পুজোর সময় বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় এক ভিন্ন মানুষ। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
ছিয়াত্তর বছরের বৃদ্ধা তাঁর এজলাসে এসে আর্জি জানিয়েছিলেন, ‘‘আমার ১২টা বছর ফিরিয়ে দাও।’’ তাঁর নির্দেশে সেই বৃদ্ধা তাঁর চাকরিজীবনের বেতন-সহ বকেয়া ৪১ লক্ষ টাকা পেয়েছিলেন। তার পর থেকেই সপ্তাহের অধিকাংশ দিন তাঁকে দেখতে তাঁর এজলাসে চলে আসতেন। তাতে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন তিনি। তাঁর ক্ষোভের সামনে কেঁদে ফেলেছিলেন জোড়হাত বৃদ্ধা। বলেছিলেন, ‘‘এখনই অন্ধ বন্ধ করো না পাখা!’’
গত এক বছরে তিনি সম্ভবত দেশের সবচেয়ে আলোচিত বিচারপতিদের এক জন। যে সমস্ত রায় এবং নির্দেশ তিনি দিয়েছেন, যে সমস্ত পর্যবেক্ষণ তিনি বিচারপতির আসন থেকে করেছেন, তার প্রতিটি নিয়ে শোরগোল হয়েছে। কলরব হয়েছে। এক দিকে প্রান্তিক মানুষের কাছে তিনি ‘ঈশ্বর’-এর মর্যাদা পেয়েছেন। আবার অন্য দিকে রাজনীতিকদের একাংশ তাঁকে কটাক্ষ করেছেন। বিশেষত, নিয়োগ দুর্নীতি সংক্রান্ত বিভিন্ন মামলায় তাঁর পদক্ষেপ নিয়ে সর্ব স্তরে আলোড়ন উঠেছে।
নিয়োগ দুর্নীতির অভিযোগে ১০টিরও বেশি মামলায় সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। ক্যানসারে আক্রান্ত চাকরিপ্রার্থীকে স্কুলে চাকরি দেওয়ার জন্য স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ করেছেন। তাঁকে ধর্না থেকে তুলে এনে চাকরি পাইয়ে দিয়েছেন। অনুব্রত মণ্ডলের কন্যাকে আদালতে তলব করেছেন। পরে সেই নির্দেশ প্রত্যাহারও করেছেন। উল্টে মন্তব্য করেছেন, মামলাকারীকে জরিমানা করা উচিত!
তিনি কি সব সময় রেগেই থাকেন?
হতে পারে। কথায় বলে, কুলীন ব্রাহ্মণের রাগ নাকি একটু বেশিই হয়। সে কথা অবশ্য তিনি নিজেও মানেন। তবে পাশাপাশিই বলেন, ব্রাহ্মণের রাগ ক্ষণস্থায়ী। হুট করে আসে যেমন, তেমনই তাড়াতাড়ি চলেও যায়। সে কথা তাঁর ঘনিষ্ঠেরা (এবং তাঁর এজলাস-মূর্তির সঙ্গে পরিচিতেরা) বিলক্ষণ জানেন।
কিন্তু পুজোর দিনগুলোয় তিনি তেমন নয়। শুক্রবার, মহাষষ্ঠী থেকে পুজোর ছুটি শুরু হয়েছে কলকাতা হাই কোর্টে। ষষ্ঠীর দিন থেকে আর রাগারাগি নেই। দেবীর বোধনের দিন থেকে আর বকুনি নেই।
পুজোর সময় বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় এক ভিন্ন মানুষ।
পুজো কী ভাবে কাটাবেন বিচারপতি? বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে হইহই করে আড্ডা দেবেন, গল্প করবেন। মণ্ডপে ঘুরতে যাবেন। বাংলার শ্রেষ্ঠ উৎসবে অন্য সকলে যেমন করে থাকেন। সাধারণ এবং সমাজবদ্ধ বাঙালির মতো। তাঁর কথায়, ‘‘অনেক কিছু করব! দিনের বেলা ঠাকুর দেখতে যাব। কিছু পুজোসংখ্যা পড়ব। বন্ধুদের সঙ্গে গল্পগুজব করব। বেশি বেশি করে পুরনো দিনের গান শুনব। খাওয়াদাওয়া আর ঘুম তো রয়েছেই। অন্যান্য দিনের মতো নিয়ম করে রাতে এক ঘণ্টা টিভিও দেখব।’’ পাহাড়ের ‘কঠোর’ সৌন্দর্যের প্রতি তাঁর আলাদা আকর্ষণ। লম্বা ছুটি পেলেই তিনি পাহাড়ে ঘুরতে যান। যেমন গত পুজোর ছুটিতে গিয়েছিলেন কাশ্মীর। এই পুজোর ছুটিতেও পাহাড়ভ্রমণের পরিকল্পনা রয়েছে। কিন্তু এখনও সে পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয়নি। ঘনিষ্ঠেরা জানাচ্ছেন, এ বার তিনি উত্তর ভারতে বেড়াতে যেতে পারেন। যেতে পারেন কয়েকটি তীর্থক্ষেত্রেও। তবে ছুটির মধ্যে হাই কোর্টের কাজও আছে তাঁর। দুর্গাপুজোর পর ১ নভেম্বর তাঁর পূজাবকাশকালীন বেঞ্চ রয়েছে। ওই দিন তিনি এজলাসে বসবেন।
রাশভারী বিচারপতি কি পুজোর সময়েও তাঁর পরিচিত কালো কোট পরেই থাকবেন? পুজোর আগে আগে এই কথোপকথনে তাঁকে সে প্রশ্ন করা হয়নি। তবে তাঁকে দীর্ঘ দিন চেনেন এমন এক জন বললেন, ‘‘সাহেবকে পুজোয় পাঞ্জাবি-পাজামা পরতে দেখেছি।’’
ঠিকই। হতে পারেন তিনি কঠোর বিচারপতি। কিন্তু তাঁরও তো ছোটবেলা ছিল। দুর্গাপুজো এলে পুরনো স্মৃতি তো তাঁকেও তাড়া করে। অষ্টমীতে নতুন পোশাক। মায়ের সঙ্গে অঞ্জলি দিতে যাওয়া। ‘‘ছোটবেলায় নতুন জামা পরে মায়ের হাত ধরে অঞ্জলি দিতে যেতাম। সে দিনগুলো এখনও আবছা আবছা মনে পড়ে। তবে স্কুলের উঁচু ক্লাসে ওঠার পর থেকে আর অঞ্জলি দিতে যাওয়া হয়নি’’, কলকাতা হাই কোর্টের নিজের চেম্বারে বসে স্মৃতি হাতড়ান তিনি।
পুজোর ভিড়ে মেশেন বটে। কিন্তু কোনও পুজোয় ‘সক্রিয়’ ভাবে অংশ নেননি, নেনও না। অর্থাৎ, কোনও ক্লাব বা কোনও প্রতিষ্ঠানের পুজোর সঙ্গে তিনি জড়িত নন। তবে বাড়ির কাছে কলেজ স্কোয়ারের পুজোর প্রতি তাঁর আকর্ষণ একটু বেশি। তা ছাড়া শহরের সব পুজো নিয়ে তিনি মোটের উপর খুশি।
আড্ডা-গল্প-আহার-আয়োজন থাকবে তাঁর পুজোয়। কিন্তু সেই আয়োজনে খানিকটা খাদও থেকে যাবে। খেদের খাদ। সেই খেদ সরকারি চাকরির দাবিতে রাস্তায় বসে-থাকা মানুষগুলোর মর্মযন্ত্রণার। পুজোর আগেই তাঁদের চাকরি হয়ে গেলে পুজোর আনন্দের ষোলকলা পূর্ণ হয়ে থাকত তাঁর। বলেন, ‘‘সব দুর্নীতি ধরা পড়া সত্ত্বেও প্রকৃত চাকরিপ্রার্থীরা এখনও পর্যন্ত বঞ্চিতই রয়ে গেলেন। পুজোর আগে তাঁদের চাকরি হয়ে গেলে খুব খুশি হতাম।’’
গত বছর দুর্গাপুজোর আগে প্রায় পাঁচ হাজার জনকে চাকরি দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি। যদিও তাঁর সব ক’টি নির্দেশ এখনও কার্যকর হয়নি। উচ্চ বেঞ্চে কয়েকটি মামলা এখনও বিচারাধীন। বলছিলেন, ‘‘পুজোর আগে ওঁরা চাকরি পেয়ে গেলে খুব ভাল হত। সেটা হল না। তাই এই পুজোর আনন্দটা আমার কাছে অন্যান্য বছরের তুলনায় অনেকটা কম। যোগ্য প্রার্থীরা চাকরি পেলে আমার পুজোটা আরও অনেক ভাল কাটত। দুর্নীতি উদ্ঘাটন করা গেলেও তা রোধ করতে এখনও নানা বাধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে।’’
সমাজের প্রান্তিক মানুষেরা তাঁকে ঈশ্বর জ্ঞানে পুজো করেন। তাঁদের অনেকে তাঁর এজলাসে গিয়ে বলেন, ‘‘আপনিই আমাদের কাছে ভগবান। হে ভগবান, সাহায্য করুন!’’
সে সব শুনে তিনি খানিক বিড়ম্বিতই হন। বলেন, ‘‘আবেগপ্রবণ হয়ে অনেকে এমন বলেন। তবে মানুষ তো কখনও ভগবান হতে পারে না! রামকৃষ্ণদেবের মতো মহাপুরুষেরা সাধারণ মানুষের জীবনে ভগবানের স্থান নিয়েছেন। আমি এক জন সাধারণ মানুষ।’’ আরও বলেন, ‘‘আমি আমার কাজ করছি। আমার এই আসনের সেই সুযোগ আছে বলে করেছি। এই আসনে বসে অন্য কেউ মনে করলে তিনিও একই ভাবে মানুষকে সাহায্য করতে পারবেন।’’
তাঁর ক্রোধের মুখে পড়েছেন হাই কোর্টের একাধিক আইনজীবীও। তা নিয়ে অনেকে প্রকাশ্যেই অসন্তোষ জানিয়েছেন। আবার অনেক আইনজীবী তাঁর সাহসিকতা এবং উদার মনোভাবের প্রশংসাও করেছেন।
তিনি কি সব সময় রেগেই থাকেন?
বিচারপতি জবাব দেন, ‘‘সবাইকে খুশি করা কারও পক্ষে সম্ভব নয়। কোনও আইনজীবী মক্কেলের সঙ্গে চালাকি করলে আমি রেগে যাই। মক্কেল তাঁকে বিশ্বাস করে মামলা দিয়েছেন। তাই মামলাটা সুন্দর ভাবে তুলে ধরার দায়িত্ব তাঁর। তবে ক্ষণিকের জন্য কারও উপর রেগে গেলে পরে আবার তাঁকে ডেকেও নিই। কারও উপর আমার রাগ থাকে না। আমি তো ওঁদেরই এক জন।’’
তিনি মানেন, কুলীন ব্রাহ্মণের রাগ একটু বেশি হয়। তবে পাশাপাশিই বলেন, ব্রাহ্মণের রাগ তাড়াতাড়ি চলেও যায়।
কিছু দিন আগে বিধাননগরের বেআইনি নির্মাণ ভাঙার নির্দেশ দিয়েছিলেন। আদালতের সেই নির্দেশে বাধা দেন স্থানীয় লোকজন। মহিলারা সেই নির্মাণের গেটের সামনে শুয়ে পড়ে বিক্ষোভও দেখান। উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে নির্মাণ ভাঙতে না পেরে ফিরে আসে পুলিশ। সে কথা আদালতে জানায় তারা। এলাকার কাউন্সিলর তাঁর এজলাসে এসে হাপুস নয়নে কাঁদতে থাকেন। ‘কঠোর’ বিচারপতি বিচলিত হন। বলেন, ‘‘ভালই হয়েছে ওই নির্মাণ ভাঙা হয়নি। আমি তখন বলেছিলাম ঠিকই। কিন্তু এই সব মানুষদের অবস্থা আমাকে কষ্ট দিচ্ছে। তাঁদের প্রতি আমি মানবিক। আমি চাই না পুজোর আগে তাঁদের মাথার ছাদ চলে যাক।’’
পুজোর সময় বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় এক ভিন্ন মানুষ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy