ঘটনার দিন কুটা সদস্যদের ঘিরে তালি বাজিয়ে সৌরভ অধিকারী ও অন্য টিএমসিপি সমর্থকদের আস্ফালন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট হলে।
কখনও ছাত্রদের হাতে অধ্যক্ষের হেনস্থা। কখনও কলেজের স্টাফরুমের বাইরে শিক্ষককে প্রহার। কখনও বা শিক্ষিকাকে রেপ করিয়ে দেওয়ার হুমকি। জেলায় জেলায় শিক্ষকদের গায়ে হাত তোলার ঘটনা বারবারই সামনে আসছিল। গত সপ্তাহেই আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের ঘরে ভাঙচুর চলেছিল। বাদ রইল না কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ও।
বুধবার ভরদুপুরে উপাচার্যের সামনেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ স্ট্রিট ক্যাম্পাসে শিক্ষকদের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে এক দল হামলাকারী। তারা শাসক দলের ছাত্র সংগঠনের কর্মী-সমর্থক বলেই অভিযোগ। অবাধ লাথি-ঘুষিতে এক শিক্ষকের মুখ ফুলে যায়। তাঁর জামাকাপড় ছিঁড়ে দেওয়া হয়। পুরো ঘটনাটাই ঘটে উপাচার্য এবং সহ-উপাচার্যের চোখের সামনে। হেনস্থার হাত থেকে বাঁচেননি তাঁরাও। সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিরা সাক্ষী থাকেন এ সব কিছুরই। অথচ মারমুখী টিএমসিপি সমর্থকদের রোষ থেকে বাঁচার আশায় উপাচার্যকেই ঢাল করেছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সংগঠন কুটা-র এক দল সমর্থক। লাভ হয়নি।
এতেও শেষ নয়। আহত এক শিক্ষককে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময়েও এক দল টিএমসিপি সমর্থক বাধা দেয় বলে অভিযোগ। এর পরে সেনেট রুমের মধ্যে বসে থাকা শিক্ষকদের ঘিরে হাততালি দিয়ে স্লোগান দিতে থাকে টিএমসিপি সমর্থকেরা। রাজ্যের বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের মেয়ে, শারীরবিদ্যার শিক্ষক রোশেনারা মিশ্রের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময়ে ওই ছাত্রদের কেউ কেউ অশালীন মন্তব্যও করে বলে অভিযোগ। শেষমেষ রোশেনারাকে আড়াল করতে তাঁর সামনে গিয়ে বসেন এক পুরুষ সহকর্মী। উপাচার্য তখন বসেছিলেন নিজের ঘরে। নিরাপত্তাহীনতায় ভোগা শিক্ষকদের পাশে এসে দাঁড়াতে দেখা যায়নি কর্তৃপক্ষ স্থানীয় কাউকেই।
গোটা ঘটনা নিয়ে সুরঞ্জনবাবু পরে শুধু বলেন, ‘‘একটা উত্তেজনা হয়েছিল। পরে ঠিক হয়ে যায়। এর বেশি কিছু বলতে পারব না।’’ তাঁকে বলা হয়, ‘‘টিএমসিপি-র লোকেরা আপনাকেও ধাক্কা দিল তো!’’ এ ব্যাপারেও কোনও মন্তব্য করতে চাননি সুরঞ্জনবাবু। কয়েক দিনের মধ্যেই তাঁর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে যোগ দেওয়ার কথা। শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় পরে জানান, ‘‘উপাচার্য দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন, তাঁর গায়ে হাত পড়েনি। তবে শুনেছি, ছাত্রদের কারও কারও গায়ে হাত পড়েছে।’’
টিএমসিপি নেতৃত্ব শিক্ষকদের উপরে এই হামলার নিন্দা করা দূরে থাক, শিক্ষকেরাই ছাত্রদের শান্তিপূর্ণ অবস্থানের উপরে হামলা চালিয়েছেন বলে অভিযোগ করে কুটা-র উপরে যাবতীয় দোষ চাপিয়ে দিয়েছেন। জোড়াসাঁকো থানায় গিয়ে শিক্ষকদের বিরুদ্ধে তাঁরা নিগ্রহের অভিযোগ দায়ের করেছেন। তবে কুটা’র তরফে জানানো হয়েছে, তাঁরা পুলিশের কাছে কোনও অভিযোগ দায়ের করবেন না। তবে বিরোধী ছাত্র সংগঠন এসএফআই দোষীদের শাস্তি চেয়ে আজ, বৃহস্পতিবার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ক্যাম্পাসে ছাত্র ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে। বিরোধীদের অভিযোগ, রাজ্যের শিক্ষাঙ্গনগুলিকে পুরোপুরি রাজনৈতিক লড়াইয়ের মঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করছে শাসক দল। আগামী বছর বিধানসভা ভোটের দিকে তাকিয়ে গা-জোয়ারি ক্রমশ বাড়ছে। মুখ্যমন্ত্রী অনেকটা যে সুরে বলে দিয়েছিলেন, পুরসভাগুলিতে বিরোধীদের কোনও ভাবে মাথা তুলতে দেওয়া হবে না, শিক্ষাক্ষেত্রেও সেই ‘লাইন’ই নেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ। রাজ্যের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে যেখানেই কোনও রকম বিরোধী স্বর দেখা দিচ্ছে, সেখানেই তৃণমূল তার কণ্ঠরোধ করতে হিংসার আশ্রয় নিচ্ছে।
শিক্ষামন্ত্রী সার্বিক ভাবে এই ঘটনা নিয়ে কী বলছেন? পার্থবাবু টিএমসিপি’র হামলার কোনও নিন্দা সরাসরি করেননি। তিনি বলেন, ‘‘উপাচার্যকে সমস্ত ঘটনার বিবরণ দিয়ে উচ্চশিক্ষা দফতরের প্রিন্সিপ্যাল সেক্রেটারি বিবেক কুমারের কাছে রিপোর্ট দিতে বলেছি।’’ এই ধরনের ঘটনা যাতে আগামী দিনে না ঘটে, সে জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট সকলের সঙ্গে তিনি কথা বলবেন। তাঁর কথায়, ‘‘অধ্যাপকদের বলেছি ছাত্রসুলভ আচরণ করে লাভ নেই। কোনও অভিযোগ থাকলে সিন্ডিকেটকে জানাক। আমি তো বলছি, সকলের সঙ্গেই কথা বলব। উপাচার্যকে আটকে রাখা হচ্ছে, এটা ঠিক নয়।’’ কিন্তু এ দিনের শিক্ষক নিগ্রহে দোষীদের শাস্তি হবে না? ঘটনার মূল অভিযুক্ত হিসেবে তো উঠে এসেছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক সৌরভ অধিকারীর নাম! শিক্ষামন্ত্রীর জবাব, ‘‘আমরা চাই দোষীরা শাস্তি পাক। কিন্তু দুর্নীতির জন্য যে অফিসারকে সাসপেন্ড করা হয়েছে, শিক্ষকেরা কেন তাঁর পিছনে গিয়ে দাঁড়াচ্ছেন তা বুঝতে পারছি না।’’ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপকদের ধর্নার ফলেই অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে ইঙ্গিত দিয়ে পার্থবাবুর বক্তব্য, ‘‘এই অচলাবস্থা ঘিরে সমস্যা মেটানোর জন্য কোনও কোনও সিপিএম নেতা আমাকে ফোন করে আর্জি জানিয়েছেন।’’ রাজ্য বিজেপি সহ-সভাপতি সুভাষ সরকার পার্থবাবুর এই প্রতিক্রিয়া প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্যের প্রতি শিক্ষামন্ত্রী যদি আর একটু সংবেদনশীল হতেন, তা হলে ঘটনাটিকে এত লঘু করে দেখতে পারতেন না।’’
ঘটনার সূত্রপাত কী ভাবে হল? বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিনান্স অফিসার হরিসাধন ঘোষকে সাসপেন্ড করার প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের সংগঠন (কুটা) এ দিন উপাচার্যের ঘরের সামনে একটি অবস্থান বিক্ষোভের কর্মসূচি নিয়েছিল। কর্মসূচি শুরু হওয়ার কথা ছিল বেলা ১২টায়। অভিযোগ, কুটা-র সদস্যেরা এসে দেখেন, ওই জায়গায় বসে আছে টিএমসিপি সমর্থকদের সঙ্গে কয়েক জন বহিরাগতও। কুটা-র প্রতিনিধিরা তাদের উঠে যেতে বলেন। দু’পক্ষের মধ্যে শুরু হয় বাগবিতন্ডা। একটু পরে উপাচার্য সুরঞ্জন দাস এলে কুটা-র প্রতিনিধিরা তাঁর সঙ্গেই অবস্থান-স্থলে প্রবেশ করেন। টিএমসিপি সদস্যরা তাঁদের বাধা দেন। এই সময়েই কয়েক জন কুটা-র সদস্যদের গায়ে হাত তোলে বলে অভিযোগ। এর পর সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিদের চোখের সামনেই কুটা-র সাধারণ সম্পাদক লাইব্রেরি সায়েন্সের প্রধান দিব্যেন্দু পালকে ঘিরে ধরা হয়। ভিড়ের মধ্যে ধস্তাধস্তি শুরু হয়ে যায়। তার মধ্যে পড়ে যান উপাচার্য এবং সহ উপাচার্যও। উপাচার্য টিএমসিপি সদস্যদের শান্ত হওয়ার কথা বলতে থাকেন। খানিক পরে গোলমাল একটু থামলে দেখা যায়, দিব্যেন্দুবাবুর জামা ছিঁড়ে গিয়েছে। নাক ও কাঁধের একটি অংশ ফুলে গিয়েছে। দিব্যেন্দুবাবু বলেন, ‘‘ওরা আমায় মাটিতে ফেলে এলোপাথাড়ি লাথি মেরেছে। যে যে ভাবে পেরেছে কিল, ঘুঁষি মেরেছে।’’
এর পরেই ঘটনাস্থলে আসেন টিএমসিপি-র রাজ্য সভাপতি অশোক রুদ্র। তিনি দাবি করেন, ‘‘সিপিএমের লোকজন বিশ্ববিদ্যালয়ে অশান্তি পরিবেশ তৈরি করছিলেন। টিএমসিপি তার প্রতিবাদ করে। টিএমসিপি-র দু’জন সদস্য আহত হয়েছেন।’’ কুটা-র সদস্যরা তত ক্ষণে সেনেট হলের ভিতরে অবস্থানে বসে পড়েছেন। তখন সেনেট হলের মধ্যেই ঘুরে ঘুরে টিএমসিপি-র ছাত্ররা হাততালি দিয়ে স্লোগান দিতে থাকেন। এর মধ্যেই সেনেট হলে আসেন উপাচার্য। পরিস্থিতি দেখে তিনি হল থেকে বেরিয়ে যান।
বিকেলে সেনেট হলেই কুটা-র তরফে সাংবাদিক সম্মেলন করা হয়। সেখানে কুটা’র নেতা অধ্যাপক শ্যামল চক্রবর্তী জানান, ‘‘ফিনান্স অফিসার হরিসাধন ঘোষের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ নিয়েই কর্তৃপক্ষের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, ঠিক কী কারণে তাঁকে সাসপেন্ড করা হল। উপাচার্য জবাব না দেওয়ায় আন্দোলনে নামতে বাধ্য হই। তার মধ্যেই এই পরিকল্পিত হামলা।’’ শিক্ষকরা নিগৃহীত হওয়া সত্ত্বেও শিক্ষামন্ত্রীকে পাশে না পাওয়ায় ওয়েবকুটা পার্থবাবুর ইস্তফা দাবি করেছে। উত্তরে পার্থবাবুর কটাক্ষ, ‘‘এটা তো ওঁদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে!’’
বিরোধীরা অবশ্য পাল্টা অভিযোগ করছেন, শিক্ষাঙ্গনে হামলা, শিক্ষকদের গায়ে হাত তোলাটাই বরং অভ্যাসে পরিণত করেছে শাসক দলের ছাত্র সংগঠন। অনেকেই মনে করিয়ে দিচ্ছেন, গত বছর ৯ জুলাইও ক্যাম্পাসে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে অবস্থানের ডাক দিয়েছিল কুটা। সেই সময়ে তৎকালীন টিএমসিপি সভাপতি শঙ্কুদেব পন্ডার নেতৃত্বে ঝান্ডা হাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে মিছিল করে ঢুকে পড়ে এক দল টিএমসিপি সমর্থক। তারা সে দিন সিন্ডিকেট রুমের বাইরে এ দিনের মতোই হাততালি দিয়ে স্লোগান দিয়েছিল আর সেদিনও নিজের ঘরে বসেছিলেন উপাচার্য।
গত বছর ওই ঘটনার কিছু দিন পরে শঙ্কুদেবকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল টিএমসিপি-র নেতৃত্ব থেকে। নতুন সভাপতি হয়েছিলেন অশোক রুদ্র। তবে নেতৃত্ব বদলালেও টিএমসিপি-র কাজকর্মে যে কোনও পরিবর্তন হয়নি, বুধবারের ঘটনাই তা প্রমাণ করে দিল। এ দিনের ঘটনা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক সব অপ্রীতিকর ঘটনাকে ছাড়িয়ে গেল বলে শিক্ষা জগতের বড় অংশের মত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy