মাঝেরহাট সেতু ভেঙে পড়ার পর। ছবি: পিটিআই।
যে জন আছে মাঝখানে— শব্দবন্ধটা বলতে গিয়ে থমকে গেলাম কাল বিকেলে। মাঝেরহাট ব্রিজ ভেঙে পড়ার খবর পেয়ে। আমার অগ্রজ এক কবি ওই রাস্তা দিয়েই আসছিলেন তখন। মোবাইলে তাঁকে না পেয়ে দুশ্চিন্তা বাড়ল। কিন্তু দুশ্চিন্তা কি শুধু ওই এক জনের জন্য? দুশ্চিন্তা তো সেই সব লোকগুলোর জন্য, যারা আমার শহরের নাগরিক, আমার বিশ্বের বাসিন্দা, যারা কখনও না কখনও কোনও না কোনও মাঝেরহাট, পোস্তা কিংবা শিলিগুড়ির ব্রিজের উপর বা নীচ দিয়ে হাঁটেন।
তা হলে কি এই সময়টাই সেতুভঙ্গের সময়? মানুষে-মানুষে, সমাজে-সমাজে, ভাষায়-ভাষায় যোগাযোগ অসম্ভব একটা বিশ্বসংসারেই কি আমাদের বাস এখন? হয়তোএকটু কাব্যিক হয়ে যাচ্ছে, হয়তো এই সময়টা পদলালিতময় ঝঙ্কারের নয়, কঠিন-কঠোর গদ্যের, এই সময় এক জন কবির চেয়েও দরকার সেনাবাহিনীর সেই ছেলেটিকে, যে ব্রিজের উপর শুয়ে পড়ে উঁকি মেরে দেখতে পারবে কোথাও কোনও শরীর আটকা পড়ে আছে কি না। তবু টিভির পর্দায় বা সোশ্যাল মিডিয়ায় আকচাআকচি দেখতে দেখতে মনে হয়, অন্তত কয়েক ঘণ্টার জন্য কি আমরা আমাদের ‘সব দোষ অন্যের’ মনোভাবকে বিসর্জন দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারি না? ‘এ আমার এ তোমার পাপ’ ভেবে?
কিন্তু আমাদের কি দায়? আমরা যারা এই ব্রিজ নির্মাণ বা রক্ষণাবেক্ষণের সঙ্গে কোনও ভাবে জড়িত ছিলাম না? হয়তো অপ্রিয় সত্য। তবু বলব, দায় আমাদের আছে। পোস্তায় অতগুলো মানুষ মারা যাওয়ার পরে আমরা কি সরকারের উপরে, কলকাতা কর্পোরেশনের উপরে সামান্যতম চাপ সৃষ্টিও করেছি? কলকাতা শহর এবং রাজ্যের ফ্লাইওভার ও ব্রিজগুলোর মেরামতি ও দেখভালের জন্য? কত কত ইস্যু নিয়ে কত মিছিল বেরিয়েছে রাস্তায় গত দু’বছরে? ‘আমাদের সেতুগুলোকে সুস্থ রাখুন’, এ রকম কোনও মিছিলের কথা মনে পড়ছে কারও? পড়বেও না, কারণ, বেরোয়নি তো! প্রত্যেক দিন নিজেরা আরও একটু ভাল থাকবার চেষ্টায় আমরা সহজেই ভুলে গেছি যে, আমাদের বেঁচে থাকাটাই একটা সেতুর মতো। যেখানে এক প্রান্ত আর এক প্রান্তের সঙ্গে, এক মানুষ আরও অনেক মানুষের সঙ্গে যুক্ত। যেখানে অংশ ভেঙে পড়লে সমগ্রটাই বেসামাল হয়ে যায়।
চলছে উদ্ধারকাজ। ছবি: পিটিআই।
যাঁরা এই সেতুর রক্ষণাবেক্ষণের সঙ্গে যুক্ত, এর পরও কি তাদের কোনও প্রশ্নের মুখে দাঁড়াতে হবে? পোস্তার ব্রিজ ভেঙে পড়ার পরে কাউকে কি প্রশ্নের মুখে দাঁড়াতে হয়েছিল? যে সমাজ একটি মৃত্যুর পর ডাক্তারের দিকে ছুটে যায় আক্রোশে, অনেক মৃত্যুর পরেও সে সমাজ কেন চুপ করে থাকে, কিছুতেই বোধগম্য হয় না। তবে কি বড় কোনও ঘটনা বা দুর্ঘটনার মুখোমুখি হওয়ার সাহস হারিয়ে ফেলেছি আমরা? হারিয়ে ফেলেছি বড় প্রশ্ন করার স্পর্ধা? কেন দায়বদ্ধতা শব্দটাই উধাও হয়ে যাচ্ছে আমাদের অভিধান থেকে? আজ, শিক্ষক দিবসে হয়তো বা নতুন করে একটা শিক্ষা নিতে হবে আমাদের। নিজের কাজটুকু সঠিক ভাবে করার শিক্ষা। শিক্ষক-ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-রাজনীতিবিদ, প্রত্যেককেই নিতে হবে। আমরা যারা দ্বিতীয় হুগলি সেতুর সামনে দেড় ঘণ্টা চুপচাপ গাড়িতে বসে থাকি। কারণ, সামনের প্রত্যেকটা লরি পুলিশকে ঘুষ দেবে, তার পর এগোবার স্বাধীনতা পাবে, তারা যদি এক দিন অনেকে মিলে রাস্তায় নেমে ঘটনাটার প্রতিবাদ করে, তা হলে পরদিন থেকে ঘুষ নেওয়ার পাশাপাশি ওভারলোডেড লরিরও চলাচল বন্ধ হয়ে যাবে। আমরা তা করব কি? মাঝেরহাট ব্রিজ কী ভাবে মেরামত হচ্ছে, কোন কন্ট্রাক্টর কী মানের কাঁচা মাল দিয়ে আবার গেঁথে তুলছে তাকে, মিডিয়া, সোশ্যাল মিডিয়া এবং রাস্তায় তাই নিয়ে একটু চাপ বজায় রাখব কি আমরা? যদি রাখতে পারি, তা হলে আগামী দিনে সৌমেন বাগের মতো কোনও টগবগে যুবককে মুছে যেতে হবে না অকালে। যদি না পারি, তা হলে কাল ওর জায়গায় আমরাও থাকতে পারি। কারণ, সকল জখম বাঁচিয়ে চলার ভাগ্য তো কেউ করে আসিনি আমরা, তাই না? ‘এমনটা তো হয়েই থাকে’ বলে রাজনীতি আর সিস্টেমকে গাল দিয়ে উইকএন্ড ট্রাভেলের ছবি আপলোড করতে বসলে আবারও কোনও না কোনও ব্রিজ বা ফ্লাইওভার ডাউনলোড হয়ে নেমে আসবে! আজ তাই একটু সতর্ক থাকার শপথ নেওয়ার দিন। কারণ, আমাদের শহরের সেতুগুলো কাঠবেড়ালিরা বানায় না, মানুষ বানায়। আর মানুষের গাফিলতি একমাত্র মানুষেরাই ঠিক করতে পারে!
আরও পড়ুন: নজরদারির অভাবেই এত বড় দুর্ঘটনা, মত বিশেষজ্ঞের
আরও পড়ুন: বেঁচে আছে তো ওঁরা? ধ্বংসস্তূপে কান পেতে মুর্শিদাবাদের দুই পরিবার
(শহরের প্রতি মুহূর্তের সেরা বাংলা খবর জানতে পড়ুন আমাদের কলকাতা বিভাগ।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy