সুমন বল্লভ
উত্তুরে এক সংস্কৃতি আর ঘরোয়া পরিবেশ ঘিরে রেখেছে আমাদের পাড়াটাকে। মানিকতলা অঞ্চলে আমাদের সেই পাড়ার বলদেও পাড়া। নামটা একটু অবাক করা।
এ পাড়ার নামকরণ নিয়ে শোনা যায় দু’টি মত। এখানে বলদেও সিংহ নামক এক প্রতাপশালী ও ধনী ব্যক্তি বাস করতেন। পরে তাঁর নামানুসারে এই পাড়ার নামকরণ হয়। অপর মতানুসারে কাছেই যে খালটি রয়েছে এক সময়ে সেখানে পণ্যবাহী নৌকা যাতায়াত করত। কাছেই সেই সব পণ্যদ্রব্য নামিয়ে বলদের গাড়ি করে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া হত। সে জন্য এ অঞ্চলে বহু সংখ্যক বলদের গাড়ির ভিড় থাকত বলে অনেকে এই পাড়াকে ‘বদলপাড়া’ বলতেন। পরে ‘বলদপাড়া’ নামটা বলদেও পাড়া হয়।
এ পাড়ার স্বতন্ত্র চরিত্র সম্পর্কের অটুট বন্ধন। যা সুখে-দুঃখে ধরে রেখেছে সকলকে। এই পাড়ার আবহাওয়া শিখিয়েছে একে অপরকে ভালবাসতে, জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতে কাঁধ মিলিয়ে চলতে।
বিবেকানন্দ রোড থেকে শুরু হয়ে পাড়াটা মিশেছে রাজা দীনেন্দ্র স্ট্রিটে। আজকের পাড়াটা এক কথায় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। নতুন, পুরনো বাড়ি আর কিছু বহুতল যেন অতীত আর বর্তমানের ভারসাম্য বজায় রেখেছে।
পাড়ায় মিলছে উন্নত নাগরিক পরিষেবা। নিয়ম করে হয় রাস্তা পরিষ্কার আর জঞ্জাল সাফাই। পাড়াটাকে আরও পরিচ্ছন্ন রাখতে বসেছে গার্বেজ বিনও। কিন্তু কিছু মানুষের নাগরিক সচেতনতার অভাব থাকায় মাঝে মধ্যেই পাড়াটা অপরিচ্ছন্ন হয়ে ওঠে। এর সঙ্গে
আছে সারমেয়দের উৎপাতও। যে কারণে রাতে পাড়ার পরিচ্ছন্নতা কমে যায়।
অনেক পরিবর্তন এলেও হারায়নি এ পাড়ার আড্ডা। থেকে যাওয়া দু’-একটা রকে প্রতি রবিবার বসে জমাটি আড্ডা। আর আড্ডাটা আছে বলেই সকলে সকলকে চেনেন, খোঁজখবরও রাখেন। সারা সপ্তাহের ক্লান্তি কাটাতে রবিবারের আড্ডাটা ‘মাস্ট’। এমনকী কিছু মানুষ যাঁরা এ পাড়া ছেড়ে অন্যত্র চলে গিয়েছেন তাঁদের অনেকেই আড্ডার টানে মাঝে মাঝে এ পাড়ায় ফিরে আসেন। গল্প-গুজবের পাশাপাশি মাঝে মধ্যেই বেঁধে যায় ঘটি-বাঙাল কিংবা মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল নিয়ে বেজায় তর্ক-বিতর্ক। মাঝে মাঝে উপলব্ধি করি এরই মাঝে লুকিয়ে আছে জীবনের ভাল থাকার মন্ত্রটা। সে কারণেই বলি আড্ডাটা ভাল থাকার ‘অক্সিজেন’!
বাসিন্দাদের মধ্যে রাজনৈতিক মতাদর্শে পার্থক্য থাকলেও মানুষে মানুষে সম্পর্কের ক্ষেত্রে তা ব্যবধান তৈরি করে না।
এ পাড়ার আর এক আকর্ষণ পঁচাত্তর বছরের পুরনো গ্রন্থশ্রী পাঠাগার। সময়ের প্রভাবে পাঠক সংখ্যা কমলেও আজকের হাজারো বিনোদনের ভিড়ে স্বকীয়তা বজায় রেখেছে এই পাঠাগার।
পাড়ার নানা কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে আছে মানিকতলা আঞ্চলিক সমিতি ক্লাবটি। এরই উদ্যোগে আগে মঞ্চস্থ হত বিভিন্ন নাটক, আয়োজন করা হত সঙ্গীতানুষ্ঠানের। কে না এসেছেন তাতে? মান্না দে, শ্যামল মিত্র, থেকে ঊষা উত্থুপ। এখনও হয় সঙ্গীত প্রতিযোগিতা, ছোটদের বসে আঁকো প্রতিযোগিতা ইত্যাদি।
এ পাড়ার যুব সম্প্রদায় পাড়ার নানা কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত। যে কোনও প্রয়োজনে তাঁদের পাশে পাওয়া যায়। বিপদে আপদে বা কোনও সমস্যায় আত্মীয়স্বজন পৌঁছনোর আগে পাড়ার ছেলেরা ঝাঁপিয়ে পড়ে সাহায্য করতে। তেমনই কর্মসূত্রে সম্প্রদায় যাঁরা বাইরে থাকেন তাঁদের অভিভাবকদেরও ভরসা পাড়ার এই ছেলেরা।
সময়ের প্রভাবে বেশ কিছু বাড়ির হাতবদল হয়ে তৈরি হয়েছে বহুতল। এসেছেন কত নতুন পরিবার। তাঁদের মধ্যে যাঁরা মিশুকে তাঁরা পুরনো বাসিন্দাদের সঙ্গে মিলেমিশে গিয়েছেন, অন্যরা নিজেদের মতোই থাকতে পছন্দ করেন।
আজও এ পাড়ায় সাড়ম্বরে অনুষ্ঠিত হয় দুর্গা, কালী ও জগদ্ধাত্রী পুজো। আজও সেখানে অটুট রয়েছে পাত পেড়ে ভোগ খাওয়া কিংবা পুষ্পাঞ্জলির আনন্দ। এখনও বজায় আছে খেলাধুলোর পরিবেশ। ছুটির দিনে ছোটদের ক্যারম, ফুটবল, ক্রিকেট খেলতে দেখা যায়। মাঝে মাঝে হয় ক্রীড়া প্রতিযোগিতাও। এক কালের শান্ত, নিরিবিলি পাড়াটা আজ অটো আর যানবাহনের চলাচলে সব সময়ে শব্দে ভরা। সময়ের সঙ্গে হারিয়েছে বেশির ভাগ ফেরিওয়ালার ডাকও।
এমনিতে পার্কিং সমস্যা না থাকলেও দিনে কিছু মানুষ গাড়ি পার্ক করে দীর্ঘ সময়ের জন্য অন্যত্র যান। তখন বাড়ির সামনে নিজেদের গাড়ি রাখারই জায়গা থাকে না। কাছাকাছির মধ্যেই রয়েছে ভোজন রসিকদের সেরা ঠিকানা মানিকতলা বাজার।
এমন একটা পাড়া জড়িয়ে আছে জীবনের পরতে পরতে। তাকে ছেড়ে অন্যত্র যাওয়ার কথা ভাবতেই পারি না। আজও এখানে হাত বাড়ালেই আছে বন্ধু।
লেখক আইনজীবী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy