সাজাপ্রাপ্ত নাগা জওয়ান। শুক্রবার কোর্ট চত্বরে। — নিজস্ব চিত্র
মাওবাদীদের দমনে আসা নাগা জওয়ানদের ঘিরে বারবার নানা বিতর্ক তৈরি হয়েছে। কিন্তু এ বার শিবিরের মধ্যে গুলি চালিয়ে দুই সহকর্মীকে খুন করায় এক নাগা জওয়ানের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিল পুরুলিয়া আদালত।
শুক্রবার পুরুলিয়া আদালতের তৃতীয় কোর্টের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা বিচারক কে পি শাহ এই রায় দেন। আদালত সূত্রে জানা গিয়েছে, সাজাপ্রাপ্ত নাগা জওয়ানের নাম পুর লাম্বা এ.ও। নাগাল্যান্ড রাজ্য পুলিশের এই কনস্টেবলের বাড়ি নাগাল্যান্ডের মোককচাঙ জেলার মঙ্গলেম্বা থানার নোকপু গ্রামে। ওই জওয়ান পুরুলিয়ায় কর্মরত ছিলেন। ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০২ ধারা অনুযায়ী ওই জওয়ানকে যাবজ্জীবন কারাবাস ও ৫০০০ টাকা জরিমানা ধার্য করা হয়েছে। অনাদায়ে আরও দু’মাসের সশ্রম কারাদণ্ডের রায় দিয়েছেন বিচারক।
পুরুলিয়ার জঙ্গলমহল এলাকায় মাওবাদীদের উপদ্রব বৃদ্ধি পাওয়ায় ২০১০ সালের অগস্ট মাস থেকে জঙ্গলমহলের বিভিন্ন থানা এলাকায় ওই জওয়ানদের মোতায়েন করা হয়। পাহাড় জঙ্গলে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে দক্ষ নাগা জওয়ানদের পুরুলিয়ার বলরামপুর, আড়শা, বাঘমুণ্ডির জঙ্গল ঘেরা পাহাড়ি এলাকায় মোতায়েন করা হয়। সাজাপ্রাপ্ত জওয়ান ভারতীয় রিজার্ভ ফোর্সের আওতাধীন নাগাল্যান্ড রাজ্য সশস্ত্র পুলিশের ১০ নম্বর ব্যাটেলিয়নের কনস্টেবল পদে কর্মরত ছিলেন। ওই বাহিনীর শিবির ছিল বলরামপুরে।
সরকারি কৌঁসুলি মুমতাজ হোসেন আনসারি জানান, ২০১০ সালের ১ ডিসেম্বর রাতে বলরামপুর ব্লক সদরের কমিউনিটি হলে শিবিরে গুলি চলে। পুর লাম্বা এ.ও নামের ওই জওয়ান নিজের একে ৪৭ রাইফেল থেকে আচমকাই গুলি চালিয়ে খুন করে শিবিরের সেন্ট্রি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সশস্ত্র পুলিশের ১৩ নম্বর ব্যাটেলিয়নের কনস্টেবল সঞ্জয় বার ও নাগাল্যান্ড রাজ্য সশস্ত্র পুলিশের এএসআই কেউরি চিরুয়ুং ডোমিনিককে। সঞ্জয়ের বাড়ি পূর্ব মেদিনীপুরের খেজুরিতে। নিহত নাগাল্যান্ড পুলিশের এএসআইয়ের বাড়ি পুর লাম্বার গ্রামেই।
কেন হঠাৎ রাইফেল থেকে গুলি চালিয়ে দুই সহকর্মীকে খুন করলেন ওই জওয়ান? আদালতে বিচার চলাকালীন সময়ে তার কোনও সদুত্তর দিতে পারেননি সাজাপ্রাপ্ত ওই জওয়ান। এমনই জানিয়েছেন সরকারি কৌঁসুলি। তিনি জানান, সেই রাতে বড়দিন উপলক্ষ্যে শিবিরে অনুষ্ঠান ও খাওয়া দাওয়া হয়েছিল। বেশি রাতের দিকে অনু্ষ্ঠান সেরে ঘুমোতে গিয়েছিলেন ওই জওয়ান। প্রায় মধ্যরাতে ঘুম থেকে উঠে হঠাৎই তিনি এলোপাথাড়ি গুলি চালাতে শুরু করেন। পুর লাম্বাকে প্রথমে বাধা দিতে গিয়েছিলেন শিবিরের সেন্ট্রি সঞ্জয়বাবু। কার্যত উন্মত্ত অবস্থায় থাকা পুর লাম্বার গুলি করে ঝাঁঝরা করে দেয় সঞ্জয়কে। গুলির শব্দে ছুটে গিয়েছিলেন নাগাল্যান্ড পুলিশের এএসআই কেউরি চিরুয়ুং ডোমিনিক। তিনি পুর লাম্বাকে নিরস্ত করার চেষ্টা করলেও তিনিও রেহাই পাননি। গুলিবিদ্ধ হন তিনি। ঘটনাস্থলেই দু’জনের মৃত্যু হয়।
পরের দিন ওই জওয়ানকে গ্রেফতার করে বলরামপুর থানার পুলিশ। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেন বলরামপুর থানার তৎকালীন এএসআই তরণীকান্ত পান্ডে। এই মামলার অন্যতম উল্লেখযোগ্য দিক ওই জওয়ানকে গ্রেফতারের পরে দ্রুততার সাথে আাদালতে তাঁর বিরুদ্ধে চার্জশিট জমা করেছিল পুলিশ। তাই গ্রেফতারের পরে ওই জওয়ান আর জামিন পাননি। জেলবন্দি অবস্থাতেই তাঁর বিচারপর্ব শেষ হয়েছে।
যদিও ওই ঘটনার আগে থেকেই নানা অভিযোগ উঠেছে নাগা জওয়ানদের বিরুদ্ধে। ওই বছরই ৩০ সেপ্টেম্বর বলরামপুর বাজারে জাতীয় সড়কের উপরে গাড়িতে গুলি চালানোর অভিযোগ ওঠে নাগা বাহিনীর এক জওয়ানের বিরুদ্ধে। গুলিবিদ্ধ হয়ে এক যাত্রীর মৃত্যু হয়। এক জন আহত হন। তা নিয়েও তুমুল হইচই হয় জেলায়। বলরামপুরের ঘটনার পরে কোনও নাগা জাওয়ানের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ না উঠলেও ছোটখাটো গোলমালে বারবার তারা জড়িয়েছে।
অযোধ্যা পাহাড়ে গাড়িতে নাগা বাহিনীর কয়েক জন সদস্যকে কাঠ নিয়ে যেতে দেখে দুই বনাধিকারিক সেই কাঠের নথি দেখতে চাইলে বনকর্মীদের মারধর করা হয় বলে অভিযোগ। ২০১৩ সালের মে মাসে শিরকাবাদে চা খেয়ে চায়ের দাম মেটানো নিয়ে দোকানদারের সঙ্গে বচসা কিংবা ওই বছরই নভেম্বরে বেগুনকোদরে রাস্তায় যানজট থাকায় পথচারীদের সঙ্গে কথা কাটাকাটিতে জড়িয়ে পড়েন কিছু নাগা জওয়ান। দুই জায়গাতেই শিবির থেকে সহকর্মীদের ডেকে এনে ওই চায়ের দোকানদার বা এলাকার লোকজনকে বেধড়ক মারধর করেন জওয়ানেরা। এর পরে ক্ষোভ চরমে ওঠে। দলমত নির্বিশেষে এলাকার বাসিন্দারা নাগা বাহিনীর অপসারণের দাবিতে মিছিল করেন। এরই মাঝে ২০১৩-র জুলাই মাসে পুরুলিয়া শহরে বাজার করতে এসে রাস্তায় বসে থাকা একটি নেড়ি কুকুরকে আচমকা গুলি করে মারেন এক নাগা জওয়ান। এই ঘটনাকে ঘিরেও শহরে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এত অভিযোগের প্রেক্ষিতে ওই ১০ নম্বর নাগা ব্যাটেলিয়নকে বদলি করে ১২ নম্বর ব্যাটেলিয়ন আনা হয়। কিন্তু, তাতেও অবস্থার আদৌ বদল ঘটেনি বলে অভিযোগ স্থানীয় মানুষের। চলতি বছরও ফেব্রুয়ারি ও মার্চে ময়ূর মেরে ফেলা এবং এক পূজারিকে মারধরের ঘটনায় নাম জড়িয়েছে ওই বাহিনীর।
ছ’বছর হতে চলল ওই জওয়ানেরা এই জেলায় রয়েছেন। কিন্তু, ফি-বছর একাধিক অভিযোগ উঠেছে তাঁদের বিরুদ্ধে। আগের ব্যাটিলয়ন বদলি করে নতুন ব্যাটেয়িলন আনা হয়েছে। বর্তমানে ১২ নম্বর নাগা ব্যাটেলিয়ন রয়েছে পুরুলিয়ায়।
বলরামপুরের কুমারী কানন (অযোধ্যা পাহাড়ের নীচে), বলরামপুরের পাথরবাঁধ, বাঘমুণ্ডি (পুরুলিয়া পাম্পড স্টোরেজ জলবিদ্যুত প্রকল্পের অফিসের সামনে), অযোধ্যা হিলটপ, আড়শার শিরকাবাদ ও কোটশিলার মুরগুমা— এই ছয়টি শিবির রয়েছে নাগা বাহিনীর। জেলা পুলিশের এক কর্তা বলেন, ‘‘বিতর্ক ওদের সঙ্গে থাকলেও নাগা জওয়ানদের এখনই এলাকা থেকে সরানোর মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। কারণ মাওবাদীদের দমনে ওদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তবে ওদের আমরা জনসংযোগমীলক কাজে যুক্ত করেছি। তাতে এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে নাগা জওয়ানদের সম্পর্কের উন্নতি হচ্ছে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy