Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

ঝাঁটাই শাসনদণ্ড এয়ার ইন্ডিয়া কর্ণধারের

কলকাতা বিমানবন্দরে আপাতত অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থাকা একটি হ্যাঙারে জমেছে জঞ্জালের স্তূপ। দেখেই ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলেন এয়ার ইন্ডিয়ার নতুন চেয়ারম্যান তথা ম্যানেজিং ডিরেক্টর। সঙ্গীদের বললেন, ‘‘আমাকে একটা ঝাঁটা এনে দিন। আমি পরিষ্কার করে দিচ্ছি।’’

সুনন্দ ঘোষ
শেষ আপডেট: ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০৩:১৮
Share: Save:

কলকাতা বিমানবন্দরে আপাতত অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থাকা একটি হ্যাঙারে জমেছে জঞ্জালের স্তূপ। দেখেই ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলেন এয়ার ইন্ডিয়ার নতুন চেয়ারম্যান তথা ম্যানেজিং ডিরেক্টর। সঙ্গীদের বললেন, ‘‘আমাকে একটা ঝাঁটা এনে দিন। আমি পরিষ্কার করে দিচ্ছি।’’

চোখ রাঙিয়ে নয়। ধমকধামক দিয়েও নয়। একেবারে আপনি আচরি ধর্ম পরেরে শেখানোর রাস্তা বেছে নিলেন এয়ার ইন্ডিয়ার সিএমডি অশ্বিনী লোহানি। স্বচ্ছতা নিয়ে প্রতিযোগিতায় কেন্দ্র ও রাজ্যের ঝাঁটা-রাজনীতি সাম্প্রতিক কালের বেশ চর্চিত বিষয়। কিন্তু সেই হাঁকডাক-স্লোগান বা দেখনদারির রাজনীতি নয়। দেশ বা রাজ্যের মতো বড় পরিসরেও নয়। নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকা কর্মক্ষেত্রের মধ্যে কর্মী-অফিসারদের রোজকার কর্তব্যটুকু স্মরণ করিয়ে দিতে এয়ার ইন্ডিয়া-প্রধান এ বার ঝাঁটাকে ব্যবহার করলেন কার্যত শাসনদণ্ড হিসেবেই।

আর্থিক দিক থেকে ধুঁকতে থাকা এয়ার ইন্ডিয়ার গুরুদায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন মাত্র কয়েক দিন আগে। সেই সংস্থার কর্ণধার হিসেবে শনিবার প্রথম বার কলকাতায় এসে সংস্থার হ্যাঙারের (যার ভিতরে বিমান রেখে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়) হাল দেখে নিজের হাতে ঝাড়ু তুলে নিতে চাইলেন অশ্বিনী। কর্মস্থল সাফসুতরো রাখার জন্য ঝাঁটা হাতে নেওয়ার পরামর্শ দেওয়ার ছলে কড়া নির্দেশও দিলেন বিমানবন্দরের কর্তাদের।

কানপুরে জন্ম ও বেড়ে ওঠা অশ্বিনীর। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের চার-চারটি ডিগ্রি তাঁর দখলে। ১৯৮০ সালে ইন্ডিয়ান রেলওয়ে সার্ভিসে যোগ দেন। তার পর থেকে বহু গুরুত্বপূর্ণ পদ সামলেছেন। কখনও মধ্যপ্রদেশ সরকারের পর্যটন-প্রধান, কখনও বা কেন্দ্রের পর্যটন বিভাগের কর্ণধার, কখনও রেল জাদুঘরের কর্তা। বিমানবন্দরের কর্তাদের ধারণা, তাঁর উদ্ভাবনী ক্ষমতা এবং নতুন নতুন পরিকল্পনার জনক হিসেবেই অশ্বিনীকে বসানো হয়েছে এয়ার ইন্ডিয়ার শীর্ষে। আর কোন সময়ে তাঁকে এই দায়িত্ব দেওয়া হল? যখন সংস্থাকে টেনে তোলার বিশেষ প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। ২০১৪-’১৫ আর্থিক বছরেই সংস্থার লোকসান প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা। তবে সেই লোকসানের পরিমাণ ইদানীং ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছে।

শুধু উদ্ভাবনী ক্ষমতা নয়, নিজে হাতে-কলমে কাজ করে অশ্বিনী যে প্রয়োজনে বেশ কঠোর মনোভাবও দেখাতে পারেন, ঝাঁটা-কাণ্ডে তার নমুনা পেয়ে গিয়েছেন বিমানবন্দরের ইঞ্জিনিয়ারেরা। সিএমডি আসছেন বলে বিমানবন্দরের ভিতরে এয়ার ইন্ডিয়ার নতুন হ্যাঙারটিকে সাজিয়ে-গুজিয়ে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা চালানো হয়েছিল। যদিও বর্ষায় ওই হ্যাঙারের ভিতরে এমন ভাবে জল জমে যায় যে, ইঞ্জিনিয়ারদের একটি বাসের ভিতরে অস্থায়ী অফিস বানাতে হয়েছিল। জুতো ব্যাগে পুরে যেতে হচ্ছিল অফিসে। সারা দিন বারবার হাঁটুসমান জল ভেঙে কাজ করতে হয়েছে। গত বেশ কয়েক দিন বৃষ্টি ছিল না। তাই সেই হ্যাঙারকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে সিএমডি-র পরিদর্শনের জন্য প্রস্তুত করে রাখা হয়েছিল। কিন্তু শনিবার সকাল থেকেই টিপটিপ বৃষ্টি শুরু হয়। হ্যাঙারের ফুটো ছাদ থেকে টুপটাপ পড়তে শুরু করে জল। সিএমডি আসার আগেই হ্যাঙারের ভিতরে বেশ কয়েকটি জায়গায় তাই কমবেশি জল জমে ছিল। সিএমডি-র সফর নিয়ে ব্যস্ততার মধ্যে শেষ মুহূর্তে তা সরিয়ে ফেলা সম্ভব হয়নি। হ্যাঙার ঘুরে দেখতে গিয়ে সে-দিকে নজর পড়ে অশ্বিনীর। জল জমে থাকার কারণ জানতে চান তিনি। বর্ষায় কাজের সমস্যার কথা জানানো হয় তাঁকে। বলা হয়, কী পরিবেশে কাজ করতে হয় কর্মী-ইঞ্জিনিয়ারদের। অবিলম্বে সেই হ্যাঙার সারিয়ে ফেলার নির্দেশ দেন সিএমডি।

তার পরেই পরিদর্শন-নাট্য পৌঁছয় ক্লাইম্যাক্স বা তুঙ্গ মুহূর্তে। নতুন হ্যাঙারের পাশেই সংস্থার ১৪ নম্বর হ্যাঙার। একদা সেখানে বোয়িং বিমান সারানো হতো। এখন বোয়িং বিমান আর চালানো হয় না। ওই হ্যাঙার তাই কার্যত পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। এক ইঞ্জিনিয়ারের কথায়, ‘‘ওই হ্যাঙার এখন আবর্জনার স্তূপ হয়ে উঠেছে। পুরনো যন্ত্রাংশ, বিমানের অকেজো চাকা, লোহালক্কড় থেকে শুরু করে নোংরা, আবর্জনা— সবই জড়ো করা হয় সেখানে।’’

বিমানবন্দরের কর্তাদের ধারণা, নতুন হ্যাঙারের হাল দেখেই সন্দেহ হয়েছিল অশ্বিনীর। তাঁর পরিদর্শনের সময় আশেপাশেই ছিলেন সংস্থার নিচু তলার হেল্পারেরা। তাঁরা বিভিন্ন কাজে ইঞ্জিনিয়ারদের সাহায্য করেন। তাঁরাই পাশের হ্যাঙারটি ঘুরে দেখার জন্য সিএমডি-কে অনুরোধ করেন। আর সেই হ্যাঙার দেখতে গিয়েই স্তম্ভিত হয়ে যান নতুন সিএমডি। বিমানবন্দরের টেকনিক্যাল এলাকার ভিতরে সংস্থার একটি হ্যাঙারে যে এত জঞ্জাল জমে থাকতে পারে, তা তাঁর ধারণার বাইরে ছিল।

কেন এই অবস্থা? সিএমডি-র প্রশ্নের জবাবে তাঁর চার পাশে ভিড় করে থাকা সংস্থার কর্তা, ইঞ্জিনিয়ার, টেকনিশিয়ানেরা বাক্যিহারা। তাঁদের দিকে তাকিয়ে সিএমডি তখনই তাঁকে একটা ঝাঁটা এনে দিতে বলেন। কর্তারা তবু নট নড়নচড়ন। এ বার আসল অস্ত্র ছোড়েন অশ্বিনী। অপ্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কর্তাদের দিকে তাকিয়ে সিএমডি বলেন, ‘‘আরে, আমি একা নই! আমার সঙ্গে ঝাঁটা ধরতে হবে আপনাদেরও।’’

মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া কর্তাদের আর কিছুই করার ছিল না। অন্তিম অস্ত্র ছোড়েন অশ্বিনী। ঝাড়ু দিতে চাওয়া বিনয়ী সিএমডি-র কণ্ঠে ধরা পড়ল প্রশাসক সিএমডি-র কঠোরতা। বললেন, ‘‘আমি সাত দিনের মধ্যে ফিরে আসব। এসে দেখতে চাই, সব সাফ হয়ে গিয়েছে।’’

কলকাতা বিমানবন্দর সূত্রের খবর, আজ, সোমবার থেকেই ১৪ নম্বর হ্যাঙার সাফাইয়ের কাজে নামবেন ইঞ্জিনিয়ার এবং অন্য কর্মীরা।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE