সৌরনীলের ছবির সামনে এখনও রাখা জন্মদিনের প্যাকেটবন্দি উপহার ‘রুবিক কিউব’। —নিজস্ব চিত্র।
ঠাকুরপুকুরে ঠাকুর এসেছেন। ঠাকুরপুকুরের আরএন ঠাকুর রোডেও ঠাকুর এসেছেন। দুগ্গাঠাকুর।
দেবীপক্ষ শুরু হয়ে গিয়েছে। উৎসবে মাতোয়ারা কলকাতা শহর। বেহালার ঠাকুরপুকুরের আরএন টেগোর রোডের নবপল্লির দুর্গাপুজোতে আলোর রোশনাই। শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। পাড়ার আনাচেকানাচে উৎসবের ছোঁয়া। তার মধ্যে একটি বাড়ি জেগে রয়েছে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো। প্রতিদিন সন্ধ্যা নামতেই যে বাড়িতে অন্ধকার নামে। পুজোর আলোর রোশনাই যে অন্ধকারকে আরও গাঢ়, আরও গভীর করে দেয়।
১০২/৩ আরএন টেগোর রোড। মাস চারেক আগে এই তিনতলা বাড়ি সাত বছরের এক শিশুর কোলাহলে মুখর ছিল। তার দুষ্টুমিতে অতিষ্ঠ হতেন মা দীপিকা সরকার। বিরক্ত হয়ে কখনও-সখনও তাকে মৃদু বকুনিও দিতেন বাবা সরোজ সরকার। এক মিনিটও এক জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়াত না সৌরনীল।
৪ অগস্ট থেকে সে সব থেমে গিয়েছে। ৪ অগস্ট থেকে এই বাড়ির বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ঝুলে থাকে দীর্ঘশ্বাস। দীপিকা-সরোজ প্রায় মূক। সৌরনীলের কথা জানতে চাইলে চোখের জলে জবাব আসে। পুজো নিয়ে প্রশ্ন করলে দীপিকা কোনও মতে বলেন, ‘‘আমাদের কোনও পুজো নেই!’’ তাঁর হাহাকার চার দিকের রোশনাইকে ঢেকে দেয় অন্ধকারে। উৎসবের মঞ্চে জেগে থাকে এক সন্তানহারা দম্পতির বোবা কান্না।
অকালে চলে-যাওয়া পুত্রের স্মৃতিগোটা বাড়িতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। আলমারির ওপরে সার দিয়ে এখনও রাখা তার প্রিয় সফ্ট টয়েজ়। বাড়ির দরজায় তার অপটু হাতে আঁকা ছবির সমাহার।
স্কুলে যেতে ভালবাসত একরত্তি সৌরনীল। রবিবারেও মা-বাবার কাছে আব্দার করত স্কুল যাওয়ার জন্য। বাবা সরোজ কোনও ক্রমে ঠাকুরপুকুর বাজারে তাঁর দোকানে যাওয়ার জন্য বেরিয়ে বাঁচতেন ছেলের নাছোড় বায়না থেকে। মা দীপিকাকে সামলাতে হত ছেলের সব ঝক্কি। সেই সাধের স্কুলে যেতে গিয়েই প্রাণ চলে গিয়েছিল সৌরনীলের। অগস্ট মাসের ৪ তারিখে বাবার সঙ্গে স্কুলে যাওয়ার সময় স্কুলের অদূরে বেপরোয়া লরি পিষে দিয়েছিল সাত বছরের ফুটফুটে শিশুকে। তারপরে জনতার তাণ্ডব, পুলিশের গাড়িতে আগুন, ঘাতক লরিকে জনতার তাড়া, প্রশাসনের ‘ড্রপগেট’ তৎপরতা— সব কিছুই দেখেছেন সরকার দম্পতি। যে বেহালা চৌরাস্তায় তাঁদের সন্তানের জীবনান্ত হয়েছিল, সেখানে অনেক প্রশাসনিক বদল এসেছে। পুজোর সময়েও সেই চৌরাস্তায় পূর্ণশক্তি প্রয়োগ করে ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে রাখবে কলকাতা পুলিশ। কিন্তু নিঃস্ব পিতা-মাতার এই প্রশ্নের জবাব মিলবে না— ‘‘কেন সৌরনীলদের প্রাণ দিয়ে সম্বিত ফেরাতে হবে জনতার? প্রশাসনের? আগে থেকে উদ্যোগী হলে আমাদের ছেলেটা তো বেঁচে যেত!’’
এই প্রশ্ন কি তাঁরা প্রকাশ্যে করেন? নাহ্, করেন না। কারণ, তাঁরা জানেন, এ প্রশ্নের কোনও প্রাসঙ্গিকতা নেই আর। দিন, সপ্তাহ, মাস পেরিয়ে গিয়েছে। সে দিনের উত্তেজিত এবং বিক্ষোভরত জনতা মজে গিয়েছে পুজোর রোশনাইয়ে। উৎসবের ঢেউ এসে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছে অপ্রাপ্তি আর দুঃখের রোজনামচাকে। সৌরনীল হারিয়ে গিয়েছে কালের নিয়মে। এখন আর কারও সঙ্গে কথা বলতে ভাল লাগে না দীপিকার। করজোড়ে বহু মানুষকে বাড়ির দরজা থেকে ফিরিয়ে দিয়েছেন। কেউ সহানুভূতি দেখাতে এলেও আপত্তি করেছেন। কেন? দীপিকা জবাব দিলেন, ‘‘এ সব করলে তো আর আমার সৌরনীল ফিরে আসবে না! বরং ওর বাবার আর আমার কষ্ট আরও বাড়বে।’’
ছেলের প্রাণ গিয়েছিল। সেই দুর্ঘটনায় বাঁ-পায়ে গুরুতর আঘাত পেয়েছিলেন সরোজ। গত কয়েক মাস বাড়ি-হাসপাতাল, হাসপাতাল-বাড়ি করেই সময় কেটে গিয়েছে তাঁর। যেখানেই থাকুন, এক মুহূর্তের জন্যও ভুলতে পারেননি সে দিনের কথা। ভোলেননি, কী ভাবে বেপরোয়া লরি পিষে দিয়েছিল তাঁর সন্তানকে। তার সাক্ষী তিনি স্বয়ং। যিনি জানেন, অপরাধী শাস্তি পেলেও ছেলে আর ফিরবে না। দিন ১৫ আগে পায়ে অস্ত্রোপচার করিয়ে বাড়ি ফিরেছেন সরোজ। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, স্বাভাবিক যাপনে ফিরতে আরও অন্তত ছ’মাস। কিন্তু সেই ‘স্বাভাবিক’ জীবনে কতটা স্বাভাবিকতা থাকবে? অহরহ নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করেন সরোজ। তার পরে আনমনে স্বগতোক্তি করেন, ‘‘আর কার জন্য বেঁচে থাকা!’’
পুজো এসে গেল তো?
প্রশ্ন শুনে ক্রুদ্ধ হন দীপিকা। চিৎকার করে বোঝান, তাঁদের জীবন থেকে চিরতরে মুছে গিয়েছে ‘উৎসব’। একমাত্র সন্তানের অকালমৃত্যু তাঁদের মন থেকে ঈশ্বরের প্রতি আস্থা, বিশ্বাস মুছে দিয়েছে চিরতরে। পাপ-পুণ্যে একদা ঘোর বিশ্বাসী সরকার পরিবারের বধূ দীপিকা পুজোপাঠের পাট সরকার বাড়ি থেকে চিরতরে চুকিয়ে দিয়েছেন। বলছেন, ‘‘আমার কাছে কোনও পুজো নেই। আমাদের সব পুজো শেষ হয়ে গিয়েছে! পুজো নিয়ে আমাদের কোনও কথা বলবেন না।’’
২৫ অগস্ট জন্মদিন ছিল সৌরনীলের। সে দিন দীপিকা গিয়েছিলেন মহেশতলা এলাকার সেই গোরস্থানে, যেখানে মাটি দেওয়া হয়েছিল তাঁর একমাত্র সন্তানকে। সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন শিশুপুত্রের পছন্দের একবাটি পায়েস। কিন্তু ওই এক দিনই। তার পর থেকে আর সেখানে যাননি দীপিকা। অস্বস্তি হয়েছিল। সে অস্বস্তি এখনও যায়নি। যাবে না কোনও দিন। অনেক আগে থেকে একমাত্র সন্তানের জন্মদিন পালনের পরিকল্পনা করেছিলেন দীপিকা-সরোজ। ছেলের আব্দার মেনে কিনে এনেছিলেন ‘রুবিক কিউব’। ভেবেছিলেন, জন্মদিনে ধাঁধা উপহার দিয়ে তার সমাধান করতে বলবেন শিশুপুত্রকে। সে সব আর হয়ে ওঠেনি। খোলা হয়নি উপহারের প্যাকেট। ঘরের মধ্যে ছোট্ট টেবিলে ছবি হয়ে রয়ে গিয়েছে সৌরনীল।
ঠাকুরপুকুরে ঠাকুর এসেছেন। ঠাকুরপুকুরের আরএন ঠাকুর রোডেও ঠাকুর এসেছেন। দুগ্গাঠাকুর। আনন্দময়ীর আগমনে চারদিক মাতোয়ারা। আলোর রোশনাইয়ে ভাসছে নবপল্লি। সেই পল্লির একটি বাড়ির তিন তলার ঘরের সিলিং থেকে ঝুলে আছে নিকষ অন্ধকার। সেই ঘরের টেবিলে রাখা ফ্রেমবন্দি দুরন্ত শিশুর চোখে পলক পড়ছে না। সামনে রাখা তার জন্মদিনের উপহার প্যাকেটবন্দি ‘রুবিক কিউব’। সে দিকে তাকিয়ে জীবনের ধাঁধার সমাধান হাতড়াচ্ছেন এক পুত্রহারা দম্পতি।
(এই লেখাটি প্রথম প্রকাশের সময় ‘রুবিক কিউব’কে ‘জিগ্স পাজ়ল’ লেখা হয়েছিল। অনিচ্ছাকৃত সেই ত্রুটির জন্য আমরা দুঃখিত ও ক্ষমাপ্রার্থী)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy