তিন এজলাস ঘুরে মামলা এসেছিল ব্যাঙ্কশাল কোর্টে। সারদা মামলায় সেখানেও জামিন পেলেন না মন্ত্রী মদন মিত্র। তিনি কতটা প্রভাবশালী এবং জামিন পেলে তদন্তের কাজে কতটা প্রভাব খাটাতে পারেন, দু’দফায় আড়াই ঘণ্টা ধরে মন্ত্রীর আইনজীবীর সঙ্গে লড়াই করে সেটাই প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন সিবিআইয়ের কৌঁসুলি। রায় ঘোষণার সময় তদন্তকারী সংস্থার যুক্তিকে মান্যতা দিলেন বিচারক।
ফলে ১৬৫ দিন ধরে বন্দিজীবন কাটানো মদনবাবুর কাছে জামিন আপাতত অধরাই রইল।
আলিপুর জাজেস কোর্ট, কলকাতা হাইকোর্ট, ফের আলিপুর হয়ে মদনের জামিনের মামলাটি এসেছিল ব্যাঙ্কশাল কোর্টে। আদালত এ দিন কী রায় দেয়, তা নিয়ে সিবিআই থেকে মদনঘনিষ্ঠ, কৌতূহলের অন্ত ছিল না সব মহলেই। সারদা মামলায় এর মধ্যেই জামিন পেয়েছেন রাজ্যের প্রাক্তন পুলিশকর্তা রজত মজুমদার, প্রাক্তন তৃণমূল সাংসদ সৃঞ্জয় বসু, ইস্টবেঙ্গলের কর্তা দেবব্রত সরকার। এ সবের ফলে মদনঘনিষ্ঠদের মধ্যে এমন প্রশ্নও উঠতে শুরু করেছিল, তা হলে মন্ত্রী কেন জামিন পাবেন না?
মদনবাবুর আইনজীবী মিলন মুখোপাধ্যায়ও প্রথমে পরের পর যুক্তি সাজিয়ে এই প্রশ্নটাই তুলেছিলেন। বলেছিলেন, সারদা রিয়েলটি মামলায় প্রথম চার্জশিটে নাম ছিল না মদনের। প্রায় তিন মাস পরে যে অতিরিক্ত (সাপ্লিমেন্টারি) চার্জশিট পেশ করে সিবিআই, তাতে তাঁর মক্কেলের নাম জুড়ে দেওয়া হয়। অথচ গ্রেফতারের আগে মদনকে ডাকা হয়েছিল সাক্ষী হিসেবে। শুধু তা-ই নয়, আমানতকারীদের কেউই মদনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেননি। মিলনবাবুর আরও প্রশ্ন, অফিসে এক জনের ছবি থাকলেই কি প্রমাণ হয়, তিনি টাকা সরিয়েছেন? তাঁর আরও জিজ্ঞাসা, কেন মদনকে সাপ্লিমেন্টারি চার্জশিটে অভিযুক্ত করা হল?
জবাবে সিবিআই আইনজীবী কে রাঘবচারুলু উদাহরণ দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেন, মদন মিত্র কতটা প্রভাবশালী এবং বাইরে বেরোলে তিনি কী কী করতে পারেন।
কী যুক্তি দেখালেন রাঘবচারুলু?
যুক্তি ১: সিবিআইয়ের আইনজীবী আদালতে বলেন, ‘‘সাত দিনের সিবিআই হেফাজত, তার পর দু’দফায় কয়েক দিনের জেলজীবন। এটুকু বাদ দিলে মদন মিত্রের ১৬৫ দিনের বন্দিজীবনের বাকি সময়ের ঠিকানা এসএসকেএম হাসপাতাল।’’ তিনি দাবি করেন, ‘‘হাসপাতাল থেকে দু’বার সিবিআইকে রিপোর্ট দিয়ে মন্ত্রী ‘গুরুতর অসুস্থ নন’ বলেই জানানো হয়েছে। তবু, তিনি হাসপাতালেই রয়েছেন।’’ সিবিআই কৌঁসুলি এর পরে মদনের হাসপাতাল-বাসকে কটাক্ষ করে বলেন, ‘‘তিনি নামেই জেলে রয়েছেন। আসলে সরকারি হাসপাতালে থেকে সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন।’’ ওই কৌঁসুলির দাবি, ‘‘মদনের মেডিক্যাল রিপোর্টে কোনও অস্ত্রোপচারের কথা বলেননি চিকিৎসকেরা। বরং চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের মেডিক্যাল রিপোর্টে বলা হয়েছিল, মন্ত্রীর শারীরিক অবস্থার উন্নতি হচ্ছে। এপ্রিল মাসের রিপোর্টেও একই কথা জানানো হয়েছিল। এর থেকে প্রমাণিত হয় না যে, তিনি গুরুতর অসুস্থ।’’
মদন মিত্র কতটা অসুস্থ তা প্রমাণ করতে দিল্লির অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিক্যাল সাইন্সেস (এইমস)-এর চিকিৎসকদের দিয়ে মেডিক্যাল বোর্ড বসিয়ে মন্ত্রীর শারীরিক পরীক্ষা করানোর দাবিও তোলে সিবিআই।
যুক্তি ২: সারদা কেলেঙ্কারির পিছনে বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের তদন্তের দায়িত্বে থাকা সিবিআইয়ের বক্তব্য, এই ষড়যন্ত্রের পিছনে রয়েছে কয়েকটি প্রভাবশালী হাত। বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সিবিআই আইনজীবী বলেন, ‘‘মাছ জলের ভিতরে থেকে জল খায়। সেটা ওপর থেকে দেখা যায় না। তেমনই, এই ষড়যন্ত্রও বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই। মদনকে ছাড়া হলে তিনি সাক্ষীদের প্রভাবিত করতে ও ভয় দেখাতে পারেন।’’ পাশাপাশি তাঁর বক্তব্য, ‘‘সুদীপ্ত সেনের সঙ্গে মদনের যোগাযোগের প্রমাণও আমরা পেয়েছি।’’
যুক্তি ৩: সিবিআই আইনজীবীর অভিযোগ, শম্ভু সাউ নামে এক সাক্ষী আদালতে গোপন জবানবন্দি দিয়ে জানান যে, তাঁকে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। মদন বন্দি থাকার সময়েই যদি পরিস্থিতি এমন হয়, তবে তিনি বাইরে বেরোলে কী হবে— সেই প্রশ্ন তোলেন সিবিআইয়ের কৌঁসুলি। তাঁর অভিযোগ, আরও কয়েক জন গোপন জবানবন্দি দিতে রাজি হয়েছেন। মদন ছাড় পেলে তাঁদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে।
যুক্তি ৪: বিচারক কল্লোল দাসের উদ্দেশে সিবিআই আইনজীবীর আরও বক্তব্য, ‘‘সরকারি কর্মী ৪৮ ঘণ্টার বেশি জেলে থাকলে তাঁর বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়, তা আপনি জানেন। কিন্তু মন্ত্রিসভার এক জন সদস্য এত দিন জেলে রয়েছেন। তার পরেও তিনি মন্ত্রিসভার সদস্য হিসেবে বহাল রয়েছেন! তবেই বুঝুন, তিনি কতটা প্রভাবশালী।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy