবু হয়ে বসে খোদাতালার কাছে কদমবুসি করেন। এই সম্ভাজি ও তাঁর প্রয়াত বাবা কম জ্বালিয়েছে দিল্লির অধীশ্বরকে? এক বার পিতা-পুত্র দু’জনকেই দিল্লিতেই অন্তরিন রাখা হল, প্রহরীদের বোকা বানিয়ে ফলের ঝুড়িতে লুকিয়ে, ছাইভস্ম মাখা সন্ন্যাসীর বেশে দু’জনে এমন ভাবে পগার পার হলেন যে, বাদশাহ আলমগীর তাঁদের টিকিও ছুঁতে পারলেন না। সেই বহু-আকাঙ্ক্ষিত মরাঠা ছোকরা এখন তাঁর সামনে!
সভাসদরা জাহাঁপনাকে বলল, সম্ভাজিকে অন্তত ছেড়ে দেওয়া হোক! সম্রাট আধা রাজি। রুহনুল্লা খানকে বন্দি সম্ভাজির কাছে পাঠালেন তিনি, কোথায় আছে শিবাজির ধনসম্পদ? আর হ্যাঁ, মরাঠারা বিজাপুর, সুরাত ও মোগল এলাকায় যে সব দুর্গ দখল করেছে, ফেরত দিতে হবে। কিন্তু সম্ভাজি প্রস্তাবে পাত্তা দিলেন না, উল্টে পয়গম্বর মহম্মদের নামেও গালি দিলেন। সাধু রামদাসের শিষ্য শিবাজির অধীনে অবশ্য অনেক মুসলমান চাকরি করতেন, সুফি দরগায় অর্থসাহায্য করতেন, যুদ্ধক্ষেত্রে কোরান পেলেও সেটি ভক্তিভরে উঠিয়ে রেখে পরে কোনও মুসলমানকে দান করে দিতেন। এখানেই বীর পিতার সঙ্গে বদরাগী পুত্রের তফা়ত।
ছাওয়া সিনেমাটা অবশ্য ইতিহাস নয়, মরাঠা লেখক শিবাজি সাওন্তের ওই নামের উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি। জনপ্রিয়তার কারণে ইংরেজি অনুবাদও বেরিয়ে গিয়েছে, কিন্তু এহ বাহ্য! সিনেমার আগে সেটি মরাঠি ভাষায় সুপারহিট নাটক হয়, জয়সিংহরাও পাওয়ার থেকে মেধা দেশমুখ ভাস্করন, মায় অকাদেমি পুরস্কারে সম্মানিত মরাঠা লেখক বিশ্বাস পাটিলও সম্ভাজিকে নিয়ে হাল আমলে ইতিহাসনির্ভর উপন্যাস লিখেছেন। মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফডণবীশও এক অনুষ্ঠানে জানিয়েছেন, সম্ভাজিকে নিয়ে গত শতকে ইতিহাসবিদদের মূল্যায়নে কিঞ্চিৎ ভুল ছিল। কেন এই সহসা পুনরুত্থান? ইতিহাসের যাবতীয় ‘সত্য’কে দূরে সরিয়ে কেন ছত্রপতি শিবাজির পুত্রও হয়ে উঠলেন আজকের নায়ক? পিতার সঙ্গে তাঁর এত বিপুল পার্থক্য সত্ত্বেও?
ইতিহাসবিদ গৌতম ভদ্র প্রথমেই যদুনাথ সরকারের বিপরীত মেরুতে, “দুশ্চরিত্র এবং লাম্পট্য কোনও ব্যাপার নয়। মধ্যযুগে বেশির ভাগ শাসকই তা-ই। সম্ভাজির বাবা ছত্রপতি শিবাজির তো আট জন স্ত্রী।”
আসলে, সম্ভাজির জীবনে চমৎকার গল্প আছে। মরাঠি লেখিকা মেধা দেশমুখ ভাস্করনের লাইফ অ্যান্ড ডেথ অব সম্ভাজি শুরুই হয় মথুরায় নয় বছরের বালক সম্ভাজিকে দিয়ে। আগরা থেকে পালিয়ে বাবা দাক্ষিণাত্যে ফেরার আগে তাঁকে এই বাড়িতে রেখে গিয়েছেন। বাবা কি এক বারও বুঝলেন না, সে একলা কত বিপদে পড়তে পারে! দাক্ষিণাত্যে ফিরে, যৌবরাজ্যে অভিষেকের দিনও সম্ভাজি তাই ভিতরে ভিতরে গুমরে ওঠেন। বাবার কাছে তিনি নন, স্বরাজই প্রিয়!
শেষে ঘোড়া ছুটিয়ে আসছেন তিনি। শুনেছেন, তাঁর বন্ধু কবি কলসের হাতে মোগল সেনার তির লেগেছে। সকলে বারণ করছে, কিন্তু তিনি নারাজ। ছেলেবেলায় একলা মথুরা থেকে দাক্ষিণাত্যে ফিরেছেন, কিশোর বয়সে তাঁর বাবা, থুড়ি শিবরাজা তাঁকে মোগল শিবিরে পাঠিয়েছেন। সারা জীবন বিপদের সঙ্গে এ ভাবে পাঞ্জা লড়তে লড়তে আজ বন্ধুর বিপদে পিছিয়ে যাবেন তিনি? কলসকে খুঁজতেই ভূগর্ভের চোরা কুঠরিতে তিনি।
সম্ভাজি এই রকমই। অভিমানী, কবিতাপ্রেমী ও ঝুঁকি নেওয়া বীর। মৃত্যুমঞ্চের সামনে খোদার কাছে কৃতজ্ঞ ঔরঙ্গজেব যখন কদমবুসি করেন, সম্ভাজির উদ্দেশে কবি বলে ওঠেন, “রাজন, আপনিই তো সেই রক্তিম দেবতা/ আপনাকে দেখেই বাদশা/ হাঁটু গেড়ে আশ্রয় করেছেন ধরা/ গ্রহণ করুন ওঁর অন্তরশ্রদ্ধা।” তার পরই রাগে জ্বলতে জ্বলতে ঔরঙ্গজেব দু’জনের জিভ ছিঁড়ে চোখ খুবলে নেওয়ার হুকুম দেন। জীবন্ত দু’জনের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ছিঁড়ে নেওয়া হয়। “ইতিহাস অনেক ভুল ব্যাখ্যা করেছে, কিন্তু প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে সম্ভাজি মরাঠা যোদ্ধাদের প্রেরণা,” বলছেন লেখিকা। আরও বলছেন, হাল আমলে ভি সি রানাডে, সদাশিব শিবাড়ে প্রমুখ মরাঠা ইতিহাসবিদ পুরনো দলিল-দস্তাবেজ ঘেঁটে যে সব তথ্য বার করেছেন, সেই সবই তাঁর বইয়ের সূত্র। ইতিহাস চলতেই থাকে, যদুনাথের সঙ্গে সঙ্গে তার সমাপ্তি সূচিত হয় না।
ফের ধরা গেল বাঙালি ইতিহাসবিদকে। তা হলে শিবাজির পরের ইতিহাস পেশোয়াদের গুরুত্ব দিল, সম্ভাজি অন্ধকারে থেকে গেলেন কেন? গৌতমবাবু হাসলেন, “সম্ভাজি আসলে মাথা গরম, অনেকটা আজকের নকশালদের মতো। শিব স্বরাজের ঐতিহ্যে বাবার মতোই বিশ্বাসী, কিন্তু কখন যে কোথায় আক্রমণে শাণ দেবেন, কেউ জানে না। আর পেশোয়ারা তখন মরাঠা সাম্রাজ্যে শাসক এবং প্রবল প্রতিপত্তিশালী প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠান নিজের ক্ষমতা বজায় রাখতেই নকশালদের পাত্তা দেয় না, কখন কোন গাড়ির নীচে চলে আসবে কে জানে!”
আজ নাহয়, আগামী কালের সাহিত্য, সিনেমা-সংস্কৃতিতে সম্ভাজির নবজন্ম লাভের কথাই ছিল।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)