Advertisement
E-Paper

আর কত পলাশ সরণি

শব্দ ও অভিব্যক্তির সমাবেশে দাঁড়িয়ে লেখক, কবিরা চিন্তায় পড়েন। যা উচ্চারণ করলে হিমশীতল রোষের মুখে পড়তে হয়, সেই সব শব্দাবলি বাদ দিতে দিতে শব্দভান্ডারে কী-ই বা বাকি থাকে।

অনিতা অগ্নিহোত্রী

শেষ আপডেট: ০৮ মার্চ ২০২৫ ০৫:১৮
Share
Save

অনেক মৃত্যু, অনেক মৃত্যু-নামাঙ্কিত হত্যা পার হয়ে আমরা পৌঁছে যাই দ্বান্দ্বিক ধূসরতায়। সাম্প্রতিক কালের দীর্ঘতম প্রতিবাদ ও অধিকার আন্দোলনের শেষে ডেকরেটর তুলে নিতে আসেন পাখা, জেনারেটর। ত্রিপল নিয়ে টানাটানি হয়। লালবাজারে আলোচনার জন্য পৌঁছনোর আগে জুনিয়র ডাক্তারদের পেরোতে হয় একাধিক ব্যারিকেড। সমান্তরাল ভাবে, রাত দখলের আন্দোলন চলতে থাকে সুরক্ষিত পরিসরের জন্য, মেয়ে ও ট্রান্স-কুইয়রদের দাবিতে। ক্রমশ পিঠেপুলির ছবিতে রঙিন হয় সমাজমাধ্যম, একে একে মঞ্চে এসে দাঁড়ায় বাঙালির প্রিয় বাৎসরিক অনুষ্ঠানগুলি— চলচ্চিত্র উৎসব, বইমেলা। শব্দ ও অভিব্যক্তির সমাবেশে দাঁড়িয়ে লেখক, কবিরা চিন্তায় পড়েন। যা উচ্চারণ করলে হিমশীতল রোষের মুখে পড়তে হয়, সেই সব শব্দাবলি বাদ দিতে দিতে শব্দভান্ডারে কী-ই বা বাকি থাকে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, পাহাড়ি ঝর্নায় স্নান, বন্যপ্রাণ, এগুলি বিষয় হিসেবে নিরাপদ। সমাজমাধ্যমের পোস্ট-এ তা-ই দিতে থাকি।

শোনা যাচ্ছে, কর্মরত ডাক্তার মেয়েটি নিহত হয়েছিলেন একরোখা প্রতিবাদ করতে গিয়ে। যে বিপুল দুর্নীতির ঊর্ণাজালে তিনি দুলছিলেন পতঙ্গের মতো, তা একার চেষ্টায় ছিঁড়ে দিতে গিয়ে অত্যাচারিত, নিহত হয়েছিলেন। সম্ভবত একাধিক ব্যক্তির হাতে, যারা কর্মক্ষেত্রে তাঁর পরিচিত। তিনি হয়তো ভাবতে পারেননি প্রত্যাঘাত এই ভাবে, এই চেহারায় আসবে। আর তাঁর হত্যার ঠিক পরেই ঘটনাস্থল থেকে সাক্ষ্যপ্রমাণ নিপুণ ভাবে ঘষে তুলে দেওয়ার অভিযোগও উঠবে শাসকের বিরুদ্ধে। ১৪ অগস্ট রাতে হাসপাতালে সংগঠিত আক্রমণ ঘটবে পুলিশের সামনে।

মেদিনীপুরের প্রসূতিরা বিশ্বাস করেছিলেন সরকারি ব্যবস্থায়। হাসপাতালে প্রসব সুরক্ষিত, যেমনটি আশা দিদিরা বলে থাকেন, তাই তাঁরা নিজেদের সঁপে দিয়েছিলেন সরকারি ব্যবস্থার হাতে। হাসপাতালে যে নিষিদ্ধ স্যালাইন ব্যবহার হবে তাঁদের উপর, তাঁরা হয়তো ভাবেননি। এই মায়েদের সন্তানরা বড় হয়ে নিশ্চয়ই জানবে, তাদের মায়েদের আগেও অন্য রাজ্যে প্রসূতিরা শহিদ হয়েছেন বাংলার এক কারখানায় তৈরি স্যালাইনে। তদন্ত ও নিষেধাজ্ঞার পরেও নিষিদ্ধ স্যালাইন সরবরাহ হতে থেকেছে বাংলার হাসপাতালে। জীবনের প্রতি এত উদাসীনতা কি স্বাভাবিক? কোনও সমালোচনাই গ্রহণযোগ্য হবে না বিপুল সংখ্যক আসনে নির্বাচিত সরকারের কাছে, আশীর্বাদী ফুলের মতো ডাক্তারদের মাথায় ঝরে পড়বে কেবল ভাতা।

সিনিয়র-জুনিয়র ডাক্তাররা মিলে গত অগস্ট থেকে যে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন, তার মূল উদ্দেশ্য ছিল, দুর্নীতি এবং দমনের সংস্কৃতির বিরোধ। মুষ্টিমেয় ক্ষমতাশালীর প্রভাব সরিয়ে সামগ্রিক স্বাস্থ্যব্যবস্থায় স্বচ্ছতা আনা। কিন্তু তার বদলে সমান্তরাল রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় উঠে এসেছে বিকল্প সংগঠন। দমনতন্ত্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা করার দোষে অভিযুক্ত হয়েছেন অধ্যক্ষরা। মেদিনীপুরের মর্মান্তিক ঘটনার পর স্যালাইনের মান নিয়ে তদন্ত হল বটে, কিন্তু সন্দেহ থেকেই গেল— বাকি হাসপাতালের স্যালাইন, ওষুধের স্টক কি নিরাপদ? মনের মধ্যে চলে অনিশ্চয়তা-জনিত ক্ষোভ। স্বাস্থ্যব্যবস্থার দুর্নীতি নিয়ে কি শাসক তবে চিন্তিত নন? যদি জীবনের মূল্যে দুর্নীতির দাম দিতে হয়, তা-ও?

ভারতের স্বাস্থ্য-মানচিত্রে বাংলার কোনও পরিসংখ্যান এখন আর নেই। আমরা নিজেরাই নিজের তুলনা। পঞ্চম জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষার তথ্য দেখাচ্ছে, বাংলার মেয়েদের অবস্থা যথেষ্ট উদ্বেগজনক। শিশুদের পুষ্টির উন্নতি হয়নি, নারী ও শিশুদের রক্তাল্পতাও তেমন কমেনি। বাংলায় মেয়েদের কম বয়সে বিয়ে ও গর্ভধারণের প্রবণতা বদলায়নি— এখনও এ রাজ্যে ৪২ শতাংশ মেয়ের নাবালিকা অবস্থায় বিয়ে হয়। রাজ্য সরকারেরই একটি সমীক্ষা দেখিয়েছে, রাজ্যে ছ’জন মায়ের এক জনের বয়স উনিশ বছর বা তার কম (২০২৩)। ১৯৯৮-৯৯ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত সমীক্ষার নানা সূচকে যে উন্নতি দেখা গিয়েছিল, তার অনেকগুলি এখন নিম্নমুখী। পশ্চিমবঙ্গে অপুষ্টির জন্য ‘স্টান্টেড’ শিশু ও কম ওজনের শিশুর সংখ্যা উদ্বেগজনক ভাবে বেশি। আসলে ভারত সরকারও যেমন পুষ্টি ও স্বাস্থ্যের উন্নতিতে বরাদ্দ বাড়াচ্ছে না, তেমনই রাজ্য সরকারও স্বাস্থ্য বলতে বোঝে স্বাস্থ্য-বিমা। আশাকর্মীরা জানাচ্ছেন, সরকারি হাসপাতালে অনেক পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকে না বলে তাঁদের তত্ত্বাবধানের পরেও মেয়েরা যেতে চান না। মেদিনীপুরের প্রসূতিদের মতো বহু মা যাচ্ছেন সরকারি হাসপাতালে। আশা করি তাঁদের জীবনের সুরক্ষাকে স্বাস্থ্য বিভাগ গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেছে।

আলাপ-আলোচনাহীন পরিসরে হঠাৎ পশ্চিমবঙ্গে এল একটি ধর্ষণ-বিরোধী আইন। তদন্তের সময় কমানো আর শাস্তির মেয়াদ বাড়ানো ছাড়া আইনের প্রস্তাবটির কোনও উদ্দেশ্য স্পষ্ট হল না। দুর্বল আইনশৃঙ্খলার পরিকাঠামো, পুলিশের সংখ্যায় ঘাটতি, কোনও কিছুই বদলানোর চেষ্টা হয়নি। তবু সরকারের তরফে ফাঁসির দাবি তীব্র হয়েছে। কেবল শাসক নন, গ্রামে-গঞ্জে মেয়েরাও আজকাল নাকি ধর্ষকের ফাঁসিকেই ‘বিচার’ মনে করেন। দৈনন্দিন ঘরে-বাইরে লাঞ্ছনা, আক্রমণের শঙ্কা, প্রশাসনের নিস্পৃহতা, সব কিছুর বদলা হিসেবে কোনও এক অপরাধীর ফাঁসি— এটাই যেন ‘প্রাণের আরাম’। অথচ সুপ্রিম কোর্ট একাধিক রায়ে বলেছে, ফাঁসি অনিবার্য শাস্তি হয়ে ওঠা সমীচীন নয়। ফাঁসির ফলে ধর্ষণের ঘটনা কমেছে, এর কোনও প্রমাণ নেই। তা হলে রাজ্য সরকার আর জি কর মেডিক্যাল কলেজের ঘটনার একমাত্র অভিযুক্তের ফাঁসির দাবি করে উচ্চতর কোর্টে কেন গেল? এতে মনে অস্বস্তিকর প্রশ্ন তৈরি হয়। একমাত্র অভিযুক্ত ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড যদি প্রার্থনীয়, তবে সরকারি হাসপাতালে তথ্য-প্রমাণ সংরক্ষিত রাখায় এত হেলাফেলা কেন? না কি মৃত্যুদণ্ডও সাক্ষ্য-প্রমাণ লোপের মহড়া? ভুললে চলবে না, নারী-নিগ্রহের চূড়ান্ত কোনও ঘটনার ক্ষেত্রেও ফাঁসি মানেই বিচার নয়। বিচারের পরিস্থিতি তৈরি হবে যখন সাক্ষ্যদানে প্রতিটি মেয়ে সুরক্ষিত বোধ করবেন। বিচার মানে কেবল আদালতের বিচার নয়, প্রয়োজন রাষ্ট্রের সম্পূর্ণ সমর্থনে তৈরি একটি বৈষম্যহীন ব্যবস্থা। কিন্তু সে পথে এগোনোই তো কঠিন হয়ে পড়েছে মেয়েদের কাছে। না, ‘ভাইয়েরা বোনেদের দেখবে’, এই সরল সমীকরণের ভরসায় মেয়েরা লড়তে পারেন না।

দেখতে দেখতে এসে গেল বসন্তকাল। পলাশের মাস। শাসক দলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে হাজরা রোড জুড়ে পলাশ গাছ লাগানো হবে, তাদের নেত্রীর নিগ্রহ স্মরণে রাখতে। হাজরা রোড হয়ে উঠবে ‘পলাশ-বীথি’। রঙিন দৃশ্যটি কল্পনা করতে ভাল লাগে। আমরা নিশ্চয়ই ভুলিনি, ১৯৯০ সালের দিনের আলোয় জনবহুল পথে এক দুষ্কৃতী মাথায় লাঠি মেরে জীবনসংশয় ঘটিয়েছিল মমতার। মাথার খুলি ফেটে গিয়েছিল তাঁর। কী হল সেই ঘটনার বিচার ও শাস্তি? স্বাভাবিক ভাবেই আঙুল উঠেছিল তদানীন্তন শাসক দলের দিকে। ঘটনার পরে পুলিশ স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে মামলা দায়ের করেছিল। ঊনত্রিশ বছর মামলা চলার পর ২০১৯ সালে বেকসুর খালাস পায় অভিযুক্ত। তার অপরাধ প্রমাণ করা সম্ভব হয়নি। বিচার চলেছিল বামফ্রন্ট ও তৃণমূল, দুই শাসন কাল জুড়ে। দিনের পর দিন সাক্ষ্য দেওয়ার লোক মেলেনি। শেষে আদালতের বিরক্তিতে প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে মামলা তুলে নেওয়া হয়। সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে জানা যায়, ২০১১ সালের আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সাক্ষ্যদান করতে পারেননি যথেষ্ট সুরক্ষার অভাবে। তাঁর অনুরোধমতো ভিডিয়ো কনফারেন্সিং-এর ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়নি। বিচার পাননি মমতা। সে দিনের নিগৃহীতা নেত্রী আজ শাসনের শীর্ষে।

আর জি করের চিকিৎসক, মেদিনীপুরের প্রসূতি, কামদুনি আর তেহট্টের বিচার না-পাওয়া মেয়েরা কেউ জীবিত নেই। নারী দিবসের প্রাক্কালে এই দাবি থাক, নিগৃহীত মেয়েদের স্মৃতিতে বাংলা যেন একটি দীর্ঘ পলাশ সরণি না হয়ে যায়।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

RG Kar Protest RG Kar Rape and Murder Case Saline Controversy Health Women's Day

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}