Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
বাসের দেখা নাই রে...

সন্ধ্যা নামতেই ঘরে ফেরে বাসেরাও

রাত যত বাড়ছে, ততই যেন অমাবস্যার চাঁদ হয়ে উঠছে বাস। মালিকেরা বলছেন, এই ভাড়ায় বাস চালিয়ে লাভ হচ্ছে না। দিনের ব্যস্ত সময়ে তবু টাকা ওঠে। রাতে গাঁটের কড়ি খরচ করে বাস চালাতে রাজি নন কেউই। ভাড়া বাড়াতে নারাজ সরকার। বাড়েনি সরকারি বাসও। তাই রাতের রাজপথে নিত্য হয়রান হচ্ছেন যাত্রীরা। শহরের কয়েকটি মোড়ে সে হয়রানির চিত্র দেখে এলেন আনন্দবাজারের প্রতিনিধিরা। পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্রের বক্তব্য, “আমরাও লক্ষ করেছি, রাতে বাস চলছে না। এর সমাধানে বুধবারই নিগমগুলির সঙ্গে বৈঠকে বসছি।” উল্টোডাঙার মোড়। রাত সাড়ে ৯টা। কেষ্টপুর যাওয়ার জন্য ৪৫ মিনিট ধরে অপেক্ষা করছিলেন বছর চল্লিশের দেবযানী রায়। অথচ বাসের দেখা মিলছে না। শেষে সামনে একটি ট্যাক্সিকে পেয়ে দাঁড় করালেন। জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কেষ্টপুর যাবেন?’ চালক বললেন, ‘১৫০ টাকা লাগবে।’ শেষ পর্যন্ত ১০০ টাকায় রফা হল। ট্যাক্সিতে উঠতে উঠতে দেবযানীদেবী বললেন, “বাসে পাঁচ টাকা ভাড়া নেয়। কিন্তু কোথায় বাস!”

রুবি মোড়: রাত ১০টা

রুবি মোড়: রাত ১০টা

কলকাতা শেষ আপডেট: ১২ মার্চ ২০১৪ ০২:২৪
Share: Save:

উল্টোডাঙার মোড়। রাত সাড়ে ৯টা। কেষ্টপুর যাওয়ার জন্য ৪৫ মিনিট ধরে অপেক্ষা করছিলেন বছর চল্লিশের দেবযানী রায়। অথচ বাসের দেখা মিলছে না। শেষে সামনে একটি ট্যাক্সিকে পেয়ে দাঁড় করালেন। জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কেষ্টপুর যাবেন?’ চালক বললেন, ‘১৫০ টাকা লাগবে।’ শেষ পর্যন্ত ১০০ টাকায় রফা হল। ট্যাক্সিতে উঠতে উঠতে দেবযানীদেবী বললেন, “বাসে পাঁচ টাকা ভাড়া নেয়। কিন্তু কোথায় বাস!”

শুধু দেবযানীদেবীই নন, উল্টোডাঙা মোড়ে ওই সময়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে কয়েকশো মানুষ। একটি বাস এলেই ঝাঁপিয়ে পড়ছেন সকলে। সল্টলেকের বাসিন্দা মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য বলেন, “৯টা থেকে দাঁড়িয়ে আছি। ২০৬ রুটের একটিও বাস নেই।” হাওড়া যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলেন টিকিয়াপাড়ার বাসিন্দা সুমন্ত ভৌমিক। তিনি বলেন, “আধ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে দাঁড়িয়ে আছি। কোনও বাস নেই।” টালিগঞ্জের বাসিন্দা সজল দাস বলেন, “আমি রোজ রাতে উল্টোডাঙা থেকে টালিগঞ্জে ফিরি। ঘণ্টায় একটি করে বাস পাই। বাস না পেলে ট্যাক্সিই ভরসা। সুযোগ বুঝে তাঁরাও গলা কাটে। কোনও কোনও দিন ২০০ টাকা খরচ করেও বাড়ি ফিরতে হয়।”

শুধু ট্যাক্সিই নয়, বাস না থাকায় অটো চালকদেরও পোয়াবারো। উল্টোডাঙা থেকে কেষ্টপুরের ভাড়া ২৫ টাকা। ৯টার পরে তা অনেক সময়েই ৫০ টাকায় গিয়ে দাঁড়ায়।

শ্যামবাজার মোড়। রাত সাড়ে ৯টা। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে যাচ্ছে শাট্ল ট্যাক্সির ভাড়া। শ্যামবাজারে ভূপেন বসু অ্যাভিনিউয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন জনা পাঁচেক যাত্রী। গন্তব্য সোদপুর।

শাটল্ ট্যাক্সি ভাড়া হাঁকল মাথাপিছু ৫০ টাকা। যাত্রীরা তাতেই রাজি। তাঁদের এক জন সোদপুরের বাসিন্দা রঞ্জিত সাধুখাঁ বলেন, “আর কতক্ষণ দাঁড়াব বলুন! আগে ৩-৪ মিনিট অন্তর বাস পাওয়া যেত। এখন ঠায় কুড়ি মিনিট দাঁড়িয়ে। রোজ এ ভাবেই ফিরতে হচ্ছে।”

শ্যামবাজার মোড়: রাত ৯-৩০

উল্টোডাঙার মোড়: রাত ৯-৩০

রাত ৯টা ৫০। ফের এসে দাঁড়াল একটি শাট্ল ট্যাক্সি। ফের ছুটে এলেন কয়েক জন। এ বার কিন্তু আগের চেয়ে কমে গেল ভাড়া। একই সঙ্গে কমে গেল রাস্তাও। ট্যাক্সিটি যাবে ডানলপ পর্যন্ত। ভাড়া মাথাপিছু ৩০ টাকা। ব্যারাকপুরের বাসিন্দা অঞ্জলি পাল বলেন, “ডানলপ পর্যন্ত তো যাই। তার পরে কী হবে ভগবানই জানেন।” আর এক যাত্রী সোদপুর কাঠগোলার বাসিন্দা তাপস রায় বলেন, “রাতে রাস্তা থেকে বাস কার্যত উধাও হয়ে গিয়েছে। এর চেয়ে বাসমালিকদের দাবি মেনে ভাড়া কিছুটা বাড়িয়ে দিলেই ভাল হত। এখন তো পাঁচ-ছ’গুণ বেশি টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে।”

বিটি রোডে সরস্বতী প্রেসে নাইট ডিউটিতে যাবেন বলে দাঁড়িয়ে ছিলেন টালিগঞ্জের অভিজিৎ দত্ত। তিনি বলেন, “আধ ঘণ্টা ধরে দাঁড়িয়ে আছি বাস ধরব বলে। কোনওদিন ঠিক সময়ে পৌঁছতে পারি না।”

ধর্মতলার ডোরিনা ক্রসিং। রাত ৯টা। হঠাৎ ‘এসেছে, এসেছে’ বলে চিৎকার। ছুটতে শুরু করলেন একদল মেয়ে-পুরুষ। প্রত্যেকেই অপেক্ষা করছিলেন বাসের জন্য। প্রায় পঁয়ত্রিশ মিনিট পরে এসেছে হাওড়া-মেটিয়াব্রুজ রুটের একটি বাস। যাত্রীদের এক জন বললেন, “এই বাসটি না ধরতে পারলে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে আবার এক ঘণ্টা।” তাই শুনে ভিড়ে ঠাসা বাসের পাদানিতে ঝুলে পড়লেন জনা পাঁচেক যাত্রী।

এসপ্ল্যানেড ইস্ট। রাত সাড়ে ৯টা। চৌরঙ্গি থেকে ডেকার্স লেনের মুখ পর্যন্ত সার দিয়ে দাঁড়িয়ে যাত্রীরা। বাস আসছে একটার পর একটা। কিন্তু কোনও বাসই থামছে না। যাত্রীরাও এগিয়ে এলে কন্ডাকটর বলছে, “বাস যাবে না। উঠবেন না।” প্রায় চল্লিশ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকার পরে বাবুঘাট-বিরাটি রুটের একটি বাস এসে থামল। যাত্রীরা হুড়মুড়িয়ে উঠলেন।

চৌরঙ্গি এবং লেনিন সরণির মুখে প্রায় ৪০ মিনিট দাঁড়িয়ে ছিলেন গল্ফগ্রিনের বাসিন্দা তমাল রায়। তিনি বলেন, “গল্ফগ্রিন-হাওড়া রুটের বাস এক ঘণ্টার আগে আসে না। রোজই এই দুর্ভোগে পড়তে হয় আমাদের।”

গড়িয়াহাট মোড়। রাত ৯টা। ভিড়ঠাসা একটি মিনিবাসের খালাসি ‘রুবি মোড়-রুবি মোড়’ হাঁকতেই, ছুটে গেলেন কয়েক জন যাত্রী। কিন্তু সকলে উঠতে পারলেন না। যাঁরা উঠতে পারলেন না, তাঁরা বিরস মুখে ফের গিয়ে দাঁড়ালেন মোড়ে।

গড়িয়াহাট বাসস্ট্যান্ডে প্রায় আধ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে রয়েছেন কালিকাপুরের বাসিন্দা পারমিতা সরকার। তিনি বলেন “রোজ একই সমস্যা। বাস পাওয়া যায় না। অটো অর্ধেক রাস্তা যাবে। বাধ্য হয়ে ট্যাক্সি করতে হচ্ছে। তাঁরা মিটারের উপরে ২০ টাকা বেশি চাইবে।” সপ্তাহে তিন দিন মেয়েকে টিউশন পড়াতে ফার্ন রোডে আসেন যাদবপুরের বাসিন্দা চন্দ্রিমা দে। তাঁর কথায়, “বাড়িতে আর একটা ছোট বাচ্চা রয়েছে। তাড়াতাড়ি ফেরা দরকার। বাস না পেয়ে প্রায় দিনই ট্যাক্সিতে যেতে হয়। টাকায় কুলোয় না। কেউ দেখার নেই!”

রুবি মোড়। রাত ১০টা। একদম ফাঁকা একটি সরকারি বাস দেখে এগিয়ে গিয়েছিলেন জনা দশেক যাত্রী। কিন্তু বাস থামল না। ধুলো উড়িয়ে চলে গেল। দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে টালিগঞ্জের বাসিন্দা প্রদীপ সামন্ত বললেন, “সন্ধ্যার পর যেমন পাখিরা ঘরে ফিরে যায়, এ রাজ্যর সরকারি-বেসরকারি বাসও ঠিক তেমনই। রাতে চলাফেরা করা এখন বন্ধ করে দেওয়াই উচিত।” রুবি মোড়ে দাঁড়িয়ে জনা পঁচিশেক যাত্রী। সুযোগ বুঝে ট্যাক্সি চালকেরা মর্জিমতো ভাড়া চাইছেন। গড়িয়ার বাসিন্দা তরুণ সরকার বলেন, “মিটারে যা উঠবে, তার চেয়ে ২০ টাকা বেশি ধরে দিতে হচ্ছে। পুলিশকে জানিয়েও কোনও লাভ নেই।”

রাত-পথে বাসের হাল এমন কেন, তা জানতে যোগাযোগ করা হয়েছিল পরিবহণ দফতর, জয়েন্ট কাউন্সিল অব বাস সিন্ডিকেটস এবং মিনিবাস অপারেটর্স কো-অর্ডিনেশন কমিটির সঙ্গে। তাদের থেকে জানা গিয়েছে, নিয়ম করেই দিনের বেলার তুলনায় অনেকটাই কম সংখ্যক বাস নামানো হচ্ছে সন্ধ্যার পরে। যেমন অফিসের ব্যস্ত সময়ে রাস্তায় ৯০০টি মিনিবাস চললেও সন্ধ্যের পরে মিনিবাসের সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ৫০০। অন্য দিকে, সারা দিন যে ক’টি বেসরকারি বাস পথে নামে তার ঠিক অর্ধেক সংখ্যক বাস চলে রাতে। সূত্রের খবর, শহরে অফিসের সময়ে ৫০০০ বেসরকারি বাস নামানো হয়। রাতে সে বাসের সংখ্যা মাত্র ২৫০০। একই পথ নিয়েছে সরকারি বাসও। ব্যস্ত সময়ে ৭৫০টি বাস নামানো হয়, কিন্তু রাতে চলাচলকারী বাসের সংখ্যা মাত্র ৪২০।

(প্রতিবেদন: সুপ্রিয় তরফদার, অভীক বন্দ্যোপাধ্যায়, দেবাশিস দাস, শুভাশিস ঘটক। ছবি: প্রদীপ আদক, স্বাতী চক্রবর্তী, শশাঙ্ক মণ্ডল)

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE