Advertisement
২২ ডিসেম্বর ২০২৪
Durga Puja of Renu Khatun

দশভুজা হতে চান না, কৃত্রিম হাতেই রেখেছেন জীবনের হাতে হাত, বাজল তোমার আলোর রেণু

একটা রাত বদলে দিয়েছে জীবন। বদলেছে ঠিকানা। বদলেছে চাকরি। আরও কঠিন করে দিয়েছে বাঁচার লড়াই। তবু ঈশ্বরের বিরুদ্ধে কোনও ক্ষোভ নেই তাঁর। বাবা-মা তো সন্তানের ভালই চাইবেন!

How does Renu Khatun spend Durga Pujo, whose husband cut off her hand

রেণু খাতুন। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

নিলোভনা চক্রবর্তী ও সৌরভ লাহা
কলকাতা ও বর্ধমান শেষ আপডেট: ২০ অক্টোবর ২০২৩ ১০:০০
Share: Save:

মা দুগ্গার মতো তাঁরও দশটা হাত হলে কি ভাল হত?

জবাবে তিনি বলেন, ‘‘এটা ঠিক যে, মা দুগ্গার দশ হাত। শক্তিও অনেক। তা বলে যাঁদের এক হাত, তাঁদের শক্তিহীন ভাবা ঠিক নয়! মা কালীর তো দু’হাত! তিনিই বা কম কিসে!’’

তিনি রেণু খাতুন। ঘুমের ঘোরে মুখে বালিশ চাপা দিয়ে যাঁর ডান কব্জি থেকে কেটে নিয়েছিলেন তাঁর স্বামী। সরকারি হাসপাতালে নার্স হতে চাওয়ার ‘শাস্তি’!

কিন্তু রেণু দমে যাননি। আবার হাত রেখেছেন জীবনের হাতে। অনেক ঝড়। অনেক লড়াই। সব লন্ডভন্ড। সেই ঝড়ের শেষে জীবনে এখন থিতু তিনি। সরকারি নার্সিং কলেজে প্রশিক্ষকের চাকরি করেন। বর্ধমান শহরের বাজেপ্রতাপপুরে দিদির বাড়িতে থাকেন। কৃত্রিম হাত দিয়ে আর পাঁচ জনের মতোই যাবতীয় কাজ করেন। যেটুকু খামতি ছিল, গত দেড় বছরের যুদ্ধে ঝেড়ে ফেলেছেন। তবে দুর্গা তিনি হননি। হতে পারবেনও না। হতে চানও না। রেণু বলেন, ‘‘আমরা শিষ্য হতে পারি। গুরু কি হতে পারি? মায়ের মেয়ে হতে পারি। মা নয়।’’

তবে ‘মায়ের মেয়ে’ তিনি বটে। আরজি কর হাসপাতাল থেকে নার্সিং প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। বেসরকারি হাসপাতালে নার্সের কাজ করেছেন। স্বামী শেখ সরিফুল মানতে পারেননি। স্ত্রীর চাকরি করা তাঁর পছন্দ ছিল না। ভাবতেন, সরকারি চাকরি পেলে স্ত্রী তাঁকে ছেড়ে চলে যাবেন! রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরে নার্সের পদে চাকরির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন রেণু। সেই ‘সরকারি’ চাকরিতে যোগ দেওয়ার কথা ছিল তাঁর। তীব্র আপত্তি জানিয়েছিলেন স্বামী। চলেছিল বাদানুবাদ। রেণু সিদ্ধান্তে স্থির ছিলেন— সরকারি চাকরিতে যোগ দেবেন।

রেণু খাতুন।

রেণু খাতুন। —নিজস্ব চিত্র।

২০২২ সালের ৪ জুন। শ্বশুরবাড়িতে ঘুমিয়ে ছিলেন রেণু। আচমকা ঘুম ভাঙে। চিৎকার করতে গিয়েও পারেননি। মুখের উপর বালিশ চাপা। ডান হাতে হাতুড়ি পিটছেন স্বামী। তীব্র যন্ত্রণা। তার পরে টিন কাটার কাঁচি দিয়ে কব্জি থেকে কেটে নিলেন রেণুর হাত। সঙ্গে আরও তিন জন। আহত রেণু প্রথমে ছিলেন কাটোয়া মহকুমা হাসপাতালে। সেখান থেকে বর্ধমান সদর হাসপাতাল। তার পরে দুর্গাপুরের বেসরকারি হাসপাতালে তাঁকে ভর্তি করান বাপের বাড়ির লোকজন। থানায় অভিযোগ করেন রেণুর বাবা আজিজুল হক। দু’দিন পর গ্রেফতার হন তাঁর স্বামী। এর পরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হস্তক্ষেপে চাকরি পেয়েছেন রেণু। কৃত্রিম হাত হয়েছে তাঁর।

কখনও কি মনে হয়, দুর্গাঠাকুরের মতো ১০টা হাত হলে ভাল হত? নাহ্, রেণু মনে করেন, ‘‘দুর্গারই দশ হাতের প্রয়োজন। যাঁদের এক হাত, মাকে দেখে যাতে তাঁরা ভাবতে পারেন, আমারও দশ হাত! আমিও কম নই।’’

এটা তাঁর ‘দ্বিতীয় জন্ম’। মনে করেন রেণু। তবে এই দ্বিতীয় জন্মে কিছু আক্ষেপ রয়েছে তাঁর। কিছু কষ্ট। আগের মতো আর তাড়াতাড়ি কাজ সারতে পারেন না। তবে তিনি জানেন, কাজটা করতে হবে। তাই অসুবিধা হয় না। তবু অস্ফূটে বলে ওঠেন, ‘‘মাঝেমধ্যে মনে হয় পিছিয়ে গিয়েছি! বাকিদের মতো আর নই আমি!’’ বুকে একটা কষ্ট ধাক্কা মারে। জীবনের লক্ষ্য ছিল, মানুষের সেবা করা। নিজের হাতে রোগীদের শুশ্রূষা করা। তা আর করতে পারেন না রেণু। এখন তিনি নার্স নন। নার্স তৈরি করেন। প্রশিক্ষণ দেন। বলেন, ‘‘যখন নার্স ছিলাম, কখনও কাজে একঘেয়েমি আসত না। সারা দিন কাজ করেও ক্লান্তি আসত না।’’

এখন সেই তৃপ্তি (রেণু বলেন, ‘জব স্যাটিসফ্যাকশন’) কমে গিয়েছে। তবে ক্ষোভ নেই। মনে করেন, তাঁর যেমন জীবন নিয়ে নিজস্ব পরিকল্পনা ছিল, তেমনই ঈশ্বরেরও ছিল। সেই ঈশ্বর মা দুর্গা হোন বা আল্লাহ। রেণু ভাবেন, ওঁরাই তো বাবা-মা। ওঁরা ভালই চান। তাই এখনও পুজো এলে মনটা অন্য রকম হয়ে যায় রেণুর। অন্য অনুভূতি জাগে। নার্সিং কলেজ যাওয়ার পথে দেখেছেন, একটু একটু করে বেড়ে উঠেছে মণ্ডপ। কাঠামোয় মাটি পড়েছে। মাটির উপর রং। রঙের উপর জরিদার কাপড়। বর্ধমান শহরে অনেক পুজো। সহকর্মীদের সঙ্গে পুজো দেখতে চান রেণু। তবু ভিতরে একটা কিছু তিরতির করে। ভাবেন, ‘‘কী জানি, কাল কী হয়! কাল যদি আবার সব বদলে যায়!’’ সেই রাতেও তো তিনি ভাবেননি তেমন কিছু হতে পারে। সিরাজই তো এককালে তাঁর হাত ধরেছিলেন তাঁর। দু’জন দু’জনকে ভালবেসেই বিয়ে করেছিলেন। প্রথমে একটু মন কষাকষি হলেও পরে দুই বাড়ির লোকজনই মেনে নিয়েছিলেন। প্রায় আড়াই বছরের সম্পর্ক। তার পরে পাঁচ বছরের দাম্পত্য।

রেণু খাতুন।

রেণু খাতুন। —নিজস্ব চিত্র।

তখনও পুজো এসেছে। চলেও গিয়েছে। রেণুর বেড়ে ওঠা চিনিসপুর গ্রামে। সেখানে দুর্গাপুজো হত না। মনসা, সরস্বতীর মতো ‘ছোট পুজো’ হত। তা দেখেই বড্ড আনন্দ হত রেণুর। কান্দ্রার কলেজে পড়ার সময় প্রথম দুর্গাপুজো দেখা। বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে। তিন বছর আরজি করে প্রশিক্ষণ নেওয়ার সময় দুর্গাপুজো আসলে কী, প্রথম বোঝা। সহপাঠীদের সঙ্গে কলকাতার পুজো দেখতে বেরোতেন। চোখ ধাঁধিয়ে যেত। ভাবলে এখনও চোখ জ্বলজ্বল করে ওঠে রেণুর। বলে ওঠেন, ‘‘দারুণ!’’

তাঁর পাঁচ বছরের দাম্পত্যেও পুজো এসেছে। কোজলসা গ্রামে ছিল তাঁর শ্বশুরবাড়ি। সেখানেও দুর্গাপুজো হত না। দূরের গ্রামে পুজো হত। তবে তার ঢাকের শব্দ কোজলসায় এসে পৌঁছত না। তখনকার দুর্গাপুজোর স্মৃতি বিশেষ নেই রেণুর। রয়ে গিয়েছে শুধু সেই রাতের স্মৃতি। যে রাতে সব বদলে গিয়েছিল। নিরঞ্জনের পর যেমন প্রতিমার রূপ বদলে যায়। জলে কাঠামো পড়ে থাকতে দেখে মনখারাপ হয়ে যায় রেণুর। মনে হয়, কেন প্রতিমা রেখে দেওয়া হয় না? তার পর নিজেই নিজেকে বোঝান, পুরনো চলে গেলে তবেই তো নতুন আসবে। তবেই তো আনন্দ আসবে।

তবু কোথাও তাঁর মনে হয়, “পুরনোটা থাকলে খারাপ হত না।’’ প্রশ্ন করেন, ‘‘ভাল ভাবে বাঁচার অধিকার তো সকলের রয়েছে? তাই না?” তার পরে বলে চলেন, “কেউই তো খারাপ থাকতে চায় না। খারাপ জীবন চায় না। বাধা থাকে। তবু সব পাখিই তো আকাশে উড়তে চায়। যতটা পারে। নিজের মতো বাঁচতে চায়। নিজের মতো জীবন বেছে নিতে চায়। নিজের মতো থাকতে চায়।”

সেই ইচ্ছাপূরণের জন্য আগে নিজের একটা মঞ্চ তৈরি করতে চান রেণু। তার পর মা দুর্গার মতো জিততে চান লড়াইয়ে। তত দিন নিজের মতো করে বাঁচতে চান। যে বাঁচার কথা বেজে ওঠে তাঁর মোবাইলের কলার টিউনে, ‘আমাকে আমার মতো থাকতে দাও’।

পুজোর রেণু, আলোর রেণু বলেন, ‘‘ওটাই আসলে বলতে চেয়েছিলাম। বরাবর।’’

অন্য বিষয়গুলি:

Renu Khatun Durga Puja 2023 Durga Pujo 2023 Bhinno Pujo
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy