Advertisement
০৬ নভেম্বর ২০২৪
International

বিদ্রোহীদের পতন, সেনার সঙ্গে সমঝোতায় অবরোধমুক্ত আলেপ্পো

পতন হল আলেপ্পোর বিদ্রোহীদের। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাসার আল-আসাদের সেনার সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছল তাঁরা। রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদের সভায় রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত ভিতাইল চুরকিন জানান, আলেপ্পোয় সামরিক অভিযান বন্ধ রাখা হচ্ছে। পুরো শহরের দখল এখন আসাদের সেনার হাতে চলে এসেছে।

বিধ্বস্ত শহরে আগামী প্রজন্ম। ছবি: রয়টার্স।

বিধ্বস্ত শহরে আগামী প্রজন্ম। ছবি: রয়টার্স।

রত্নাঙ্ক ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ১৪ ডিসেম্বর ২০১৬ ১০:৩৭
Share: Save:

পতন হল আলেপ্পোর বিদ্রোহীদের। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাসার আল-আসাদের সেনার সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছল তাঁরা। রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদের সভায় রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত ভিতাইল চুরকিন জানান, আলেপ্পোয় সামরিক অভিযান বন্ধ রাখা হচ্ছে। পুরো শহরের দখল এখন আসাদের সেনার হাতে চলে এসেছে। আটকে থাকা সাধারণ নাগরিক ও বিদ্রোহীরা এ বার নিরাপদে সরে যেতে পারবেন। এ ভাবেই আলেপ্পোয় প্রায় পাঁচ বছরের লাগাতার যুদ্ধের শেষ হল। সমঝোতা অনুযায়ী, প্রথমে সাধারণ নাগরিকরা চলে যাবেন। তার পরে যে ক’জন বিদ্রোহী এখনও রয়ে গিয়েছেন তাঁদের চলে যেতে দেওয়া হবে। নাগরিক ও বিদ্রোহীদের হয় পশ্চিম আলেপ্পোয় বা ইদলিবে নিয়ে যাওয়া হবে। বিদ্রোহীদের তরফ থেকেও সমঝোতার কথা স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে।

আসাদের সেনার লাগাতার হামলার সামনে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছিল বিদ্রোহীদের। প্রায় ৯০ শতাংশ আলেপ্পো আসাদের সেনার হাতে চলে এসেছিল। আলেপ্পো শহরের পূর্ব দিকে কয়েকটি জায়গায় মাত্র বিদ্রোহীরা লড়াই চালাচ্ছিল। শুরু হয়েছিল গণহত্যাও। অভিযোগ, এর মধ্যেই ৮২ জনকে দেখা মাত্র হত্যা করেছে আসাদের সেনা। আরও বড় গণহত্যার আশঙ্কা করছিলেন অনেকে। আশা করা হচ্ছে, এই সমঝোতার পর রক্তপাত অন্তত বন্ধ হবে। পাশাপাশি আসাদকে ক্ষমতা থেকে সরানো এবং মৌলবাদের ছোঁয়াচ মুক্ত শক্তিকে সিরিয়া ক্ষমতায় আনার চেষ্টাও শেষ হয়ে গেল। যে চেষ্টায় মদত দিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। হাত ধরেছিল ইউরোপের বড় শক্তিরা। সাহায্য করেছিল সৌদি আরব, কাতার, কুয়েতের মতো সুন্নি দেশগুলি। এবং ওবামা নয়, বছরের শেষ হাসিটিও হাসতে চলেছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।

আর পাঁচটা শহরের থেকে অনেকটাই আলাদা আলেপ্পো। ভূমধ্যসাগরের তীরে এ অঞ্চলের ইতিহাস শুরু হয়েছে খ্রিষ্টপূর্ব একবিংশ শতক থেকে। কালের ঝ়ড়-ঝাপটা সয়ে এত দিন মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ছিল আলেপ্পো। ইউনেস্কোর হেরিটেজ সাইট হিসেবে আলেপ্পো স্বীকৃত। ইতিহাস বলছে এক সময়ে সফল বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল আলেপ্পো। স্বাধীন সিরিয়ায় অন্যতম শিল্পকেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে আলেপ্পো।

আরও পড়ুন: আলেপ্পোয় আসাদবিরোধী বিদ্রোহ পতনের মুখে, নির্বিচারে গণহত্যার অভিযোগ

আর আজ প্রায় ধ্বংসস্তুপ, শ্মশান হয়ে যাওয়া সেই শহরের ধুলোমলিন পথে বিজয়গর্বে এগিয়ে চলেছে আসাদের সেনা। কিন্তু এমনটা কি হওয়ার কথা ছিল? ২০১১ থেকে সিরিয়া যখন প্রেসিডেন্ট আসাদের বিরুদ্ধে উত্তাল তখন শান্তই ছিল আলেপ্পো। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস ছাড়া সে ভাবে আসাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ দেখা যায়নি। পরিস্থিতি আচমকাই পাল্টে যায় ২০১২-এর জুলাই মাসে। এত দিন ধরে যে ক্ষোভ ছিল ছড়ানো-ছেটানো তাই দানা বেঁধে বিদ্রোহের আকার নেই। বিদ্রোহীরা আলেপ্পো থেকে সিরিয়ার সেনা সরাতে আক্রমণের পথ নেয়। বেশ খানিকটা অঞ্চল থেকে সিরিয়ার সেনাকে সরিয়ে দিতে সক্ষমও হয় বিদ্রোহীরা। ধীরে ধীরে উত্তর সিরিয়া জুড়ে আসাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ চরম আকার নেয়।

তার পরে পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি। শহরের পশ্চিম দিকে বিদ্রোহীরা। অন্য দিকে আসাদের সেনা। কখনও আসাদের সেনা কিছুটা এগিয়ে আসে। কখনও বিদ্রোহীরা নতুন এলাকার দখল নেয়। আর এর মাঝে শহরটা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। হেরিটেজ সাইটগুলি পুড়ে খাক হয়ে গিয়েছে। বিদ্রোহীদের ঠেকাতে আলেপ্পো জুড়ে ব্যারেল বোমা ফেলতে শুরু করে আসাদের বায়ুসেনা। কিন্তু সে বোমায় শুধু বিদ্রোহীরা মরে না। মরে সাধারণ মানুষ। মরে শিশু ও নারীরাও। সঙ্গে শুরু হয় অবরোধে। খাদ্য ও ত্রাণ সামগ্রীর অভাবে আটকে পড়া সাধারণ নাগরিকদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে।

সিরিয়া যখন উত্তাল, আসাদের গদি যখন টলোমলো, তখন প্রথমে কিছুটা বিভ্রান্ত ছিল পশ্চিমী বিশ্ব। সিরিয়া সেনার গণহত্যা এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ সুন্নিদের ন্যায্য দাবি মেনে নিতেও দ্বিধা ছিল। কারণ, এই সুন্নি বিদ্রোহীদের সঙ্গে মৌলবাদীদের যোগাযোগ। তবে পরে দ্বিধা কাটে। আলেপ্পোয় মৌলবাদের সঙ্গে যুক্ত নয় এমন বিদ্রোহীরা এক সঙ্গে করে ‘ফ্রি সিরিয়ান আর্মি’ তৈরি হয়। আমেরিকা-সহ পশ্চিমি বিশ্ব সমর্থন করে তাদের। অস্ত্র ও অর্থ জোগায়। সৌদি আরব-সহ সুন্নি দেশগুলিও সমর্থন করেছে। বিপদে-আপদে এই বিদ্রোহীদের পিছনে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন। ‘ফ্রি সিরিয়ান আর্মি’কে রাজনৈতিক ভাবে স্বীকার করে নেওয়া হয়। সিরিয়া সংক্রান্ত শান্তি আলোচনায় তাদের প্রতিনিধিরা যোগ দেয়।

কিন্তু পরিস্থিতি পাল্টে দেয় ঝড়ের বেগে ইসলামিক স্টেটের (আইএস) উত্থান। বিশ্বের নজর যেন আইএস-এর দিকেই সরে যায়। আর আলেপ্পো জুড়ে সেনা আর বিদ্রোহীদের ঘাত-প্রতিঘাত চলতে থাকে। মাঝে দুর্বিষহ পরিস্থিতিতে আটকে পড়ে কয়েক লক্ষ নাগরিক।

আইএস যতই ক্ষমতাশালী হয়েছে ততই বিশ্বের নজর আলেপ্পো থেকে সরে গিয়েছে। আর ‘ফ্রি সিরিয়ান আর্মি’-র অর্থ আর অস্ত্রের যোগানে ততই টান পড়েছে। আর লড়াইটা ক্রমাগত ত্রিমুখী হয়ে গিয়েছে।

‘ফ্রি সিরিয়ান আর্মি’কে এক দিকে সিরিয়ার সেনার সঙ্গে লড়তে হচ্ছে। অন্য দিকে নিজেদের কর্তৃত্ব বজায় রাখতে আইএস-এর বিরুদ্ধেও লড়তে হচ্ছে। অর্থ আর অস্ত্রের জোগান আশ্বাসই রয়ে গিয়েছে।

তার পরেও হয়তো বিদ্রোহ চলত, কিন্তু সব সমীকরণ বদলে দেয় রাশিয়া। আসাদের সমর্থনে রাশিয়া সেনা যুদ্ধে নামার পর থেকেই তাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল আইএস নয় ‘ফ্রি সিরিয়ান আর্মি’। রাশিয়ার বায়ুসেনার প্রবল হানার সামনে কার্যত অসহায় ছিল ‘ফ্রি সিরিয়ান আর্মি’। সিরিয়ার সেনার সঙ্গে এসে যোগ দেয় ইরানের শিয়া মিলিশিয়ারা। এই চাপ সামালানো অসম্ভব ছিল ‘ফ্রি সিরিয়ান আর্মি’-র কাছে। তার পরেও সে ভাবে সাহায্য জোটেনি। শুধু মাঝে আটকে থাকা নাগরিকদের উদ্ধারের জন্য সরব হয়েছে মানবাধিকার সংগঠনগুলি। সরব হয়েছে রাষ্ট্রপুঞ্জ। ত্রাণ পৌছেছে। কিন্তু ‘ফ্রি সিরিয়ান আর্মি’-র হাত শক্ত করার কোনও উদ্যোগ চোখে পড়েনি। আলেপ্পো ও সন্নিহিত অঞ্চলে ক্রমেই জোরালো হয়েছে আসাদের মুঠি।

আজ সেই বৃত্ত সম্পূর্ণ হতে চলেছে। সিরিয়াকে আসাদ বিহীন করা আপাতত দুর অস্ত। ওবামা কথা রাখতে পারেননি। ‘রাশিয়া প্রেমী’ ডোনাল্ড ট্রাম্প আদৌ এ সবের তোয়াক্কা করবেন না। শেষ সম্বলটুকু নিয়ে পালিয়ে আসা নাগরিকদের অনেকেই বিজয়ী সেনার আস্ফালনের পীড়ন নীরবে সইবেন। আবার একটি জয় ঝুলিতে পুরলেন ভ্লাদিমির পুতিন। আরও অনিশ্চিত হয়ে পড়ল সিরিয়ার ভবিষ্যত।

অন্য বিষয়গুলি:

Aleppo Bashar al-Assad Syrian Rebel
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE