পাঁচ বছরের অলঙ্কৃত। -নিজস্ব চিত্র।
অন্য কোনও অঙ্গ হলেও কথা ছিল। ৬ বছরের অলঙ্কৃতের হৃদপিণ্ডটাই যে পাল্টে ফেলার দরকার!
কলকাতায় সেই ব্যবস্থা নেই বলে অগত্যা ছেলেকে নিয়ে চেন্নাইয়ের হাসপাতালে গিয়েছিলেন অশোক ও রুমেলা দে। কিন্তু শরীরের অন্য অঙ্গের মতো এ তো আর কেউ দান করতে পারেন না। তবু অনেক খুঁজে-পেতে চারটি হৃদপিণ্ড পাওয়া গিয়েছিল। অলঙ্কৃতের রক্তের গ্রুপের সঙ্গে মিলে যায়, এমন গ্রুপেরও হৃদপিণ্ডও ছিল। চেন্নাইয়ের ওই হাসপাতালের কার্ডিওলজির প্রধান কে কে বালাকৃষ্ণণের কথায়, ‘‘গত সপ্তাহেও একটি পেয়েছিলাম। কিন্তু প্রতিটিই ওর শরীরের তুলনায় বড়।’’
মাত্র কুড়ি কিলোগ্রাম ওজনের অলঙ্কৃতের বুকের খাঁচার ভিতরে ঢুকে যেতে পারে, এমন হৃদপিন্ডের খোঁজ এখনও চলছে। এর মধ্যেই গত সপ্তাহে দু’বার হৃদযন্ত্র বিকল হয়ে গিয়েছিল নার্সারির ছাত্রের। বাইরে থেকে কৃত্রিম উপায়ে তার হৃদযন্ত্র চালানো হচ্ছে। সোমবার চেন্নাই থেকে ফোনে ধরা গলায় অশোকবাবু বললেন, ‘‘অসহ্য ব্যথা ও যন্ত্রণা সহ্য করতে করতে ওর মাথার উপরেও চাপ পড়তে শুরু করেছে। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, রবিবার রাতে ওর মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণও হয়েছে। এখন ভেন্টিলেশনে রাখা হয়েছে।’’
অশোকবাবুকে অসহায় মনে হলেও আশাবাদী বালাকৃষ্ণন। বলেন, ‘‘আর এক সপ্তাহের মধ্যে যদি ওর মাপের একটি হৃদপিণ্ড পাওয়া যায়, তা হলে ওকে বাঁচিয়ে তোলা যাবে।’’ ছেলেকে বাঁচাতে ইতিমধ্যে অশোক ও রুমেলা ২৯ লক্ষ টাকা জমা দিয়েছেন হাসপাতালে। তাঁরা জানতে পেরেছেন, অলঙ্কৃতের বুকের খাচার মাপে হৃদপিণ্ড পাওয়া গেলে তার জন্য আরও ১০ লক্ষ টাকা খরচ হবে। অশোক-রুমেলার অবশ্য এ সব নিয়ে এখন ভাবার অবকাশ নেই।
আচমকা কোনও দুর্ঘটনায় বা অন্য কারণে কেউ কোমায় চলে গেলে তাঁর পরিবারের অনুমতি নিয়ে হৃদপিণ্ড তুলে নিয়ে অন্য দেহে প্রতিস্থাপন করার ক্ষেত্রে চেন্নাই দেশের মধ্যে অগ্রগণ্য। দক্ষিণের এই শহরের বিভিন্ন হাসপাতালে হৃদপিণ্ড প্রতিস্থাপনের জন্য সারা বছর অনেক রোগী অপেক্ষায় থাকেন। হৃদপিণ্ড তুলে আনতে তামিলনাড়ু ও আশপাশের কিছু রাজ্যে হাসপাতালগুলির বিশেষ দল ঘুরে বেড়ায়। চার থেকে ছয় ঘণ্টার মধ্যে হৃদপিণ্ড তুলে এনে প্রতিস্থাপন করতে সাহায্য করে ওই সব দলের সদস্যরা। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, অলঙ্কৃতের জন্য তার কাছাকাছি বয়সের কারও হৃদপিণ্ড পেলে সবচেয়ে ভাল। সে ক্ষেত্রে রক্তের গ্রুপ না মিললেও অসুবিধা নেই।
কেন অলঙ্কৃতের এই অবস্থা?
উল্টোডাঙার অশোক-রুমেলার বিয়ের দশ বছর পরে অলঙ্কৃতের জন্ম। দিব্যি দৌড়ে, হেসে-খেলে বেড়াত ছেলেটা। কলকাতার এক নামী স্কুলে নার্সারিতে ভর্তি হয় অলঙ্কৃত। এই বছরের জুন মাসে আচমকা শুরু হয় বমি। কলকাতার একটি বড় হাসপাতালে ভর্তি করার পরে জানা যায়, সাধারণের ক্ষেত্রে প্রতি মিনিটে যে গতিতে হৃদযন্ত্র রক্ত পাম্প করে, ছোট্ট ছেলেটার হৃদপিণ্ড তা পারে না। সেই হাসপাতালের চিকিৎসক ঋতব্রত দাসের কথায়, ‘‘ওর হৃদপিণ্ডের পেশি দুর্বল। কেন, তার কারণ জানা যায়নি। তাই অন্য হৃদপিণ্ড প্রতিস্থাপন ছাড়া উপায় নেই।’’ চিকিৎসকদের পরামর্শেই ২৯ জুলাই চেন্নাইয়ের ওই হাসপাতালে ভর্তি করা হয় অলঙ্কৃতকে। সেই থেকে যমে-মানুষে লড়াই চালাচ্ছে ২০১০ সালের ১ জানুয়ারি জন্ম নেওয়া শিশুটি।
পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়ে যতই গর্ব করুন প্রশাসনের কর্তারা, রাজ্যে এখনও পর্যন্ত একটিও হৃদপিণ্ড প্রতিস্থাপিত হয়নি। কারণ, এ জন্য আলাদা আইনের প্রয়োজন, যা এই রাজ্যে নেই। ইতিহাস বলছে, ১৯৬৭ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউনে প্রথম হৃদপিণ্ড প্রতিস্থাপন করেছিলেন চিকিৎসক ক্রিশ্চিয়ান বার্নার্ড। সেই শুরু। তখন থেকে এ পর্যন্ত বিশ্ব জুড়ে কয়েক লক্ষ মানুষের শরীরে হৃদপিণ্ড প্রতিস্থাপিত হয়েছে। সবচেয়ে বেশি হয়েছে আমেরিকায়। কার্ডিও থোরাসিক সার্জেন সত্যজিৎ বসুর কথায়, ‘‘আমরাও করতে পারি। আমার দুর্গাপুর মিশন হাসপাতালে তিন জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছেন। কিন্তু তার জন্য রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে আইন করতে হবে।’’
একই কথা বলেছেন পূর্ব ভারতের সমস্ত হাসপাতাল নিয়ে তৈরি সংগঠনের সভাপতি চিকিৎসক রূপালি বসু। তাঁর কথায়, ‘‘চিকিৎসা বিজ্ঞানে গত ৩০ বছরে চেন্নাই অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে। আমাদের অগ্রগতির যাত্রা শুরু বছর দশেক আগে। এখন কলকাতায় হৃদপিণ্ড প্রতিস্থাপন করা সম্ভব। সেই পরিকাঠামো রয়েছে। কিন্তু তা করার আইন নেই। সেটার প্রয়োজন।’’
সরকার কী এই নিয়ে ভাববে? রাজ্যের স্বাস্থ্য- প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘অঙ্গ প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে কেন্দ্রের একটি আইন রয়েছে। আমরা সেই আইন মেনে চলি।’’ বস্তুত, হৃদপিণ্ড যে প্রতিস্থাপন করা যায়, সে সম্পর্কে পুরোপুরি অন্ধকারে মন্ত্রী। তাঁর বিস্মিত প্রশ্ন, ‘‘হৃদপিণ্ড প্রতিস্থাপিত হয় নাকি? সে কি সম্ভব? এমনটা হলে তা বিরল ঘটনা।’’ তাঁকে জানানো হয়, চেন্নাইয়ের বিভিন্ন হাসপাতালেই তো নিয়মিত এই কাজ হচ্ছে। কিন্তু এ রাজ্যে কবে প্রতিস্থাপন সম্ভব, তা নিয়ে কোনও ধারণা দিতে পারেননি চন্দ্রিমাদেবী। তিনি রাজ্যের আইনমন্ত্রীও বটে।
চিকিৎসকদের একাংশ প্রশ্ন তুলেছেন, যে শহর প্রথম ‘ওপেন হার্ট সার্জারি’-র সাক্ষী, সেই কলকাতায় হৃদপিণ্ড প্রতিস্থাপনের আইন করতে আরও কত অপেক্ষা করতে হবে? অলঙ্কৃতের ঘটনা কি সরকারের টনক নড়াতে পারবে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy