কেউ বলছেন, বাড়াবাড়ি। কেউ ব্যবহার করছেন, ‘একুশে আইন’-এর মতো শব্দবন্ধ। আবার কেউ রাখঢাক না-করে সোজাসুজিই জানাচ্ছেন, পুলিশ ইচ্ছে করে ভুল করেছে। কারও মতে, প্রতিবাদীর বিরুদ্ধে সরকারের প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার প্রচেষ্টা।
বিশেষণের মাত্রার তারতম্য থাকলেও সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি থেকে প্রাক্তন পুলিশ কর্তা বা আইনজীবীদের একটা বড় অংশই একটা বিষয়ে একমত নাট্যব্যক্তিত্ব-চিত্রপরিচালক সুমন মুখোপাধ্যায়কে টানা ২২ ঘণ্টা থানায় বসিয়ে রেখে পুলিশ শুধু অনুচিত নয়, বেআইনি কাজ করেছে।
পুলিশের এই ‘বেআইনি আটকের’ বিরুদ্ধে সুমনবাবু চাইলে হাইকোর্টে রিট আবেদন করতে পারেন এবং সে ক্ষেত্রে পুলিশ বিপদে পড়ে যাবে বলে মনে করছেন প্রাক্তন পুলিশকর্তা ও আইনজীবীদের একাংশ। তবে মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত সে রকম কোনও সিদ্ধান্ত সুমনবাবু নেননি। তিনি শুধু বলেন, “আমার আইনজীবীদের সঙ্গে পরামর্শ করছি।”
আহত অভিনেত্রী স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায় বা তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে কেউ থানায় কোনও অভিযোগ করেননি। কোনও মামলাও রুজু করা হয়নি। তা হলে সুমনবাবুকে পুলিশ ডেকে পাঠালো কেন, এই প্রশ্ন সোমবারই উঠেছিল। মঙ্গলবার বিধাননগর পুলিশ কমিশনারেটের গোয়েন্দাপ্রধান অর্ণব ঘোষ সাংবাদিক বৈঠক ডেকে দাবি করেন, নিউটাউনের যে হোটেলের ঘর থেকে স্বস্তিকাকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়, সেই হোটেলের কর্তৃপক্ষ লিখিত ভাবে অভিযোগ করেছেন বলেই সুমনবাবুকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকা হয়েছিল।
যদিও হোটেল কর্তৃপক্ষ সোমবারই জানিয়েছিলেন, তাঁরা কারও বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ করেননি। হোটেলের ডিরেক্টর (সেল্স অ্যান্ড মার্কেটিং) অনুজ বিদানি এ দিনও বলেন, “এখনও বলছি, আমরা কোনও অতিথির নামে কোনও অভিযোগ করিনি।” তা হলে গোয়েন্দাপ্রধান কী ভাবে ওই দাবি করছেন? বিদানি বলেন, “সাংবাদিক বৈঠকে আমি ছিলাম না। তাই, ওখানে কী হয়েছে, সেটা বলতে পারব না।” হোটেলের একটি সূত্রে জানা গিয়েছে, ঘটনার কথা জানিয়ে হোটেল কর্তৃপক্ষের তরফে পুলিশকে একটি লিখিত বিবরণী দেওয়া হয়েছিল।
সুমনবাবুর আইনজীবী সৌম্যজিৎ রাহা মঙ্গলবার সন্ধ্যায় জানান, সুমনের বিরুদ্ধে একটি মামলা (কেস নম্বর ১৬৫, তারিখ: ২৫/৪/২০১৪) শুরু করে নিউটাউন থানার পুলিশ। পরের দিন অর্থাৎ ২৬ তারিখ (সোমবার) সকাল ১০টা নাগাদ পুলিশ সুমনকে দিয়ে একটি গ্রেফতারি পরোয়ানায় সই করিয়ে নেয়। সুমনবাবুও বলেন, “রবিবার সারা রাত থানায় বসিয়ে রাখার পরে সোমবার সকালে যে কাগজে আমাকে সই করিয়ে নেওয়া হয়, তা ছিল গ্রেফতারি পরোয়ানা। আমাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে বলে পরোয়ানায় লেখা ছিল।”
কিন্তু সে দিন দুপুরেই আচমকা সুমনকে বলা হয়, তিনি বাড়ি চলে যেতে পারেন। সুমন জানিয়েছেন, থানা থেকে বেরিয়ে আসার সময়ে তাঁর স্ত্রী মল্লিকা জালানকে দিয়ে পুলিশ একটি কাগজে লিখিয়ে নেয় যে, প্রয়োজনে পুলিশি তদন্তে তাঁরা সব সময়ে সাহায্য করবেন।
কলকাতা পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত কমিশনার তুষার তালুকদারের কথায়, “এটাই রহস্যজনক। এক জনকে দিয়ে গ্রেফতারি পরোয়ানায় সই করিয়ে নেওয়া হল, আবার তার পর তাঁকে বলা হল যে তিনি চলে যেতে পারেন?” সেই গ্রেফতারি পরোয়ানা কোথায় গেল, বা সুমনকে দিয়ে সই করানোর পরেও তার কপি কেন তাঁকে দেওয়া হল না, তার সদুত্তর পুলিশের কাছ থেকে মেলেনি।
তুষারবাবুর মতে, সুমন সমাজের এক জন প্রতিষ্ঠিত মানুষ। চোর-ডাকাত বা দাগি অপরাধী নন। ফলে, পুলিশ চাইলেই তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পেতে পারে। ওই প্রাক্তন শীর্ষ পুলিশকর্তার কথায়, “যে ঘটনার কথা খবরের কাগজ পড়ে জেনেছি, সেই ঘটনা সম্পর্কে জানতে তো বড়জোর এক ঘণ্টা লাগার কথা। সে জন্য সুমনবাবুকে কেন ২২ ঘণ্টা থানায় বসিয়ে রাখা হবে?”
কলকাতার আর এক অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কমিশনার প্রসূন মুখোপাধ্যায় অবশ্য মনে করেন, কেবল নির্দিষ্ট মামলা রুজু করার পর কিংবা নির্দিষ্ট অভিযোগ পেয়ে তবেই পুলিশ কাউকে ডাকবে, তা নয়। অনেক সময়ে জিজ্ঞাসাবাদ থেকে বেরিয়ে আসা সূত্রের ভিত্তিতেই মামলা রুজু করে পুলিশ। কিন্তু সে ক্ষেত্রে ওই ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় ডেকে পাঠানোর একটা ন্যূনতম কারণ থাকতে হবে।
প্রসূনবাবুর কথায়, “পুলিশ ঘণ্টার পর ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদও করল, আবার তার পর কোনও মামলা রুজুও করা গেল না, সে ক্ষেত্রে স্বভাবতই প্রশ্ন উঠবে, জেরা করার কি আদৌ কোনও প্রয়োজন ছিল? জিজ্ঞাসাবাদের নামে টানা ২২ ঘণ্টা থানায় বসিয়ে রাখা পুলিশের বাড়াবাড়ি ছাড়া কিছু নয়।” গোয়েন্দাপ্রধানের অবশ্য বক্তব্য, “মনে হয়েছে, তাই করেছি।”
আইনজীবী মহল কিন্তু বলছে, জিজ্ঞাসাবাদ করা বা না-করা পুলিশের মনে হওয়ার উপরে নির্ভর করে না। আইনজীবী দীপনারায়ণ মিত্রের মতে, যাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডেকে পাঠানো হচ্ছে বা তুলে নিয়ে আসা হচ্ছে, তাঁর বিরুদ্ধে ন্যূনতম অভিযোগ থাকতেই হবে। তিনি জানান, প্রথমে অভিযোগ, তার পর পুলিশি তদন্ত, তার পর সন্দেহবশত কাউকে তুলে আনা —এটাই পরের পর ধাপ।
সুমনের ঘনিষ্ঠ মহল সূত্রে জানা গিয়েছে রবিবার সারা রাত তাঁকে নিউ টাউন থানায় বসিয়ে রাখা হয়েছিল। কেউ একটা প্রশ্নও করেননি। দীপনারায়ণবাবু বলছেন, “এটাই তো বেআইনি। এটা পুলিশ করতে পারে না।” আইনজীবী অরুণাভ ঘোষেরও মত, সুমনকে রাতভর থানায় আটকে বসিয়ে রাখাটা পুরোপুরি বেআইনি। কাউকে সন্দেহবশত থানায় তুলে এনে জিজ্ঞাসাবাদের পরে হয় তাঁকে ছেড়ে দিতে হবে নয়তো গ্রেফতার করতে হবে। গ্রেফতার না করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা থানায় বসিয়ে রাখার নিয়ম নেই। অথচ সুমনবাবুর ক্ষেত্রে ঠিক সেটাই হয়েছে বলে দাবি।
হাইকোর্টের আইনজীবীদের বড় অংশ বলছেন, “এটা সংবিধানের ২৬ নম্বর ধারায় মানুষের স্বাধীনতার উপরে হস্তক্ষেপ।”
গোয়েন্দাপ্রধান অর্ণব ঘোষ অবশ্য বলছেন, “অসঙ্গতির উত্তর খুঁজতেই ২২ ঘণ্টা ধরে সুমনবাবুকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।” তাঁর মতে অসঙ্গতিগুলি হল— কী করে কাচ ভাঙল, হোটেলের ঘরে কী করে রক্তের দাগ মিলল ইত্যাদি। গোয়েন্দাপ্রধানের কথায়, “প্রাথমিক তদন্তে ক্ষতচিহ্ন দেখে মনে হয়নি, সেটা নিছকই দুর্ঘটনাজনিত। বরং মনে হয়েছিল এটা বিচারযোগ্য অপরাধ।” এ দিনের সাংবাদিক বৈঠকে অর্ণববাবু কিন্তু স্বস্তিকা বা সুমনের নাম করেননি। গোয়েন্দাপ্রধান তাঁদের ‘নামী ব্যক্তি’ বলে উল্লেখ করেন।
সুমনবাবু চাইলে পুলিশি হেনস্থার বিরুদ্ধে আদালতের দ্বারস্থ হতে পারেন বলেও মত আইনজীবীদের। প্রবীণ আইনজীবী অশোক বক্সীর কথায়, “সুমন মুখোপাধ্যায়কে ওই ভাবে থানায় আটকে রেখে পুলিশ ইচ্ছাকৃত ভাবে তাঁকে হেনস্থা করেছে। সুমন চাইলেই পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারেন।” তাঁর ব্যাখ্যা, তদন্তের জন্য পুলিশ কাউকে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬০ নম্বর ধারায় ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করতেই পারে। তবে সে ক্ষেত্রে ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট অভিযোগ পুলিশকে পেতে হবে কিংবা অভিযোগ না থাকলেও পুলিশ নিজে থেকে (সুয়ো মোটো) মামলা রুজু করবে। “কিন্তু সুমন মুখোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রে পুলিশের হাতে না ছিল অভিযোগ, না করেছিল পুলিশ সুয়ো মোটো মামলা। তা হলে কোন অধিকারে পুলিশ সুমনকে ডেকে পাঠাল?” প্রশ্ন অশোকবাবুর। তাঁর মতে, “একুশে আইন চলছে এখানে। আইন মেনে চলাটাই এখন বিপত্তির।”
সুমনবাবুকে ইচ্ছাকৃত ভাবে হেনস্থা করার অভিযোগ আরও জোরদার হয়েছে পুলিশেরই বক্তব্য থেকে। রবিবার বিকেল ৫টায় বিধাননগর (দক্ষিণ) থানায় সুমনকে ডেকে পাঠানো হয়েছিল। গোয়েন্দাপ্রধানের দাবি, “নিউ টাউন থানায় ওই ব্যক্তির নামে অভিযোগ জমা পড়ার পরেই তাঁকে সেই থানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।” কিন্তু পুলিশই তো বলছে, হোটেল কর্তৃপক্ষ রবিবার রাত ১০টায় অভিযোগ দায়ের করেছিলেন।
তা হলে অভিযোগ জানানোর পাঁচ ঘণ্টা আগেই কেন তাঁকে অন্য থানায় ডেকে পাঠিয়ে বসিয়ে রাখা হল? প্রশ্ন শুনেই সাংবাদিক বৈঠক শেষ করে দেন অর্ণববাবু। ঘর ছাড়ার আগে গোয়েন্দাপ্রধান শুধু বলে যান, “যা করেছি, আইন মোতাবেকই করেছি।”
আইনজীবী জয়ন্তনারায়ণ চট্টোপাধ্যায় মনে করেন, অভিযোগ না পাওয়া সত্ত্বেও কিংবা মামলা রুজু করার আগেই কাউকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করার আইনি অধিকার পুলিশের আছে। কিন্তু পুলিশ যাঁকে অভিযুক্ত হিসেবে সন্দেহ করছে, তাঁর কাছ থেকে নিশ্চয়ই সূত্র খুঁজবে না। বরং প্রাথমিক বিভিন্ন সূত্র থেকে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে কিছুটা তথ্যপ্রমাণ পেয়ে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার পথে হাঁটবে। জয়ন্তবাবুর কথায়, “যত দূর জেনেছি, সুমন মুখোপাধ্যায়কেই অভিযুক্ত হিসেবে পুলিশ সন্দেহ করছিল। আবার তাঁর কাছ থেকেই সূত্র খুঁজতে থানায় ২২ ঘণ্টা বসিয়ে রাখা হল! এটাই তো পুলিশের বিরুদ্ধে সন্দেহের জায়গা তৈরি করে দিচ্ছে।” তাঁর মতে, “সুমন মুখোপাধ্যায়কে বেআইনি ভাবে পুলিশ আটকে রেখেছিল। তাঁকে জেরা করার নামে পুলিশ আসলে হেনস্থা করেছে।”
সুমনবাবুর বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনার চেষ্টা হয়েছিল, তার সব ক’টির তদন্তও পুলিশের এক্তিয়ারে পড়ে না বলে অভিমত অরুণাভবাবুর। তাঁর কথায়, “হোটেলের জিনিসপত্র ভাঙার জেরে ক্ষতিপূরণের প্রশ্ন উঠলেও সেটা ফৌজদারি মামলা নয়। তা হলে পুলিশের তা নিয়ে মাথাব্যথা কেন? আমি জানি না, এ নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী নিজে কত দূর ওয়াকিবহাল। কিন্তু এর ফলে আখেরে রাজ্য সরকারের ভাবমূর্তিই খারাপ হচ্ছে।”
এই প্রসঙ্গে বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু বলেছেন, এর আগে শিক্ষক অম্বিকেশ মহাপাত্রের সঙ্গেও এমনটা হয়েছিল। তাঁর মতে, সরকারের এই ধরনের কাজ আসলে প্রতিহিংসার পরিচায়ক। বিমানবাবুর কথায়, “সুমন রাজ্যে পরিবর্তনের পক্ষে কথা বলেছিলেন। তখন বড় বড় হোর্ডিংয়ে অন্যদের সঙ্গে তাঁরও ছবি ছিল। এখন হয়তো সুমন সে কথা বলছেন না। তাই তাঁকে হেনস্থা করা হচ্ছে।”
রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের প্রাক্তন চেয়ারম্যান ও সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি অশোক গঙ্গোপাধ্যায়ের কথায়, “কী আর বলব! তবে এ ক্ষেত্রে সুমন মুখোপাধ্যায় আইনের দ্বারস্থ হতেই পারেন।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy