Advertisement
E-Paper

সাইকেলে জং ধরেছে, ঘরে মাকড়সার জাল, পুজো নেই যাদবপুরের অকালমৃত পড়ুয়ার পরিজনদের জীবনে

সাইকেলটা নিয়েই বাইরে দাঁড়িয়ে দাদার হাঁক, ‘‘কী রে, হল তোর?’’ তাড়া খেয়ে ভাই ছুটে আসত তত ক্ষণে। চটিটা পায়ে গলিয়ে যেতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ত কখনও-সখনও। সামলে উঠেই মুহূর্তের মধ্যে উধাও দু’জন।

প্রতীকী ছবি।

প্রণয় ঘোষ ও সৌরভ নন্দী

শেষ আপডেট: ১৮ অক্টোবর ২০২৩ ০৯:১৩
Share
Save

বাড়ির এক কোণে দেওয়ালে হেলান দিয়ে রাখা সাইকেলটা। বর্ষায় অনাদরে বাইরে পড়ে থাকতে থাকতে জং ধরে গিয়েছে। বৃষ্টি পেয়ে বেহায়া লতাগুলো তরতরিয়ে বেড়ে উঠে শিকলের মতো বেঁধে রেখেছে চাকা দুটো। প্রতি বার পুজোর আগে দাদা তেল-জল দিয়ে ধুয়েমুছে রাখত সাইকেলটা।

পঞ্জিকা অনুযায়ী গজে আসুন বা দোলায়, এই বাড়িতে এই সাইকেলে চড়েই বরাবর এসেছেন মা দুগ্গা!

গত বারই যেমন। চতুর্থীর সকালেই পাড়ার ঠাকুর চলে আসবে। আগের দিন রাতেই মা-বাবাকে পইপই করে সকালে তাড়াতাড়ি ঘুম ভাঙিয়ে দেওয়ার জন্য বলে রেখেছিল দুই ভাই। সকালে অবশ্য মাকে ডাকতে হয়নি। তার আগেই ঘুম ভেঙে গিয়েছিল ওদের। লাফ দিয়ে উঠে দাদা ভাইকে ডেকেছিল, ‘‘ভাই ওঠ! চল! দেরি করিস না!’’

প্রবল ব্যস্ততা। সঞ্জয়দের আগে পৌঁছতে হবে মণ্ডপে। তার পরে ভ্যানে চেপে দুই ভাই যাবে ঠাকুর আনতে। কোনওক্রমে নতুন জামা গায়ে দিয়েই দৌড়। সাইকেলটা নিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে আবার হাঁক পাড়ত দাদা, ‘‘কী রে, হল তোর?’’ ভাই ছুটে আসত। তাড়াহুড়োয় চটিটা পায়ে গলিয়ে নিতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ত কখনও-সখনও। সামলে উঠে মুহূর্তে উধাও দু’জন। পিছু পিছু ছুটে আসতেন মা, ‘‘মুখে কিছু দিয়ে যা। খালি পেটে যাস না।’’ কিন্তু তখন কে শোনে কার কথা!

বছর ঘুরে গিয়েছে। এই পুজোয় দাদা নেই। নদিয়ার ছোট্ট জনপদ থেকে কলকাতায় গিয়েছিল। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে সব অচেনা মুখ। বাড়ির জন্য মনকেমন! অচেনা শহরে শুরুতে মানিয়ে নিতে কষ্ট। বার বার ফোন করত বাড়িতে। মা-বাবা-ভাইয়ের গলা শুনলে খানিক শান্তি! সপ্তাহখানেক ক্লাস করে বাড়িতে ফেরার কথা ছিল। তার মধ্যেই মধ্যরাতে হঠাৎ ফোন এসেছিল— হস্টেলের বারান্দা থেকে নীচে পড়ে গিয়েছে দাদা! ভর্তি হাসপাতালে। শুনে কলকাতা ছুটেছিল সকলে। কিন্তু যেতে যেতেই সব শেষ!

পরের এক মাস ধরে ঝড় বয়ে গিয়েছে। বার বার ছুটে যেতে হয়েছে কলকাতা। শূন্য বাড়িতে ফিরতে ইচ্ছে হত না কারও। তখন থেকে তাদের বসত মামার রানাঘাটের বাড়ি। নিজেদের বাড়ি প্রায়শই তালাবন্ধ থাকে। মাঝেমধ্যে যাওয়া। শূন্যতা গিলতে এলে আবার আশ্রয় মামার বাড়ি!

গত সব বছরগুলোতেও সপ্তমী থেকে রানাঘাটের মামার বাড়িই পুজোর ঠিকানা থেকেছে দুই ভাইয়ের। মহালয়ার আগে বাড়ি ঝকঝকে করে তুলতেন বাবা-মা। দেওয়ালের তাকের ঝুল, আলমারির উপর লেপ্টে থাকা ধুলো সাফ করত দুই ভাই মিলে। ষষ্ঠী পর্যন্ত নিজেদের বাড়িতেই থাকত ওরা। সাইকেলটা নিয়ে দু’জনে ঘুরে বেড়াত এ পাড়া-ও পাড়া। সপ্তমী থেকে রানাঘাটে মামার বাড়ি। যেমন এসেছিল গত বছরও। দেবীপক্ষের শুরু থেকে আলোয় সেজে উঠেছিল গোটা বাড়ি। সপ্তমীতে দুই ভাই আসার পরেই কোলাহল সপ্তমে! ভাইবোনেরা জুটে গোটা বাড়ি মাথায় তুলেছিল। সারা দিন হইহট্টগোলের পর রাতে নতুন জামা পরে ঠাকুর দেখা। রানাঘাটের অলিগলি ঘুরে কল্যাণীর ‘টুইন টাওয়ার’। তার পর খাওয়াদাওয়া করে বাড়ি ফেরা।

গত বার অষ্টমীতে দুই ভাই বায়না ধরেছিল বেলুড় মঠের পুজো দেখার। বাবা নিয়ে গিয়েছিলেন। সন্ধিপুজো আর সন্ধ্যারতি দেখে বাড়ি ফিরেছিল সে দিন। বাবার এখনও মনে পড়ে, ‘‘মহারাজদের প্রণাম করার পর স্বামীজির বই পেয়েছিল ওরা। কী যে খুশি হয়েছিল দু’জন! বড়টা আসতে আসতে বলছিল, বাবা, আমার মঠে থাকতে ইচ্ছে করে খুব। স্বামীজির মতো হতে ইচ্ছে করে।’’ গত বছর নবমীতে ফোন ঘেঁটে শেখা বিরিয়ানি রেঁধে খাইয়েছিল বড় ছেলে। বলেছিল, এ বছর পিৎজা বানিয়ে খাওয়াবে! বলতে বলতে গলা ধরে আসে বাবার। কান্না চেপে বলেন, ‘‘যাদবপুরে পড়়তে গিয়ে ওখানে পিৎজা খেয়েছিল ছেলে। ছবি পাঠিয়েছিল। তখনই বলেছিল, পুজোতে আমাদের নাকি পিৎজা খাওয়াবে!’’ তার পর দীর্ঘশ্বাস ফেলেন, ‘‘সে আর হল কই!’’

হল না। এ বছর সব কিছু বদলে গিয়েছে। এ বছর চোখে জল নিয়ে মা আর মামি বলেন, ‘‘এ বার আমাদের বাড়িতে পুজো নেই!’’ মামা বলেন, ‘‘এ বার পুজো বলে মনেই হচ্ছে না। আমাদের পুজো শেষ হয়ে গিয়েছে। আমাদের ছেলেমেয়েদেরও কিচ্ছু কিনে দিইনি এ বার। কেউ কিছু চায়ওনি।’’ মামাতো দিদি বলে, ‘‘গত বছর খুব আনন্দ করেছিলাম। একসঙ্গে ঘুরতে গিয়েছিলাম। এ বার কিচ্ছু ইচ্ছে করছে না!’’

তত ক্ষণে লাল চেক শার্ট পরা বড় ছেলের একটা ছবি নিয়ে এলেন মা। ছবিটায় হাত বুলোতে বুলোতে জানান, গত বার অষ্টমীতে তোলা। ছেলের নরম মুখের দিকে তাকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘‘পুজোয় কোথায় এক বার পাঁঠাবলি দেখে খুব ভয় পেয়েছিল ও। সিঁটিয়ে গিয়েছিল। মুখ ভার করে বসেছিল দু’দিন। খালি বলছিল, মানুষ এত নিষ্ঠুর কী করে হয়! আর সেই ছেলেকেই কিনা এ ভাবে মেরে ফেলল সবাই মিলে!’’ ক্রোধ শোনা যায় তাঁর গলায়। তার পরেই ছোট ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে ঝরঝর কেঁদে ফেলেন। বলতে থাকেন, ‘‘বড়টা তো চলে গেল। ও-ই এখন আমাদের সম্বল। দাদা ওর প্রিয় বন্ধু ছিল। সারা ক্ষণের সঙ্গী ছিল!’’

মায়ের হাত থেকে ছেলের ছবি নিয়ে বাবা বলেন, ‘‘আমার ছেলেকে যারা খুন করেছে, ওরা এক-একটা অসুর! মা দুর্গা যেমন অসুরকে বধ করেছিল, ওদেরও সেই রকম শাস্তি চাই আমরা। যে দিন সেটা ঘটবে, সে দিন মায়ের কাছে যাব। চোখের জলে মা দুর্গার পা ধুইয়ে দেব। তার আগে আর যাব না!’’

রানাঘাটের বাড়িটার চারপাশে শুধু নিস্তব্ধতা। ঘুটঘুটে অন্ধকার। সেই অন্ধকার ধুয়ে দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে একটা ছোট্ট এলইডি বাল্‌ব। খাঁ খাঁ করছে বগুলার বাড়ি। জায়গায় জায়গায় মাকড়সার জাল। এক কোণে দেওয়ালে হেলান দিয়ে রাখা সাইকেলটা। বর্ষায় অনাদরে বাইরে পড়ে থাকতে থাকতে জং ধরে গিয়েছে। বৃষ্টি পেয়ে বেহায়া লতাগুলো তরতরিয়ে বেড়ে উঠে শিকলের মতো বেঁধে রেখেছে চাকা দুটো।

এ বছরে সাইকেলে চেপে দুগ্গা এ বাড়িতে ঢোকেননি।

Jadavpur University Jadavpur University Student Death Bhinno Pujo durga pujo Student Death Ranaghat

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}