রেশনের চালের ভাত কেমন করে রাঁধতে হয়? লকডাউনের আগে ভাত রাঁধতে হলে মেয়েরা উনুনে চাপিয়ে দিত চাল আর জল, সেদ্ধ হলে ফ্যান ঝরিয়ে নিত। আর এখন? এখন টালা থেকে যাদবপুর, দরমা-টিন-কালো প্লাস্টিকের ঘরে চাল ফুটে ওঠামাত্র হাঁড়ি নামিয়ে রেখে দেয় মেয়েরা, মুখটা চাপা দিয়ে। একটা যা হোক তরকারি রান্না করে, শেষে আর এক বার ভাতটা চাপিয়ে, ফুটলেই হাঁড়ি উপুড়। গ্যাসের দাম হাজার টাকা, এখন কি একটানা ভাত ফোটানো চলে?
তাও পুজোর মাসটা গ্যাস নেননি নোনাডাঙার সাগরিকা সানা। রাঁধছেন কি তবে কেরোসিনে? শুনে চোখ কপালে তুললেন সাগরিকা। “বাজারে কেরোসিন নব্বই টাকা লিটার, রেশনে পঞ্চাশ টাকা।” টালা ব্রিজের পাশে চাকাপট্টির ছায়া পাইক ঘুরেফিরে বলছিলেন সে সব দিনের কথা, যখন কেবল কেরোসিনে রান্না করেছেন। তাঁর নিজের রেশন কার্ডে ঠিকানা লেখা মিনাখাঁ, কলকাতায় চল্লিশ বছর বসবাসের পরেও। বস্তির অনেক বাসিন্দারই তাই। তবে সরকারি গণবণ্টনের বাইরে মেয়েদের নিজস্ব একটা ব্যবস্থা ছিল। মধ্যবিত্তের রেশন কার্ডে গরিব মেয়ে কেরোসিন নিত। “এক সময় বাড়তি কেরোসিন বিক্রিও করেছি,” বললেন ছায়া। আর এখন? “লম্ফ জ্বালার কেরোসিন পাই না, উনুন জ্বালব কী?” ২০১৬ অবধি কলকাতার বরাদ্দ ছিল মাসে মাথাপিছু এক লিটার, এখন তা আধ লিটার, কারও বা দেড়শো মিলিলিটার।
অগত্যা ভরসা কাঠ। বহু বছর পর নিজের হাতে লোহার বালতিতে তোলা উনুন তৈরি করেছেন নোনাডাঙার মনসা মণ্ডল। ধোঁয়ায় সারা ঘর কালি, চোখে জল, বাচ্চাদের কাশি। সমীক্ষা বলছে, কয়লা-কাঠের উনুনের দূষণ বছরে অন্তত আট লক্ষ অকালমৃত্যুর কারণ। তা ছাড়া আছে আগুন লাগার ভয়। চাকাপট্টির লক্ষ্মী দাসের বাড়ি তৈরি কেবল টিন, কাঠ আর প্লাস্টিক চাদরে। কাঠের হুহু আগুন হাওয়ায় এ দিক, ও দিক যেতে চায়। ঘরে দুই শিশুকন্যা। তাই গ্যাসের পয়সা গুনছেন। কিন্তু বস্তির অধিকাংশের ঘরে ভরসা কাঠ। কারখানার ছাঁটের কাঠ বিক্রি হয় আট-দশ টাকা কিলো দরে। কোথাও বাড়ি ভাঙা হলে বাতিল কাঠ নিয়ে আসেন পুরুষরা, ভ্যান ভাড়া করে। পুজোশেষের প্যান্ডেল থেকে কাঠকুটো নিয়ে আসেন মেয়েরা। যাঁরা খালপাড়ে, পুকুরপাড়ে থাকেন, তাঁরা শুকনো ডাল কুড়োন, কখনও ডাল কেটেও আনেন। শুকিয়ে নিলে জ্বালানি হয়।
অনেকে চিরকাল কাঠেই রেঁধেছেন। নোনাডাঙার মীরা দাস, সবিতা মণ্ডল, কৌশল্যা মণ্ডলের মতো প্রবীণারা বললেন, বাবুদের গ্যাসে রান্না, নিজেদের কাঠে রান্না— গরিবের আবার গ্যাস কী? তবে তাঁদের মেয়ে-বৌরা, যারা চটজলদি রান্নার জ্বালানির জন্য কষ্টের টাকা সরিয়ে রাখত, তারাও ঘরের কোণে শূন্য সিলিন্ডার রেখে চলেছে কাঠ কুড়োতে।
এ কি কেবল অতিমারির মার? মেয়েরা ভাবছে, সময় খারাপ, খাবারের দাম বেড়েছে (‘সেদ্ধভাত, কপালে হাত’, ছড়া কাটলেন এক মহিলা), গ্যাস-কেরোসিনেরও দাম বেড়েছে। আবার সময় ফিরবে। কেরোসিন স্টোভ যত্ন করে মুছে তুলে রেখেছেন ছায়া, মনসা, বেস্পতিরা। কার বুকের পাটা আছে যে, তাঁদের সামনে দাঁড়িয়ে বলবে, ও স্টোভ আর কোনও দিন জ্বলবে না? নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় এলেন যে বছর, সেই ২০১৪-১৫ সালে সরকার ২৪ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েছিল কেরোসিনে। পরের বছরই ভর্তুকির পরিমাণ অর্ধেক হল। ২০২০-২১ সালে ভর্তুকি দাঁড়াল আড়াই হাজার কোটি টাকার মতো, ২০২১-২২ বাজেটে তা হল শূন্য। যখন গরিবের সঞ্চয় শেষ, মজুরি কমছে, খাওয়ার খরচে টান, তখনই কেরোসিনে ভর্তুকি উঠে গেল। মার্চ ২০২০, প্রথম লকডাউন ঘোষণার সময়ে যে কেরোসিন ছিল ২৫ টাকার আশেপাশে, ২০২১ সালের দীপাবলিতে তা হয়েছে ৫৩ টাকা লিটার— ১০০ শতাংশেরও বেশি বেড়েছে। সেখানে ভর্তুকিহীন রান্নার গ্যাসের দাম বেড়েছে পঞ্চাশ শতাংশের কাছাকাছি, পেট্রলেরও প্রায় তা-ই। তবু গ্যাস-পেট্রল নিয়ে যত শোরগোল হয়েছে সংসদে, কাগজে-চ্যানেলে, তার এক শতাংশও হয়নি কেরোসিন নিয়ে।
তৃণমূল সাংসদরা বারকতক কথাটা তুলেছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেরোসিনের বরাদ্দ (‘কোটা’) কমানোর প্রতিবাদ-চিঠি দিয়েছেন কেন্দ্রকে, বলেছিলেন সৌগত রায়। তবে এর উল্টো পিঠের ছবি— রাজ্য তার ‘কোটা’-র তেলটুকুও তুলছে না। ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল কেরোসিন ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশন’-এর প্রতিনিধি অশোক গুপ্তের বক্তব্য, “প্রতি মাসে রাজ্যের বরাদ্দের আড়াই হাজার থেকে তিন হাজার কিলোলিটার কেরোসিন থেকে যাচ্ছে তেল কোম্পানিগুলোর কাছে। ওই তেল ‘ল্যাপ্স’ হয়ে যাচ্ছে।” তাঁর অভিযোগ, গ্রাহকদের জন্য রেশন কার্ডে যত তেল বরাদ্দ করেছে রাজ্য সরকার, তা কেন্দ্রের মোট বরাদ্দের চাইতে কম।
কেন্দ্রের বক্তব্য, কেরোসিন না থাক, ‘উজ্জ্বলা’ তো আছে। ২০১৬ সালে যার সূচনা, সেই সুলভ এলপিজি প্রকল্প নাকি ভারতের ৯৪ শতাংশ ঘরে পৌঁছে গিয়েছে। আর চিন্তা কী?
চিন্তা এই যে, দেশ যত না এগোয়, সরকারি রিপোর্ট এগোয় তার চেয়ে বেশি। গ্রামে বিদ্যুতের খুঁটি পোঁতা হলেই সরকারি নথিতে লেখা হয়, গ্রামে সব বাড়িতে বিদ্যুৎ এসেছে। ক্যানাল তৈরি হলেই তার আশেপাশের সব গ্রাম হয়ে যায় ‘সেচসেবিত’। ক’জন জল পেল, ক’জন বিদ্যুৎ, কে দেখতে যায়। তেমনই, উজ্জ্বলার সিলিন্ডার পৌঁছলেই সে বাড়ি হয়ে যায় দূষণমুক্ত জ্বালানিতে উত্তরণের পরিসংখ্যান। যদিও সমীক্ষার পর সমীক্ষা দেখাচ্ছে, উজ্জ্বলার ১ কোটি ২০ লক্ষ গ্রাহক একটামাত্র সিলিন্ডার নিয়ে আর নেননি; উজ্জ্বলার গ্রাহকেরা গড়ে মাত্র তিনটি সিলিন্ডার নিচ্ছেন বছরে, যা সাধারণ গ্রাহকদের অর্ধেক। তবু ভাসছে উন্নয়নের রূপকথা— ভারতে আজ ঘরে ঘরে এলপিজি সিলিন্ডার।
এ হল ঘুঁটেকুড়ানি থেকে কাঠকুড়ানি হওয়ার উন্নয়ন। আশির দশকে কলকাতায় খাটাল নিষিদ্ধ হয়েছে, কয়লার ডিপো উঠে গিয়েছে। কয়লা-ঘুঁটের উনুন আজ স্মৃতি। এ বার কেরোসিনও ইতিহাস হল। এ সবই উন্নয়ন বলে ধরা যেত, যদি গ্যাস, সোলার কুকার, কিংবা বৈদ্যুতিন স্টোভের মতো স্বচ্ছ জ্বালানি গরিবের সাধ্যের মধ্যে আসত। তা আসার সম্ভাবনা কতটুকু? নীতি আয়োগ স্বচ্ছ রন্ধন-জ্বালানি জোগানোর এক ‘রোডম্যাপ’ প্রকাশ করেছে (২০১৯)। তার সুপারিশ, সিলিন্ডার কিনতে মেয়েদের ঋণ দেওয়া হোক। ভর্তুকি ছেঁটে ঋণে বরাদ্দ, মোদী সরকারের সাধারণ অবস্থানের সঙ্গে দিব্যি খাপ খেয়ে যায় এই প্রস্তাব। কেবল খটকা লাগে ওই মেয়েদের বাড়ি ঢুকলে। মনসা মণ্ডলের দু’মাসের বিদ্যুতের বিল (মাসে ৪৬০ টাকা) বাকি, মোবাইলে ব্যালান্স ভরতে পারেননি। এই মেয়েদের ঋণ নিতে বলা যেন ঠাকুরকে বাতাসা দেওয়া— ঠাকুরও বাতাসা খায় না, গরিবও ঋণ নেয় না।
নীতি আয়োগের দিক-নির্দেশিকা বলছে, কাঠ কুড়োতে অনেক সময় যায় (বস্তির মেয়েরা বললেন, ঘণ্টা দুয়েক)। তাই মেয়েদের সময় অকুলান হয় (‘টাইম পভার্টি’)। কাঠ জ্বালানো স্বাস্থ্যের পক্ষেও ক্ষতিকর। তাই মেয়েদের সচেতন করতে হবে, যাতে তারা উন্নত জ্বালানি ব্যবহার করে। শুনে চমক লাগে। তা হলে টাকার অভাব নয়, চেতনার অভাবের জন্যই গরিব মেয়েরা কাঠ কুড়োয় বুঝি?
মুখ্যু বলেই মেয়েগুলো বিনা পয়সায় সময় আর পরিশ্রম দিয়ে কাঠকুটো জোগাড় করে চলেছে। তাই তো সবার কাছে স্বাস্থ্যকর জ্বালানি পৌঁছে দেওয়ার দায় এত সহজে ঝেড়ে ফেলতে পারছে সরকার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy