প্রার্থী তালিকা হাতে বিমান বসু। আলিমুদ্দিনে। ছবি: দেবাশিস রায়।
কঠিন লড়াইয়ে ঘরের লোকের উপরেই ভরসা রাখল আলিমুদ্দিন। লোকসভা ভোটের প্রার্থী তালিকায় কোনও চমকের পথে হাঁটল না তারা। প্রার্থীদের গড় বয়স কম রেখে, মুসলিম মুখের সংখ্যা বাড়িয়ে সঙ্কট কালে রাজনৈতিক সৈনিকদেরই ময়দানে নামাল বামফ্রন্ট।
লোকসভা ভোটের নির্ঘণ্ট ঘোষণার পরেই বুধবার কালীঘাট ও আলিমুদ্দিন স্ট্রিট থেকে পিঠোপিঠি প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করে দিয়েছে তৃণমূল ও বামফ্রন্ট। সংখ্যার বিচারে, বামেদের ১৫ জন সাংসদের মধ্যে এ বার বাদ গিয়েছেন চার জন। পাশাপাশি, লোকসভায় নতুন প্রার্থী ২৪ জন। এঁদের মধ্যে ৬ জন অবশ্য আগে রাজ্যের মন্ত্রী-বিধায়ক হয়েছেন বা বিধানসভায় লড়েছেন। বাকি ১৮ জনের এই প্রথম বড় নির্বাচনে লড়াই। মোট ৪২ জন প্রার্থীর মধ্যে মুসলিম মুখের সংখ্যা গত বারের পাঁচ থেকে এ বার বেড়ে হয়েছে ১২। তফসিলি জাতি ও উপজাতি প্রার্থীর সংখ্যা ১৩। সংরক্ষিত আসনের বাইরেও মালদহ উত্তরের মতো কেন্দ্রে আদিবাসী বিধায়ক খগেন মুর্মুকে প্রার্থী করেছে বামফ্রন্ট। আনুপাতিক হিসাবে মহিলা মুখের সংখ্যা বরং কম ৬ জন। মহিলা সংরক্ষণ বিল নিয়ে সরব বৃন্দা কারাটদের দলে প্রমীলা মুখ কম কেন, তা নিয়ে প্রশ্নের জবাবে ঈষৎ বিব্রত বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু বলেছেন, “কথা দিচ্ছি, আগামী বার থেকে মহিলা প্রার্থী বেশি থাকবে!”
নরেন্দ্র মোদী বিজেপি-র প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হওয়ার পর থেকেই সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী প্রচারের সুর চড়িয়েছে বামেরা। ভোটের পরে তৃণমূল বিজেপি-র হাত ধরতে পারে, এমন প্রচারও লাগাতার বজায় রেখেছেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, বিমানবাবু, সূর্যকান্ত মিশ্রেরা। সেই ধারার সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই এ বার মুসলিম প্রার্থীর সংখ্যা বাড়িয়েছে আলিমুদ্দিন। তৃণমূল যেখানে ৭ জন সংখ্যালঘু প্রার্থী দিয়েছে, বামেরা সেখানে ১২। শুধু উত্তর ২৪ পরগনা জেলার পাঁচটি আসনের মধ্যে তিনটিতেই সিপিএম, সিপিআই, ফরওয়ার্ড ব্লক মিলে সংখ্যালঘু প্রার্থী দেওয়া হয়েছে। মুসলিম ও তফসিলি জাতি-উপজাতি প্রার্থীর যে রসায়ন এ বারের বাম প্রার্থী তালিকায় রয়েছে, তা সদ্য বহিষ্কৃত সিপিএম নেতা আব্দুর রেজ্জাক মোল্লার তত্ত্বের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণই! তালিকা দেখে স্বয়ং রেজ্জাকও মন্তব্য করেছেন, “আমি নাড়াচাড়া দেওয়ায় এক ধাক্কায় এইটুকু অন্তত হয়েছে!” রেজ্জাকের দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার সিপিএম সম্পাদক এবং যাদবপুরের প্রার্থী সুজন চক্রবর্তীর অবশ্য যুক্তি, “এই তালিকা তো রেজ্জাক মোল্লা বহিষ্কার হওয়ার পরে রাতারাতি তৈরি হয়নি! আমরা যে এই পথে এগোচ্ছি, উনি জানতেন! এটা ভারসাম্যের তালিকা হয়েছে।”
সিপিএম রাজ্য নেতৃত্ব জেলা কমিটিগুলির কাছে নির্দেশিকা পাঠিয়েছিলেন, বয়স বা ভাবমূর্তির সমস্যায় একেবারে অপারগ কেউ না হলে বর্তমান সাংসদদের ফের প্রার্থী করতে হবে। এই ক্ষেত্রে প্রায় তৃণমূলের পথেই হেঁটেছে বামেরা। সিপিএমের ৯ সাংসদের মধ্যে একমাত্র বর্ধমান-পূর্বের অনুপ সাহা বাদ পড়েছেন। সিপিআইয়ের গুরুদাস দাশগুপ্ত দাঁড়াননি, ফ ব-র নৃপেন রায় এবং আরএসপি-র প্রশান্ত মজুমদার টিকিট পাননি। নতুন তালিকায় প্রবীণতম মুখ গত লোকসভায় বামেদের দলনেতা বাসুদেব আচারিয়া। বাঁকুড়ায় মুনমুন সেনের সঙ্গে লড়তে হবে জেনে যিনি এ দিন বলেছেন, “ব্যক্তি নয়, লড়াই দলের সঙ্গে। তবে প্রার্থীর পরিচিতি কিছুটা কাজ করে বৈকি! আমি এলাকার মানুষের সঙ্গেই থেকেছি, তাঁদের জন্য কাজ করেছি। বারো মাস যা বলেছি, ভোটের সময়েও তা-ই বলব।” এ বারের তালিকায় নবীনতম মুখ মথুরাপুরের প্রার্থী রিঙ্কু নস্কর। কাউন্সিলর রিঙ্কু প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ানোর কাজে যুক্ত, বয়স ২৫ বছর ৭ মাস। সামগ্রিক ভাবেই প্রার্থীদের গড় বয়স ৫০-এর নীচে।
কিন্তু বাসুদেবের মতো পুরনো মুখ এখনও ধরে রাখতে হল কেন, সেই প্রশ্নও উঠছে কোনও কোনও মহলে। বিমানবাবুর মন্তব্য, “নতুন প্রার্থী হলে বলবেন, সব কেন নতুন? পুরাতন থাকলে বলবেন, এখনও কেন পুুরাতন? এ তো মহা মুশকিল!” তবে রসিকতার বাইরে বিমানবাবু এই ব্যাখ্যাও দিয়েছেন, লোকসভার কক্ষে লড়াই করতে গেলে কিছু অভিজ্ঞ নেতা দরকার। সব নতুন সাংসদ হলে কার্যক্ষেত্রে চলবে না। তাই নতুন-পুরনোয় ভারসাম্যের কৌশল নিয়েছেন তাঁরা। তবে তৃণমূলের সঙ্গে বাম তালিকার সব চেয়ে বড় ফারাক হল তারকা-মুখের অভাব। কেন তাঁরা দল বা ফ্রন্টের বাইরে চলচ্চিত্র বা খেলাধুলোর জগৎ থেকে প্রার্থী আনলেন না? বিমানবাবুর যুক্তি, “যাঁরা জিতবেন, তাঁদের মাঠে-ময়দানে মানুষের কথা লোকসভায় প্রতিধ্বনিত করতে হবে। আবার লোকসভার ভিতরের বার্তা বাইরে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে। এই দুই সংগ্রামের মেলবন্ধন যাতে হয়, তার জন্য ছাত্র-যুব-শ্রমিক বা শিক্ষক সংগঠন থেকে তাঁদেরই বেছে নেওয়া হয়েছে, যাঁরা ময়দানে কাজ করছেন।”
নতুন মুখের মধ্যে পূর্ব মেদিনীপুরের ছাত্র-নেতা শেখ ইব্রাহিম আলি তমলুকে প্রার্থী হয়েছেন। ওই জেলারই কাঁথি আসনে প্রার্থী প্রাক্তন সর্বভারতীয় যুব নেতা তাপস সিংহ। কঠিন আসন হলেও লড়াই দেওয়ার ব্যাপারে যিনি আত্মবিশ্বাসী। বয়সে তাঁদের চেয়ে বড় হলেও লোকসভা ভোটের আঙিনায় নতুন প্রার্থী দমদমে অসীম দাশগুপ্ত। রাজ্যের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী হিসাবেই দিল্লিতে তাঁর যথেষ্ট পরিচিতি আছে। অসীমবাবুর প্রচার শুরু হয়ে গিয়েছে এ দিন বিকালেই। রাতে তিনি বলেছেন, “এপিএল-বিপিএল বিভাজন তুলে দেওয়া, গরিবদের জন্য দু’টাকা কিলো চাল, সকলের জন্য শিক্ষা আমাদের বিকল্প নীতির কিছু নির্দিষ্টকরণ আমি করতে চাই। শুধু দমদম বলে নয়, সারা রাজ্যের মানুষের জন্যই এই লড়াই।”
গোটা বাম তালিকায় সব চেয়ে বিতর্কিত নাম শেষ পর্যন্ত সুভাষিণী আলিই। উত্তরপ্রদেশ থেকে কেন ব্যারাকপুরে তাঁকে উড়িয়ে আনতে হচ্ছে, এই নিয়ে সিপিএমের নেতা-কর্মীদের মধ্যেই প্রশ্ন আছে। বামফ্রন্টের বৈঠকে এ দিন প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত হওয়ার সময়েও ওই নাম নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। জেলায় গোষ্ঠী-দ্বন্দ্বের সমস্যা কাটাতে বহিরাগত সুভাষিণীতেই অবশ্য সিলমোহর দিয়েছে আলিমুদ্দিন। আনন্দবাজারকে এ দিন সুভাষিণী বলেছেন, “বাংলার হৃদয় অনেক বড়! এখানে বহিরাগত বলে কোনও সমস্যা হবে বলে আমার মনে হয় না। সংবিধান রচনার সময়ে বি আর অম্বেডকরকেও এই বাংলা নির্বাচিত করে পাঠিয়েছিল।” অতীত থেকে অম্বেডকর, কৃষ্ণ মেনন, রেণু চক্রবর্তী, ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত, মহম্মদ ইসমাইলের মতো একাধিক দৃষ্টান্ত পেশ করে বিমানবাবুও বলেছেন, “ব্যারাকপুরের তৃণমূল সাংসদ দীনেশ ত্রিবেদীও তো গুজরাতের মানুষ! লোকসভায় যাঁদের আওয়াজ তোলা জরুরি বলে আমরা মনে করি, তাঁদেরই স্বাগত জানাই। এ ক্ষেত্রেও তা-ই।” পাশাপাশিই সুভাষিণীর বক্তব্য, “পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক সংঘর্ষ বহু কাল ধরে হয়েছে। কিন্তু নারী নির্যাতনের এমন ভয়াবহ চিত্র আগে ছিল না। মহিলা আন্দোলনের কর্মী হিসাবে ভোটের ময়দানে সে কথা বলব।” আন্তর্জাতিক নারী দিবসের দিনই (৮ মার্চ) রাজধানী এক্সপ্রেস থেকে কলকাতায় নামার কথা প্রয়াত লক্ষ্মী সহগলের কন্যার।
বারবার দাবি করা সত্ত্বেও বাম শরিকদের কাউকেই অতিরিক্ত আসন ছাড়েনি সিপিএম। অন্তত দু’টি আসন দাবি করলেও সমাজবাদী পার্টিকে কোনও আসন দেওয়া হয়নি। সমাজবাদী যদি আলাদা প্রার্থী দাঁড় করায় কী হবে? বিমানবাবু বলেছেন, “এ ব্যাপারে ওঁদের সঙ্গে কথা বলব।” এই পরিস্থিতিতে আজ, বৃহস্পতিবারই কলকাতায় সাংবাদিক সম্মেলন করে তাঁদের অবস্থান ঘোষণা করার কথা কিরণময় নন্দের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy