শাস্ত্রমতে ‘বোধন’ দিয়েই পুজো শুরু হয়। কিন্তু উদ্বোধনের জেল্লায় উৎসব এখন পিতৃপক্ষেই শুরু হয়ে যাচ্ছে। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
দ্বিতীয়ার দুপুরে পুঁচকে গোলপোস্টের সামনে দু’হাঁটুতে হাতের ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে মন্ত্রী সুজিত বসু। একটি খোকা পেনাল্টি মারলেন রোনাল্ডিনহো। বল জালে জড়িয়ে গেল। শ্রীভূমির পুজোমণ্ডপের চারদিকে হইহই কাণ্ড। রইরই ব্যাপার।
দ্বিতীয়ার সন্ধ্যায় লেবুতলা পার্ক সরগরম। পুজো উদ্বোধন করছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। তাঁর পাশে গদগদ এবং ‘কেমন দিলাম’ মুখে দাঁড়িয়ে কলকাতায় বিজেপির কাউন্সিলর সজল ঘোষ।
তৃতীয়ার বিকেল। চেতলা জুড়ে গমগম করে বাজছে মুখ্যমন্ত্রীর মোবাইল-বাহিত কণ্ঠ। এ পারে মন্ত্রী তথা চেতলা অগ্রণীর পুজোর কর্ণধার ফিরহাদ হাকিম। সঙ্গে অপর মন্ত্রী শশী পাঁজা। তাঁর সঙ্গে সার দিয়ে বিধায়ক, কাউন্সিলর, এলাকার বিবিধ নেতা।
তার আগে কলকাতার পুজো উদ্বোধনে ঢুকে পড়েছেন বিদ্যা বালন। যাঁর ‘কহানি’ ছবিতে দুর্গাপুজোর ভরপুর অনুষঙ্গ দেখেছে বাঙালি।
পঞ্জিকা মতে এ বছরে দুর্গাপুজোর ষষ্ঠী তিথি শুরু ১৯ অক্টোবর, বৃহস্পতিবার (১ কার্তিক) রাত ১২টা ৩৩ মিনিটে। সেটাই পূজা শুরুর সময়। হিন্দু রীতিতে ‘বোধন’ দিয়েই পুজো শুরু হওয়ার কথা। পণ্ডিত সুরেন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য সঙ্কলিত ‘পুরোহিত দর্পণ’ বলছে, ষষ্ঠীর সন্ধ্যায় ‘ষষ্ঠ্যাং সায়াহ্নে বোধয়ামি বৈ’ মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমে দেবীপূজার বোধন হবে। এর পরে ‘অধিবাস’। তার পরে ‘পূজারম্ভ’।
কিন্তু সে সব উৎসবের গর্ভে নিমজ্জিত। এখন বোধনের চেয়ে উদ্বোধন বৃহদাকার।
বস্তুত, গত কয়েক বছর ধরেই উদ্বোধনের লড়াইয়ের কারণে পুজো এগিয়ে এসেছে মহালয়ারও আগে। পিতৃপক্ষে উদ্বোধন ঠিক না বেঠিক, তা নিয়ে সমাজমাধ্যমে লড়াই হচ্ছে বটে। কিন্তু যাঁরা সেই যুদ্ধ করছেন, তাঁরাই আবার প্রলম্বিত পুজো চেটেপুটে নিচ্ছেন রাস্তায় রাস্তায়।
সংসদের বাংলা অভিধানে ‘উদ্বোধন’ শব্দের তিনটি অর্থের উল্লেখ রয়েছে। প্রথম দু’টি ‘জ্ঞান বা বোধের উন্মেষ’ এবং ‘চেতনা-সঞ্চার’। তার সঙ্গে দুর্গাপুজোর আধুনিক উদ্বোধনের মিল নেই। তৃতীয় অর্থ—‘যাহা জানাইয়া দেয়’ এ ক্ষেত্রে যথার্থ। উদ্বোধন আসলে সকলকে জানিয়ে দেওয়া—উৎসব সমাগত। আরও সহজ করে বললে— ‘দুয়ারে পুজো’।
‘দুয়ারে’ কথাটায় একটু রাজনীতির গন্ধ আছে। স্বাভাবিক। এখন পুজোর উদ্বোধন রাজনীতিরও অঙ্গ বইকি! বরাবর সেই ‘উদ্বোধন রাজনীতি’তে এগিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা। তাঁর দলের নেতারা বহু দিন থেকেই নানা বারোয়ারি পুজোর ‘প্রাণপুরুষ’। কিন্তু রাজ্যে তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরে বছরে বছরে উদ্বোধন নতুন মাত্রা পেয়েছে। প্রতি বছরেই মমতার পুজো উদ্বোধনের সংখ্যা বেড়েছে। এ বছরে তা দিনে শতাধিক! সেটা অবশ্য সম্ভব হয়েছে ‘ভার্চুয়াল’ উদ্বোধন হওয়ায়। অসুস্থতার কারণে চিকিৎসকদের পরামর্শে গৃহবন্দি মুখ্যমন্ত্রী গ্রাম-শহর মিলিয়ে রেকর্ড সংখ্যক পুজোর উদ্বোধন করেছেন।
বাংলার দুর্গাপুজো ঘিরে উদ্বোধনের রাজনীতির বয়স অবশ্য খুব বেশি নয়। মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময়ে বিধানচন্দ্র রায়, সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়েরা বিভিন্ন নামী পুজোর প্যান্ডেলে গিয়েছেন শোনা গেলেও তাঁরা উদ্বোধনে যোগ দিতেন বলে কেউ মনে করতে পারছেন না। বাম জমানায় জ্যোতি বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যদেরও পুজোর মতো ধর্মীয় অনুষ্ঠান থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে হয়েছে দলীয় বিশ্বাসের বাধ্যবাধকতায়। তবে তাঁরা বেঁধে রাখতে পারেননি সুভাষ চক্রবর্তীকে। ২০০৪ সালে বেলেঘাটায় মন্টু সান্যালের দুর্গাপুজো উদ্বোধন করেছিলেন সুভাষ। যিনি মনে করতেন, বাঙালির বৃহত্তম উৎসবের সঙ্গে দলের দূরত্ব রাখাটা কৌশলগত ভুল। তাতে পার্টি ‘জনবিচ্ছিন্ন’ হয়ে থাকবে। সুভাষ-ঘনিষ্ঠেরা বলেন, তিনি নাকি এমনও মনে করতেন যে, ভারতে কোনও দিন বিপ্লব এলে জাতীয় উৎসব হবে দুর্গাপুজো।
বিপ্লব আসেনি। কিন্তু কলকাতার দুর্গাপুজো ইউনেস্কোর ঐতিহ্যের তালিকায় ঢুকে গিয়েছে। তাতে পুজো নিয়ে ধূম আরও বেড়েছে। পুজোর উদ্বোধনের ঢাকে কাঠি পড়ছে গাঁ-গঞ্জ থেকে ঢাকিরা কলকাতায় আসারও আগে। তারও আগে থেকে ধরা শুরু হয় খ্যাতনামীদের। যাঁদের মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে রুপোলি পর্দার তারকারা। সে বড় পর্দা হোক বা ছোট। সে টিভি সিরিয়ালের জনপ্রিয় নায়িকা হন বা বলিউডের নক্ষত্র। একটা সময়ে লেখক, সাহিত্যিকদেরও চাহিদা ছিল। কিন্তু এখন তাঁদের ‘ডিমান্ড’ পাড়ায় পাড়ায় বইমেলায়।
কেন জাঁকজমক করে উদ্বোধনের হিড়িক?
দক্ষিণ কলকাতার এক অভিজ্ঞ পুজোকর্তার কথায়, ‘‘যত জাঁকজমক, তত প্রচার। যত প্রচার, তত বিজ্ঞাপন। যত বিজ্ঞাপন, তত স্পনসর। যত স্পনসর, তত বাজেটবৃদ্ধি। এটা একটা চক্রের মতো। প্রতি বছর যার বহর বাড়তে থাকে।’’
ঠিকই। একটা সময় ছিল, যখন পুজো উদ্বোধন করানো হত কোনও সাহিত্যিক বা রামকৃষ্ণ মিশনের কোনও সন্ন্যাসীর হাতে। অনেকে ব্যতিক্রমী পথে হেঁটে এলাকার কোনও কৃতী পড়ুয়াকে দিয়েও বড় মাপের পুজোর উদ্বোধন করিয়েছেন। কিন্তু সে সব দিন গিয়াছে! পুজো উদ্যোক্তাদের একাংশের বক্তব্য, আগে দুর্গাপুজোর মধ্যে একটা আধ্যাত্মিক ব্যাপার ছিল। এখন পুজো সর্বজনীন উৎসবের চেহারা নেওয়ায় সেই ব্যাপারটা আর ততটা গুরুত্বপূর্ণ নেই। এক প্রবীণ উদ্যোক্তার কথায়, ‘‘পুজোর মধ্যে একটা কর্পোরেট সংস্কৃতি এসেছে। সেটা খারাপ বলছি না। কিন্তু সেটাই আসল হয়ে উঠলে তো মুশকিল!’’ তবে একই সঙ্গে তিনি এ-ও স্বীকার করেন যে, এর ফলে সামগ্রিক ভাবে একটা অর্থনৈতিক পালাবদল ঘটে গিয়েছে। সাড়ম্বরে উদ্বোধনও তারই অঙ্গ।
নিছক ‘অঙ্গ’ কি? অধিকাংশ উদ্যোক্তা মনে করেন, নাহ্। উদ্বোধনই আসল। কারণ, উদ্বোধনেই পুরো পুজোর সুর বেঁধে দিতে হয় এখন। তখন থেকেই শুরু হয় ভিড় টানার লড়াই। এবং সে লড়াই হয় খ্যাতনামীদের টানতে পারার নিরিখে। কোন খ্যাতনামী? ইদানীং প্রথম পছন্দ মুখ্যমন্ত্রী মমতা। তার পরে ফুটবলার, অভিনেতা বা অভিনেত্রী। বলিউড হলে তো সোনায় সোহাগা। নইলে স্থানীয় প্রতিভা। অসমর্থিত সূত্রের খবর, নামী অথচ এখন হাতে কাজ কম। ফলে সময় বেশি— এমন অভিনেতা বা অভিনেত্রীর চাহিদা পুজো উদ্বোধনের বাজারে বেশি। সে বলিউড হোক বা টলিউড। তাঁদের একটি বার প্রতিমার সামনে হাজির করিয়ে দিতে পারলে আর দেখে কে! সেল্ফির বন্যা। সে তিনি অতীতচারী ফুটবলারই হোন বা শেষ কবে ‘হিট’ ছবি দিয়েছেন মনে নেই নায়িকা।
ধ্বনির চেয়ে প্রতিধ্বনি বড় হয়। উদ্বোধনের আড়ম্বর ছাপিয়ে যায় বোধনের উপাচারকে। হাসিমুখ খ্যাতনামী, গদগদ উদ্যোক্তার সঙ্গে ‘গ্রুপফি’-তে প্রতিমার মুখও কি একটু বেশি চকচকে দেখায়? দুগ্গাঠাকুর বোঝেন, তিনি লক্ষ্য থেকে উপলক্ষ হয়ে যাচ্ছেন?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy