মর্গের অন্ধকারে দুই ভাইবোন হালা এবং ওমর। রবিবার সিরিয়ার দামাস্কাসে এএফপির ছবি।
জানলা দিয়ে সকাল সকাল বৃষ্টি দেখে ঘুম ভাঙে ফইজের। আকাশধোয়া বৃষ্টি নয়। বোমা-গুলি-বারুদের বৃষ্টি। বাড়িতে একফোঁটা জল নেই। দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ বিদ্যুৎ। বন্ধ স্কুল। বন্ধ খেলা। স্তব্ধ জীবন। শৈশবও।
যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়া। পাঁচ বছরের টানা গৃহযুদ্ধে দেশটা অনেক দিন আগেই ধ্বংসস্তূপ। সিরিয়ার সবচেয়ে প্রাচীন শহর আলেপ্পো। এখনও পর্যন্ত যুদ্ধে কয়েক লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে সেখানে। তার মধ্যে এক লক্ষই শিশু। তিন লক্ষ মানুষ এখনও আটকে আলেপ্পোয়। আর এই দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত একটাই জিনিস। শৈশব।
সোশ্যাল মিডিয়া আর সংবাদমাধ্যমের দৌলতে দুনিয়া চিনেছে আলান কুর্দি থেকে শুরু করে ওমরান দাকনিশকে। কিন্তু ওদের মতোই আরও অসংখ্য শিশু প্রতিদিন মরছে সিরিয়ায়। ফইজরা তারই উদাহরণ।
সালটা ২০১১। গৃহযুদ্ধের শুরু তখনই। প্রেসিডেন্ট বাসার আল-আসাদ সরকারের পতনের দাবিতে শুরু হয়েছিল গণঅভ্যুত্থান। সেই সুযোগেই সশস্ত্র সংগঠনগুলি মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করে। একের পর এক ধ্বংসলীলা চালাতে থাকে আইএসের মতো জঙ্গি সংগঠন। দেশের সেনাবাহিনী আইএসের সঙ্গে যুঝতে পারছে না, এই যুক্তিতে গত বছরের শেষের দিকে সিরিয়ার আকাশ-সীমায় ঢুকেছিল রুশ বোমারু বিমান। তার পর থেকে গত এক বছর ধরে কার্যত নিরবচ্ছিন্ন ভাবে সিরিয়ায় হানাদারি চালিয়েছে তারা।
মাঝখানের একটা সময় যুদ্ধ-বিরতিতে সাময়িক স্বস্তি এসেছিল বটে। কিন্তু গত ১৯ সেপ্টেম্বর ফের যুদ্ধ-বিরতি লঙ্ঘন করে শুরু হয় গুলি-বোমার বৃষ্টি। তার জেরে এর মধ্যেই আলেপ্পোতে অন্তত ৩২০ জনের মৃত্যু হয়েছে। তার মধ্যেই ৯৬টিই শিশু বলে জানিয়েছে ইউনিসেফ। আহত প্রায় ৮৪০ জন। গত সপ্তাহেই প্রায় ১৯০০ বার বোমা পড়েছে আলেপ্পোয়। যাতে বাদ পড়ছে না হাসপাতালও। গত কালই শহরের সবচেয়ে বড় হাসপাতাল এম-১০ ধ্বংস হয়ে গিয়েছে বোমারু
বিমান হানায়।
রাষ্ট্রপুঞ্জের শিশু সংক্রান্ত বিভাগের আঞ্চলিক মুখ্য সংযোগকারী আধিকারিক জুলিয়েট তৌমা জানাচ্ছেন, এই মুহূর্তে শিশুদের জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে বিপজ্জনক জায়গা আলোপ্পো়। খাবার নেই, জল নেই। বছরের পর বছর বন্ধ স্কুল। বন্ধ হাসপাতাল। যুদ্ধে আহত শিশুগুলির জন্য নেই নূন্যতম চিকিৎসার ব্যবস্থাও। এই অবস্থা থেকে পালানোর চেষ্টা করেছে প্রতিটি পরিবার। তবু পরিস্থিতি একই রকম জটিল। তৌমার কথায়, ‘‘ঠিক কত জন শিশুকে যুদ্ধের আতঙ্ক তাড়া করে বেরাচ্ছে, তা বলা অসম্ভব। গত কয়েক সপ্তাহে যে মারাত্মক হিংসার ছবি এখানকার শিশুদের মনে গাঁথা হয়ে গিয়েছে, তা ভয়াবহ।’’
শুধু আলেপ্পোই নয়। রাজধানী দামাস্কাসের অবস্থাও প্রায় একই রকম। মাস খানেক আগে বাবাকে হারিয়েছিল হালা আর ওমর। বয়স পাঁচ থেকে সাত। আজ তাদের বাড়ির উপরই একটা বোমা পড়ে। হালা আর ওমরের মা আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি। আর খুদে দুই ভাই-বোনের ঠাঁই হয়েছে হাসপাতালের মর্গের টেবিলে।
কিন্তু যুদ্ধ-বিরতি ঘোষণার পরে ক্রমশ ছন্দে ফেরার চেষ্টা করছিল আলেপ্পো। খুলতে শুরু করেছিল বেশ কয়েকটি স্কুল। মাটির নীচে বাঙ্কারে কোথাও কোথাও শুরু হয় ক্লাসও। তবে বারবার বিমান হামলায় রেহাই পায়নি সেগুলোও। একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা আলেপ্পোয় ১৩টি স্কুল চালায়। যার মধ্যে বেশ কয়েকটি স্কুলই বাঙ্কারে। তারই এক সদস্য নিক ফিনে জানাচ্ছেন, এই যুদ্ধর অর্থই হল কোথাও শিশুদের জন্য এতটুকু সুরক্ষিত জায়গা না রাখা।
আলেপ্পোর চিকিৎসকেদের দাবি, রিপোর্ট হওয়া মৃত্যুর তুলনায় অনেক বেশি সংখ্যক শিশুর মৃত্যু হচ্ছে এখানে। কোনও কোনও পরিবার তো হাসপাতাল বা মর্গে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা না করে বাড়িতেই কবর দিচ্ছেন প্রিয়জনকে। সেই মৃত্যুগুলো কোথাও নথিভুক্তও হচ্ছে না।
বাড়ির মধ্যেই অধিকাংশ সময় থাকায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মহিলা ও শিশুরাই বিমান হামলা বা বোমার শিকার হচ্ছেন বলে জানালেন শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ হাতেম। যুদ্ধের সময় এক এক দিনে একসঙ্গে ৮০-১২০টি শিশুরও চিকিৎসা করতে হয়েছে বলে জানাচ্ছেন তিনি। সিরিয়ার একটি পর্যবেক্ষক দল জানাচ্ছে, শুধুমাত্র রুশ বিমান হামলায় সিরিয়ায় ৯,৩৬৩ জন মানুষের মৃত্যু হয়েছে। তার মধ্যে ৯০৬টিই শিশু।
আর এই যুদ্ধের আবহে ক্রমশ শেষ হয়ে যাচ্ছে সিরিয়ার শৈশব। গুলি-বোমা-বন্দুক-রক্ত দেখে দেখে ক্লান্ত ফইজরা। প্রতিটি বাড়িই যেন পরিত্যক্ত কসাইখানা। আর যার মারাত্মক প্রভাব পড়ছে ছোট্ট মনগুলোতে। মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে তারা। কেউ কেউ অত্যন্ত হিংস্র হয়ে উঠছে। কেউ আবার পঙ্গুত্বের শিকার। কেউ হারিয়েছে কথা বলার ক্ষমতা।
তবে এত রক্তপাতের মধ্যেও ভিতরে ভিতরে চলছে অন্য একটা যুদ্ধ। ঘুরে দাঁড়ানোর। সিরিয়ার প্রত্যেকটা শিশুর জন্য একটা সুস্থ ভোর ছিনিয়ে আনার যুদ্ধ। নিক ফিনে বা হাতেম। সকলেই যে বলছেন, ‘‘লড়াই জারি হ্যায়।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy