Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

বঙ্গে ঈশানদের সঙ্গে নিকুম্ভ স্যারেরাও অন্ধকারে

ডিসলেক্সিয়ায় আক্রান্ত ঈশান। স্কুলের অধিকাংশ শিক্ষকই তাকে পছন্দ করেন না। শেখানো বুলি ঠিকঠাক আওড়াতে না-পারলেই— সপাং। বেতের বাড়ি। অসহায় ছেলেটিকে শেষ পর্যন্ত স্বপ্ন দেখতে, রঙে-রেখায় স্বপ্ন আঁকতে শেখালেন অঙ্কন-শিক্ষক রামশঙ্কর নিকুম্ভ।

সুপ্রিয় তরফদার ও মধুরিমা দত্ত
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৪ মার্চ ২০১৬ ০৩:৪০
Share: Save:

ডিসলেক্সিয়ায় আক্রান্ত ঈশান। স্কুলের অধিকাংশ শিক্ষকই তাকে পছন্দ করেন না। শেখানো বুলি ঠিকঠাক আওড়াতে না-পারলেই— সপাং। বেতের বাড়ি। অসহায় ছেলেটিকে শেষ পর্যন্ত স্বপ্ন দেখতে, রঙে-রেখায় স্বপ্ন আঁকতে শেখালেন অঙ্কন-শিক্ষক রামশঙ্কর নিকুম্ভ।

জ্বরে ভুগে ভুগে দেখার আর শোনার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিল ছোট্ট মিশেল। শেষ পর্যন্ত তার অন্ধকার জীবনে পৃথিবীর সমস্ত রং, আলো, শব্দের মাধুর্য উজাড় করে দিলেন শিক্ষক দেবরাজ সহায়।

এ-সবই রুপোলি পর্দার গল্প। সিনেমায় দু’-আড়াই ঘণ্টার পরিধিতে যে-ভাবে আশাপূরণের গল্প তুলে ধরা হয়, ‘তারে জমিন পর’ বা ‘ব্ল্যাক’ ছবিতে তেমনটাই হয়েছিল।

কিন্তু বাংলার জেলায় জেলায় বাস্তবের ঈশান অবস্থি, মিশেল ম্যাকনালিদের কপাল মোটেই এত ভাল নয়। কারণ, এই ধরনের ‘বিশেষ’ শিশুদের জন্য তেমন কোনও সুযোগই নেই এখানে। রাজ্যে প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ঈশান-মিশেলের সংখ্যা দু’লক্ষের মতো। নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণিতে রয়েছে এই ধরনের প্রায় ২৫ হাজার পড়ুয়া। কিন্তু তাদের আলো দেখানোর চেষ্টা বা উদ্যোগ নেই বললেই চলে।

এমন নয় যে, নিকুম্ভ স্যার-দেবরাজ স্যারদের ঘাটতি আছে পশ্চিমবঙ্গে। বিশেষ প্রশিক্ষণ নিয়ে প্রস্তুত আছেন অন্তত দু’হাজার নিকুম্ভ-দেবরাজ। কিন্তু ওই শিশুদের মতো উপেক্ষিত সেই সব বিশেষ প্রশিক্ষকও। কাজ করার সুযোগই নেই তাঁদের। পডুয়া আর প্রশিক্ষকদের কাছাকাছি আসার পথ অবরুদ্ধ।

‘বিশেষ’ শিশুদের পড়াশোনার জন্য ১৯৯২ সালে তৈরি হয় রিহ্যাবিলিটেশন কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া বা আরসিআই। তারা প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেয়। এটা স্পেশ্যাল বিএড। নিয়ম অনুযায়ী প্রত্যেক স্পেশ্যাল বিএড পড়ুয়াকে আরসিআই-এ নাম লেখাতে হয়। সেই প্রশিক্ষণ নিয়ে প্রায় দু’হাজার শিক্ষক বসে আছেন এই রাজ্যে। ২০০৯ সালের পর থেকে তাঁদের নিয়োগের পথ বন্ধ হয়ে আছে বলে অভিযোগ প্রশিক্ষিতদের।

শুধু প্রাথমিক বা উচ্চ প্রাথমিকে নয়, মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিকেও যাতে ওই বিশেষ শিশুদের স্বার্থ সুরক্ষিত থাকে, তার জন্য ২০০৯-’১০ সালে কেন্দ্রীয় সরকার একটি বিশেষ প্রকল্প নেয়। ‘ইনক্লুসিভ এডুকেশন অব দ্য ডিসেব্‌লড অ্যাট সেকেন্ডারি স্টেজ’ (আইইডিএসএস) নামে সেই প্রকল্পের আওতায় এ রাজ্যেও কাজ চলার কথা। কিন্তু খাতা-কলমের বাইরে বাংলার বাস্তবে তার অস্তিত্ব নেই বলেই অভিযোগ। প্রশিক্ষিত প্রার্থীদের আশা ছিল, চলতি বছরের স্কুল সার্ভিস কমিশন (এসএসসি)-এর শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তিতে তাঁদের

নিয়োগের উল্লেখ থাকবে। কিন্তু সেই আশা পূরণ হয়নি।

কেন? গত ১৬ ফেব্রুয়ারি নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষক নিয়োগের যে-বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে, তাতে প্রতিবন্ধীদের স্বার্থ উপেক্ষা করা হয়েছে বলে অভিযোগ পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য প্রতিবন্ধী সম্মিলনীর। সংগঠন সূত্রের খবর, ওই বিজ্ঞপ্তিতে শিক্ষক বাছাইয়ের যোগ্যতা হিসেবে স্পেশ্যাল বিএড প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রার্থীদের বিষয়টি সম্পূর্ণ উপেক্ষিত হয়েছে। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক তথা প্রাক্তন মন্ত্রী কান্তি গঙ্গোপাধ্যায় জানান, ওই বিজ্ঞপ্তিতে পরোক্ষে প্রতিবন্ধকতাযুক্ত শিক্ষার্থীদেরও সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা হয়েছে। ‘‘তা হলে নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণিতে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন যে-সব পড়ুয়া আছেন, তাঁদের কী হবে? তাঁদের কি বিশেষ প্রশিক্ষকের প্রয়োজন নেই,’’ প্রশ্ন তুলছেন কান্তিবাবু।

বিজ্ঞপ্তিতে যোগ্যতামান হিসেবে লেখা রয়েছে, ন্যাশনাল কাউন্সিল অব টিচার্স এডুকেশন বা এনসিটিই-র অধীনে বিএড প্রশিক্ষণ থাকতে হবে। বর্তমানে পড়ুয়া এবং বিশেষ শিক্ষকের অনুপাত ১:১৫৪। কিন্তু ২০০৯ সালের শিক্ষার অধিকার আইন অনুযায়ী অনুপাত হতে হবে ১:৩০। শুধু তা-ই নয়, শিক্ষার অধিকার আইনে সাধারণ স্কুলেই লেখাপড়া করতে পারেন প্রতিবন্ধীরা। কিন্তু ওই সব স্কুলে স্পেশ্যাল বিএড ডিগ্রিধারীদের নিয়োগ না-করলে প্রতিবন্ধী পড়ুয়াদের কী হবে, তা নিয়ে সংশয় ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বিভিন্ন শিক্ষক সংগঠনও।

স্কুল সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান সুবীরেশ ভট্টাচার্যকে প্রতিবন্ধী সম্মিলনী জানিয়েছে, ২০১১ সালে এই রাজ্যের সরকারই স্পেশ্যাল বিএড-কে মান্যতা দিয়েছিল। ২০১৫ সালে পশ্চিমবঙ্গ স্কুল সার্ভিস কমিশনের নিয়মে এনসিটিই ও আরসিআই-এর বিএড সমতুল্য বলে জানানো হয়েছে। তা হলে এ বছর স্পেশ্যাল বিএড-কে ধর্তব্যের মধ্যেই আনা হল না কেন?

এসএসসি-র এক কর্তা বলেন, ‘‘২০১৪ সালের ডিসেম্বরে এনসিটিই যে-বিজ্ঞপ্তি জারি করেছিল, তাতে উচ্চ প্রাথমিকের ক্ষেত্রে স্পেশ্যাল বিএডের উল্লেখ থাকলেও নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে এ-রকম কোনও কিছুর কথা বলা হয়নি।’’ তাঁর ব্যাখ্যা, এনসিটিই-র ওই বিজ্ঞপ্তি মাথায় রেখে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে নিয়োগ সংক্রান্ত বিধিতে সংশোধনী আনে স্কুলশিক্ষা দফতর। তাতে স্পেশ্যাল বিএডের প্রসঙ্গটিই তুলে দেওয়া হয়।

প্রশ্ন উঠছে, এনসিটিই-র বিজ্ঞপ্তি (২০১৪)-র পরেও তো স্কুলশিক্ষা দফতর ২০১৫-য় এনসিটিই ও আরসিআই-এর বিএড সমতুল বলে জানিয়েছিল। সেই বছরের মার্চে ওই দফতর যে-বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিল, তাতে এনসিটিই-র নিয়ম (নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত স্পেশ্যাল বিএড শিক্ষক নিয়োগের উল্লেখ না-থাকা) মানা হল না কেন?

স্পষ্ট উত্তর দিতে পারেনি এসএসসি-র কর্তারা। কমিশনের এক কর্তা স্রেফ জানিয়ে দেন, আইনের বিষয়টি স্কুলশিক্ষা দফতর জানে। কমিশন তার সঙ্গে জড়িত নয়।

কী বলছেন রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়? ‘‘দাবি (স্পেশ্যাল বিএড-দের নিয়োগ করার দাবি) করলেই তো হল না। যা হবে, এনসিটিই-র নিয়ম মেনেই হবে,’’ বলছেন শিক্ষামন্ত্রী।

তা হলে ২০১৫-র বিজ্ঞপ্তিতে সেই বিধি লঙ্ঘন করা হল কেন?

‘‘বিধি লঙ্ঘনের প্রশ্নই নেই। সরকার তো প্রথম থেকেই বলে আসছে, আমরা এনসিটিই-র নিয়মের বাইরে যাবো না,’’ স্পষ্ট উত্তর মন্ত্রীর। আর রাজ্যের স্কুলশিক্ষা দফতরের একটি সূত্র জানাচ্ছে, বিষয়টি নিয়ে এনসিটিই-র ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে।

সেই ব্যাখ্যার আশাতেই বসে আছেন স্পেশ্যাল বিএড প্রশিক্ষণ পাওয়া হাজার দুয়েক শিক্ষক।

অন্য বিষয়গুলি:

dyslexia supriyo tarafdar madhurima dutta
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE